বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা চারপায়ে হাঁটবার পূর্বমূহুর্তে

কথিত আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যেভাবে  চা খেতে জানে, সেটা শিখতেও অন্যদের ম্যালা দিন লাগে। কথা চালু হবার পেছনে মনে হয় ঐতিহ্য ব্যাপারটা আছে। আমাদের ঐতিহ্য বেশ ভারী। অন্তত এ দেশে যদি ঐতিহ্যের দিক থেকে একটা গোষ্ঠীকে মাপতে যাওয়া হয়, ঢাবির নামটা ওপরেই আসবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যা ঘটছে দিনে দিনে, মুখ লুকবার জায়গা থাকবেনা। আমাদের ঐতিহ্যটা যে উগ্র পেশিশক্তির চেয়ে বেশি কিছু, সেটা প্রত্যেকের কানে কানে গিয়ে বলে দিয়ে আসতে হবে হয়তবা। হয়তবা লিখে দিতে হবে আমাদের প্রতিটা নোটিশে, পরীক্ষার প্রশ্নে, ভর্তির আবেদনপত্রে, ক্যাম্পাসের প্রতিটা ঘরের দরজায়। উল্টো রাস্তা আর প্রশ্ন ফাঁস নয়, আজকের ঘটনাটা শুনুন না!

সন্ধ্যেটা অতটা খারাপ ছিলনা। সন্ধ্যার আগে উত্তম কুমারের একটা সিনেমা দেখে নায়িকা তনুজার চোখ কল্পনায় খুব করে গেঁথে গিয়েছিল। সাড়ে ছটায় ক্লাস ছিল স্প্যানিশের, ছয়টা বিশে টিএসসিতে ঢুকতে অক্টাভিয়ানের সঙ্গে দেখা।

শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭

এ-লো-মে-লো

'চিল মুড' শব্দটার একটা অর্থ খুঁজছিলাম। কিন্তু ঠিক মিলছিল না কিছু। 'মাস্তি' হতে পারত, যদি সেটা বাংলা শব্দ হত। 'ফুর্তি' শব্দটা সবার মাথায় আসবে, কিন্তু সেটা ঠিক চিল মুড এর সঙ্গে যায়না। ফুর্তির মধ্যে একধরনের ছেলেমানুষি ভাব আছে। আমি যখন কোন পরীক্ষা দেই, আমার মস্তিষ্ক তখন চকলেট খাবার, কিংবা প্রেমে আপ্লুত হবার পরমূহুর্তের মত অবস্থায় থাকে। কোনরকম ক্লান্তি কাজ করেনা। তাই বারবার মনে হচ্ছিল, পরীক্ষা জিনিসটা সবসময় চিল মুডের আবেদন নিয়ে আসে আমার জীবনে। যদিও জিনিসটার প্রতি বিরক্তি আছে, মাসখানেকের পরীক্ষা আমাকে হাঁপিয়ে তোলে, তবু পরীক্ষার সময়টুকুতে আমি  ধ্বসে পড়িনা। পরীক্ষার হলে আমার কষ্ট হয়না কোন। ব্যাপারটা মাথায় এল দুদিন পর পরীক্ষা বলে।

পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমনব হচ্ছে সেটা আলাপ করবার মত কিছু না। তবে আজ দিনভর বৃষ্টি সবকিছু এলোমেলো করে দিল। 'ডিভাইস' জিনিসটা আমাদের জীবনে খুব ভালো কিছু এনেছে বলে আর মনে হচ্ছেনা। আজ দুপুরে বৃষ্টিতে যখন রাস্তাঘাট (একসময় লেখা হত নদী-নালা) ভেসে যাচ্ছে, তখন আমাদের ক্লান্তি এল। একটা ঘরে তিনটা মানুষ, আহমাদ, ইব্রাহিম, এবং আমি। হঠাৎ দেখা গেল একই ঘরে বসে আমরা তিনজনে আলাদা তিনটা সিনেমা দেখছি! কম্পিউটারের বড় স্ক্রিনে আহমাদ ফরেস্ট গাম, ইবরাহিম মোবাইলে কোন একটা যুদ্ধের ছবি, এবং আমি উত্তম কুমার-শর্মিলা ঠাকুরের অমানুষ দেখছি। বাংলা ছবিই আমার ভালো হজম হয়।

সন্ধ্যাটা ছিল বেশ ভেজা, ঘুমুনোর জন্য আদর্শ। যেহেতু পড়তে বসতে হবে, আমি তাই বললাম, "চা খাবি?"
চায়ের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে দেখা গেল চিনি নেই। বললাম তবে গুড়ের চা হোক, গুড় তো আছেই। এরপর মনে পড়ল, দিন দুয়েক আগে চায়ের প্যাকেটটা আমিই শেষ করেছি। তাহলে? কফি হোক, অবশ্যই গুড়ের কফি। এবং এখন যদি ফ্রিজ থেকে দুধ (ফ্রিজে গরুর খাঁটি দুধ থাকে প্রায়ই) বের করে ভেজাই, সেটা গলতে বেশ সময় নেবে। শেষ পর্যন্ত  যেটা তৈরী হল, সেটা গুড়ের ব্ল্যাক কফি। কৌতুক করে বললাম, এর মধ্যে দু টুকরো আদা দিয়ে দিলে কেমন হয়?

জিনিসটা খেতে বিচ্ছিরি ছিল যদিও, তবে সেই কফিতে টোস্ট ভিজিয়ে খেয়ে ক্ষুধাটা তো কমল! কিন্তু ও কি চুমুকে শেষ করা যায়? বেসিনে ঢালতে হল অর্ধেকটা। শেষে মনে মনে নিজেকে গালি দিতে হল, শালা বাঙাল!

দুদিন পর নিউট্রিশন পরীক্ষা। জিনিসটা যতই কিউট হোকনা কেন, একটা বাচ্চার কোন মাসে কোন অঙ্গ তৈরী হয়, সেসময়ে কোন খাবারটা মাকে খেতে হবে, সেটা মুখস্থ করানো অত্যাচার। জিংক কিংবা সেলেনিয়াম কয় মিলিগ্রাম দিনে খেতে হবে, নইলে কোন কোন রোগ হতে পারে, সেটার আবার কেমন লক্ষণ দেখা যাবে, সেটা কতটা ভয়ঙ্কর, তা শুধু ডাক্তার আর নিউট্রিশনের লোকজন জানে। আর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের কত পার্সেন্ট শিশু স্টান্টেড ছিল, ২০০৪ থেকে সেটা কতটা উন্নত, সেই পরিসংখ্যান গ্রাফসহ মুখস্থ করা নিজেকে অত্যাচার করার শামিল।

উত্তম কুমারকে দেখে মনে হচ্ছিল, একদিন যদি এমন হয়, আমি কোথাও ক্লাস নিচ্ছি, সেই ঘরটায় একটা মানুষ ঢুকল, এবং আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমি কলমটা টেবিলে রেখে খানিকক্ষণ চুপ থেকে কাউকে ফিসফিসিয়ে বলব, এক কাপ চা হবে? এরপর নিজের কপাল রগড়ে অনেকটা শব্দ করে বললাম, "উইল ইউ প্লিজ গেট আউট?"

এটুকু পড়ে উচ্ছ্বাস নিশ্চয়ই বলবে, শালা আজকাল মালটাল বেশি খাচ্ছিস নাকি?

বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাকরি যাওয়ার পর


ছবিঃ pinterest থেকে সংগৃহীত মুক্ত ছবি

এক.
লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ এর মতন। ঠিকঠাক বোঝার উপায় নেই। মুখভর্তি ছেটে রাখা দাঁড়ি, পোড়া তামাটে রংয়ের চামড়ায় ঠিক থুতনির কাছে একটা গভীর দাগ। শুকনো মুখের সাথে ছোট ছোট চুলগুলো মলিনতা প্রকাশ করছে। তার নাম আবুল কালাম।

আজ তার পরনে আছে একটা কালো ফুলপ্যান্ট, লাল-কালো একটা শার্ট। বহু পুরনো শার্টটায় কিছু দাগ আছে, আর দুয়েক জায়গায় ছেঁড়াও আছে। তবে ছেড়া জায়গাগুলো তার স্ত্রী এমনভাবে কায়দা করে সেলাই করে দিয়েছে যে বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে শার্টটা শেষ কবে ইস্ত্রি করা হয়েছে, আদৌ কখনো করা হয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছেনা।

আজ তার চাকরি গেছে। সে ছিল 'দি নিউ বাইন্ডিং এজেন্সি' এর সেলস ম্যানেজার। এই প্রতিষ্ঠানে দুটিমাত্র পদ। ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সেলস ম্যানেজার। এর সঙ্গে একজন কুলি হল এখানকার সর্বমোট মানবসম্পদ। অফিসটা আরামবাগের একটা ঘুপচি গলির শেষমাথায়, ছোট্ট এক রুমের। দুই কোনে দুটি টেবিল, আর স্তুপ করে রাখা প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, ওষুধের বাক্স, মেমো। এই অফিসটাই একইসাথে এজেন্সির স্টোররুম। এজেন্সির ম্যানেজিং ডিরেক্টর শামসুদ্দিন মোল্লা একজন ভুঁড়িওয়ালা বেঁটে লোক। মাথায় টাক থাকলে তাকে ঠিক মানিয়ে যেত সিনেমার এমন চরিত্রের সঙ্গে। কিন্তু

শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

গল্প নামের অনেকগুলো গল্প

ঝাপসা হয়ে আসা দুঃখী বকুলেরা

এটা একটা গল্প। মহাজগতের দুধারে বাস করা দুটো মানুষের গল্প। বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর গল্পের মত হতে পারে। আবারো হতে পারে সফল অভ্যুত্থানে হটিয়ে দেয়া হয়েছে যে প্রেসিডেন্ডকে, তার নির্বাসিত জীবনের গল্পের মত, যেমনটা মার্কেজ লেখে। গল্পটার গল্পগুলো যেহেতু অকল্পনীয় রকমের অবাস্তব, তাই শুরু নেই, এবং শেষ নেই। আছে অনেকরকম মধ্যিখানের কথা। এই যেমন এক বিকেলে ময়লার ঝুড়িটার টুকরো কাগজে ভারী হবার মত একটা গল্প আছে। আবার আরেকটা গল্প আছে রেলের জানালার পাশে। ঝক-ঝক ঝক-ঝক শব্দসুরের ফাঁকে কেমন করে যেন সেসব তৈরী হয়ে গেছে। দুরুত্বটা যেহেতু বহু আলোকবর্ষ দূরের, তাই ভালোবাসা কখনো এধার থেকে ওধারে পৌঁছয় না। কে জানে, কোনপাশে ভালোবাসা তৈরী হয়না বলেই, কিংবা দুরুত্বটা বহু আলোকবর্ষ দূরের বলেই। দুধারের গল্পটাই শহুরে গল্প। তার মধ্যেও আধটুকরো গ্রামের সরলতা। অল্পখানি কল্পনার মিষ্টতা। বিন্দুখানি লেখনীর প্রাঞ্জলতাও যে নেই তেমন না। 

গল্পটায় ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারের নারিকেল গাছের কিছু স্মৃতি আছে। কপোত-কপোতির দুপুরের সূর্যস্নান নিয়েও অনেক কথা আছে। কে জানে! সবকিছু কেন যে কাগজে মুচড়ে ময়লার ঝুড়িতে করে শহরের প্রান্তে বিশাল কোন কাকের ভোজালয়ে বিরক্তির উদ্রেক করতে গিয়ে জোটে! গল্পটায় অনেক নিষ্ঠুরতা আছে। দুপাশের ভালোবাসা মাঝপথে গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলেও নিষ্ঠুরতাগুলো, দুঃখগুলো গিয়ে ঠিকই ছুঁয়ে আসে। কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিলো, তাঁর বহু বছর আগেকার এই গল্পগুলোও মনে পড়ে। সেবারের গল্প, যেবার জিপসিরা শীতের অনেক আগেই চলে এসেছিলো। বুড়ির ঝোলায় যে শামুকের মালাটা থাকে, সেখান থেকে টুপ করে পড়ে যাওয়া একটা গল্প সুড়সুড় করে এসে পড়েছিলো জগতের দু মাথার মানুষ দুটোর কাছে। দুজন দুজনকে ঘেন্না করতে করতে ভালোবেসেছিলো। সমুদ্রের এপার থেকে ওপারে সাতরে পার হয়ে যাওয়া একটা নারকেলের খোলসে আবছা কালিতে লেখা ছিল, বিপ্লব। 

পেন্সিল ব্যাগে জমে জমে থাকা বকুল ফুলগুলো যখন শুকিয়ে মলিন হয়েও সুগন্ধি ছড়াতে থাকে, তখন একটা মানুষের প্রয়োজন হয় বেদের তাগা। হাতে বাঁধবার পর সেটা আর বকুল ফুলের গল্প থাকেনা। একতোড়া কাগজের মধ্যে চাপা পড়া একটা বকুলের মালা হয়ে যায়। গেঁথে থাকা প্রত্যেকটা ফুল হয় বহু আলোকবর্ষ দূরের। তারচে পেন্সিল ব্যাগের প্রতিটা বকুলই হয় খুব আপন। দিন দিন নতুন বকুল আসে, যারা খুব শীঘ্রই মলিন হয়। 

গল্পটা এক কেরানির। দিনভর কাগজে কয়লার হিসেব লিখে যক্ষ্মার বসে যাওয়া কাশি নিয়ে সন্ধ্যেয় কুড়ের মেঝেতে গা এলিয়ে দিয়ে একটা প্রদীপ জ্বেলে বসে। সেই প্রদীপ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে এক ছনের ঘরের দরোজার ওপাশে আবছায়া প্রতিকৃতি তৈরী করতেই সে ঘরের মানুষটার দিনভর হরিণ ঘাস খাওয়াবার ক্লান্তি ছায়াটাকে আগুন করে ফেলে। সেই আগুন গ্রাস করে মাঠ, গাছ, মাকড়সার জাল, সেই জালের ভারটুকু বওয়া পাইন বৃক্ষ, আর জলের কূপ। হাওয়া হয়ে উড়ে যায় জল। সেই আগুন আরও সর্বগ্রাসী হয়। কিন্তু একটা বকুল গাছ, দেবদারু গাছকে চুমু খেতে খেতে ধীরে সুস্থে হেঁটে হেঁটে যায়। বহুদূরে যায়। এরপর হঠাৎ করে ছাই হয়ে যায়। বাতাসে ওড়ে। 

জার নামের বেড়ালটা মহান অক্টোবর বিপ্লবের একশটা বছর পরেও স্পষ্ট স্বরে বলে, ম্যাও!

মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

হঠাৎ একদিন নবাব বাড়িতে


ঢাকা কতটুকু? অদ্ভুত প্রশ্ন বটে। ঢাকা শহরটা অনেক বড়। এখন নদীর ওপারেও সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা কত বড় ছিল? বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা শহর। এবং তিন নেতার মাজারের সামনে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। বলায় ভুল হয়ে গেল। যেখানে ঢাকা শেষ হয়েছিল মোঘল আমলে, সেখানটায় গড়ে উঠেছে তিন নেতার মাজার। হু, সেই অযত্নে পড়ে থাকা ঢাকা গেট। যেটা থেকে বেরুলেই আমাদের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।

আজ আহসান মঞ্জিল যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সবার। একটা পরীক্ষাও ছিল। আমরা যখন দুষ্টরা আগে, ভদ্ররা পরে অডিটোরিয়ামে গিয়ে নিজেদের পছন্দমত জায়গা বেছে নিয়েছি, গম্ভীর মুখে উইকিপিডিয়া থেকে বন্ধন নিয়ে পড়াশুনা করছি, তখন মিলন এসে চেঁচাল, পরীক্ষাটা কাল লাঞ্চের পরে হবে। আমরা চিৎকার করলাম, কেউ হাতের নোট উপরে ছুঁড়ে দিলাম। হুরমুর করে বেরিয়ে উত্তেজিত স্বরে সবাই একসাথে কথা বলতে থাকল। সবাই একসাথে কথা বললে কিছু বোঝা যায়না। কিছুটা শান্ত হলে বোঝা গেল, সবাই আসলে আহসান মঞ্জিল যাবার কথা ভাবছে। শুধু ভাবছেই না, চেঁচিয়ে বলারও চেষ্টা করছে। ঠিক হল, সবাই যার যার মত প্রস্তুত হয়ে ঠিক বারোটায় চানখাঁরপুলে এসে দাঁড়াবে।

বাসার পথ ধরলাম। এসেই মাথায় হাত। ভুলে মেইন গেটের চাবিটা নেয়া হয়নি। সকালে যে ক্লাসে গিয়েই মীমকে বলেছিলাম, ছুটির সময় আমাকে যেন একটা চুলের ক্লিপ বা ওরকম কিছু দেয়, যেন সিসি ক্যামেরাকে আড়াল করে মেইন গেটের তালাটা সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুলে। সাততলায় চলে আসতে পারি। কিন্তু পরীক্ষার চাপে মীম ভালো করে বোঝেইনি আমি কী বলেছি। তো! দাঁড়িয়ে থাকতে হল অনেককাল। এরপর যখন একজন মহিলা বের হলেন বাড়ি থেকে, তখনই ঢোকা গেল। একটু বিশ্রাম করে ঝাল করে রাঁধা সাগরের মাছ দিয়ে পেটপুরে ভাত খেয়ে প্রবল ঘাম-বর্ষণ এর প্রস্ততিস্বরূপ সুগন্ধি স্প্রে কাপড়ে মেখে চললাম চানখাঁরপুলে। পথে অন্তরার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বারবার কল করেও যখন পাওয়া গেল না, বোঝা গেল সাজটা এখনো সে সেরে উঠতে পারেনি। মোড়ে গিয়ে দেখতে পেলাম, শ্রাবণ শ্রাবণের কড়া রোদে শরীরের সবটুকু জল পিঠের চামরার গ্রন্থি মারফত উগরে দিয়ে ভিজে চপচপে হয়ে রাগে মুখ লাল করে নিজের সাথেই গজরাচ্ছে। একটু আগে দোক্কা গাড়ী খুঁজতে গিয়ে সব ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখে গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এসেছে। ঘোড়ারা যে শুধু ঘাস খাচ্ছিল তা না, সহিস আর গাড়িগুলোও উধাও। এর মধ্যিখানে সবাইকে ফোন করতে করতে সে ক্লান্ত, এবং রাগে বিস্ফোরিত। আমি পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দিলাম,

বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭

জলমগ্ন

ছবিঃ সংগৃহীত

সরসর শব্দ তুলে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা। পেছন থেকে যে ছোকরাটা ভ্যানটাকে ঠেলছে, পানি তার কোমর ছুঁয়েছে। কোমরটা যে তার বেশ নিচুতে, তা মানতে অস্বস্তি নেই। হুঁ, আবদুল মিয়া যে খাটো, মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি, তা মানতে দোষ নেই। ভ্যান এক আজব বাহন এই শহরে। শীতের মরশুমে এরা লাগে বাড়ি পাল্টাতে, নতুন আসবাব ঘরে পৌঁছে দিতে। আর বর্ষার মরশুমে এরা জলের বাহন। জলের দু ধারে সারি সারি জেগে ওঠা ঘরবাড়িতে পৌঁছে দেয়া এই ভ্যানের কাজ। স্রোতহীন ঢেউ ওঠা শহরের রাস্তায় ছুটে বেড়ায় নানা কিসিমের বাহন। কোনটা যন্ত্রে চলে, কোনটা ঠেলে নিতে হয়। তবে সওয়ারির ভরসা যন্ত্রহীনগুলোতেই। সিএনজির গলুইয়ে পানি উঠে পরে, মাঝপথে সাপের মত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায়, তাতে কে বা উঠতে চায়? ভ্যান আর রিকশা, এই শহরের জলে-স্থলে ছুটে চলে অবিরাম। আর জল মাপার জন্য আজকাল কি আর সিন্দাবাদ আছে যে লগি ঠেলে চেঁচাবে, "এক বাও মেলেএএএ না, দেড় বাও মেলে না...!"

কেউ হোন্ডা, কেউ মাইক্রো নিয়ে নেমে পরে জলের একধার থেকে। কিন্তু এ সমুদ্রের ঠাই কোথায়, তার তো জানা নেই কারোই। একটু দূর যেতেই পানি উঠতে উঠতে যখন ইঞ্জিন ডোবে, তেলের ট্যাংক ছোঁয়, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে মেশিন নিশ্চুপ হয়, তখন চালকের দুঃসাহসী মন প্রথমবারের মত দমে যায়। মনে মনে ভাবে, মিসটেক হয়া গ্যালো। দূর স্বর্গলোক থেকে কবিগুরু ফিসফিস করে চালকের কানে কানে বলেন, জপো, এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা। কিন্তু চালকের মন বোঝে না। পরদিন সে অন্য রাস্তায় অন্য কোন খাদে পতিত হয়ে কবিগুরুর ফিসফিসানি শোনে। বছর ঘুরে আবার বর্ষা আসে, আবারও কবিগুরুর মন্ত্রধ্বনি কানে বাজে।

এ শহরের সবচেয়ে বিচক্ষণ সেই সব লোকজন, যারা বাসায় পৌঁছতে নেমে পড়েন গোড়ালিতক পানিতে, একটু পর সেটা বাড়ে। পথ এগিয়ে যায়, সেটা আরও বাড়ে। কারো বাড়ি পৌঁছতে সেটা হাঁটুজল হয়, কারো বাড়ির হদিস মেলে কোমরজলে। তাঁদেরকে যখন বাড়ির লোকজন উপহাস করে বলে, কয়টা টাকা বাঁচাতে এই এতখানি পানিতে নেমে পড়লি? মুখ গোমরা করে তারা উত্তর করে,

মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭

বৃষ্টি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। ঝিঁঝিঁ ডাকছে, ব্যাঙ ডাকছে, তবু সেটা নিস্তদ্ধতা ছিল। রাত্রির নিস্তদ্ধতা কোন নিশ্চুপ প্রকৃতিকে বোঝায় না। রাতের শব্দগুলো রাতের প্রাণ। এই নিস্তদ্ধতা কাটিয়ে দেয় বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি, কিংবা আলতো বৃষ্টি। বৃষ্টি আবার আলতো হয় কেমন করে, সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। বৃষ্টিও আলতো হয়। ঠিক ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নয়, কিন্তু জোরও নেই তেমন। আচ্ছা বৃষ্টি তবে কয় রকম? কঠিন প্রশ্ন। বৃষ্টির নানা রকমফের হয়। সেটা হয়তবা দর্শকের প্রাণের হাল হাকিকত দিয়ে ভাগ হতে পারে। যদিও বৃষ্টি শুধু দর্শন না, শ্রবণ, স্পর্শেও প্রবলভাবে সারা দেয়।

যখন বৃষ্টি শুরু হল, ব্যাঙদের আহ্লাদ বেড়ে গেল বহুগুন। স্বর প্রবল থেকে প্রবলতর হল। রাত্রির নিস্তদ্ধতা ঠিক তখনই ভেঙে পড়ল। তারমানে কি রাতের সাথে বৃষ্টির মিতালি নেই? আছে বৈকি! স্নিগ্ধতায় মিল আছে। প্রবল বৃষ্টি, আলতো বৃষ্টি সবই স্নিগ্ধ। আর রাত মানেই তো নিশ্চুপ স্নিগ্ধ একটা গল্প। ঝোড়ো বৃষ্টিও স্নিগ্ধ হয় বটে!

বৃষ্টি নিস্তদ্ধতা লুটে এত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তবে গ্লানির সাথে সখ্যতা গড়তে পারে না? বৃষ্টি, দুঃখ আর গ্লানিগুলোকে তুই নিবি?

শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

নরক যাত্রী



আমি একটা খুনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুনটা এ সপ্তাহে করার খুব ইচ্ছে। যে মানুষটাকে খুন করব, সে আমার বন্ধু, নাম সজল। আমরা ছোটবেলা থেকে এক পাড়ায় বড় হয়েছি। ওর বাবা এখন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। আমরা এক ব্যাটে ক্রিকেট খেলে, মারামারি করে, পালিয়ে ঘুরতে গিয়ে এতটা বড় হয়েছি। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হবার পর সব কেমন উল্টেপাল্টে গেল। আমি ইকোনমিক্স, সজল সোশায়োলজি। নির্বাচনের হৈচৈ শুরু হবার পর ওর পড়ায় মন উঠে গেল, আর বাবা রিটায়ার্ড করে ফেলায় পেনশনের টাকায় আমাদের চলছিল না, তাই আমাকে পরিশ্রম শুরু করতে হল। মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম, আর এখন আমি থার্ড ইয়ারে। এরমধ্যে দুবার ড্রপ দিয়ে সজল ফার্স্ট ইয়ারেই রয়ে গেছে। প্রথম ওকে বদলে যেতে দেখেছি নির্বাচনের আগের সপ্তাহে। এলাকার যেসব ছোকড়া এক প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়ালে দু ঘন্টা মিছিল কিংবা দু'শ পোস্টার মেরে আসত, তাদের সাথে ও দাঁড়িয়ে পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফুঁকছিল। আমরা যে আগে লুকিয়ে সিগারেট খাইনি, তা নয়। কিন্তু বড়রা হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, সবাই পাড়ার মুরুব্বি, তাঁদের সামনে! এবং একটু পর পাশের পাড়ার একটা মেয়ে যখন সাইকেল নিয়ে গেলো, তখন ওর সাথের পাঁচ-ছয়জন ছোকরা চেঁচিয়ে বাজে কথার ফুলঝুরি ছোটাতেই ও হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, এবং আমাকে দেখেই সজল হাঁক ছেড়েছিল, 'কিরে সাধুবাবা! হবে নাকি দুই টান?'

সেই থেকে ওকে ঐ দলেই দেখা যায়। অথচ একটা সময় আমাদের খুব কম্পিটিশন ছিল পড়াশুনায়। ওর সাথে বহু সিনেমা দেখতে গেছি, ওর পয়সায়। কিন্তু ওর বাবা মেয়র হবার পরে ওর সাথে তেমন কথাই হয়নি আর কখনো আমার। প্রথম দিকটায় দেখা হলে কুশল বিনিময়টা হত, পরে সেটাও বন্ধ হয়। আমি সরে আসি, তেমন না। ওরও আগ্রহ ছিল না আমার মত 'সাধুবাবা'র সাথে মেশার।

হঠাৎ করে খুন করবার প্রয়োজনটা হয়ে পড়েছে। বাবা রিটায়ার করার পর আমাকে টিউশনি করাতে হয়। আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে, নাম পড়শি। শুকনো পাতলা দেহ, লম্বাটে মুখের কোনে একটা বাঁকা হাসি, কাজলটানা চোখ, লম্বা চুল- এই হল পড়শি, যাকে দেখলেই আমার বুকের কোনে চিনচিনে ব্যাথা হয় কয়েক বছর ধরে। কিন্তু কিছু বলবার সাহস আমার নেই। এবার ইন্টারমিডিয়েট-এ ভর্তি হল ও। ওকেই পড়াচ্ছি। বাসার বাজার থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল, কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া, সবকিছু আমারই করতে হয়। বোনটাকে পড়ানোও একটা কাজ। এর মধ্যে নিজের পড়াশুনার চাপ তো আছেই। পড়শিকে পড়ানো আমার দিনের একমাত্র ভালো সময়। সপ্তাহে তিনদিন ওকে পড়াতে হয়। সন্ধ্যার পর যখন যাই, প্রতিবারই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পড়াতে গিয়ে আমি চুপ হয়ে যাই, একমনে চেয়ে থাকি। প্রতিবারই পড়শি হেসে বলে, চোখ গেলে দেব কিন্তু! পরের দিকে কোত্থেকে যেন একটা খেজুর কাঁটা এনে রেখে দিয়েছিল পড়ার টেবিলে।

দুই.
ছয়টায় আমি পড়াতে যাই, পড়শির কলেজ থেকে আসবার কথা এর অনেক আগেই। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম ও আসেনি। উদ্বিগ্ন হয়ে ওর মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর বাবা তখনো ফেরেননি অফিস থেকে। ব্যাংকের ছোট চাকরি তাঁর। আমি ভেতরে বসলাম। আমারও কিছুটা দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কাজের মেয়েটা বিস্কুট আর রং চা দিয়ে গেল। আমি একটু চুমুক দিয়ে রাখতেই পড়শির মায়ের হুংকার শুনতে পেলাম। প্রচণ্ড এক চড় কষিয়েছেন তিনি এক ঘন্টা দেরি করে আসা মেয়েকে। আমি ছুটে গেলাম সামনের ঘরে চাচিকে থামাতে। কিন্তু তিনিই তখন আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। পড়শির মুখ পাথরের মত শক্ত, ঠাণ্ডা চাহনি, ঠোটের কোনে হাসির বদলে জমাট রক্ত, চুল অবিন্যাস্ত, এবং একটু খুড়িয়ে ও দরজার দিকেই আসছিল। আমার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসল, পড়শি! একবার আমার চোখের দিকে তাকাল, শ্লেষমাখা সেই চাহনিতে আমার বুক কেঁপে উঠল। ঠিক আমার পাশে পৌঁছবার পর খুব আস্তে করে বলল, 'সজল'। এবং আমাকে পাশ কাটাবার পর আবার পেছনে তাকাল, 'আপনার বন্ধু'। এবারে স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখতে পেলাম সেই চোখে। এবং সেই মূহুর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুন করতে হবে আমাকে একটা। 

ওর বাবা যখন বাসায় এলেন, ততক্ষণে ওর মায়ের কান্না বন্ধ হয়েছে। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে। পড়শি বাড়ির পেছন দিকটায় একটা চেয়ার পেতে বসে আছে একলা। আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম চুপ করে। চাচা এলেন, জানলেন, এবং আমার হাত চেপে ধরে বললেন, 'বাবা! কাউকে বোলো না।' ফেরার আগে প্রচণ্ড আশঙ্কা নিয়ে গেলাম পড়শির কাছে। মাথায় হাত রাখতে গিয়েও পারলাম না। পেছন থেকে বললাম, 'কথা দাও, বেঁচে থাকবে।' আলতো করে মাথা নাড়ল ও। আমি অবাক হলাম, এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলাম।

কিন্তু পরদিন জানলাম, পাড়ার ছোকরারা সবাই জানে এই গল্প। তিনজন ছিল ওরা। মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে অনেকগুলো দোকান। এরপর একটা বাড়ির পেছন দিককার দেয়াল, এবং সেটার ওপাশে একটা স্টুডিও। এটার মালিক মেয়রের পরিবার। সজলের আড্ডা দেবার একটা জায়গা এই স্টুডিও। তার সামনে দিয়ে আসতে হয় পড়শিকে। 

পুলিশ কোন মামলা নিল না। অদ্ভুত অশ্লীল সব প্রশ্ন ছুড়ছিল ওসি আমার এবং ওর বাবার সামনেই পড়শিকে। মুখ শক্ত করে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল পড়শি। একটা সময়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওসি শব্দ করে হেসে ফেলল। লম্বা সে হাসি থামিয়ে সে বলল, এসব কিছুই হয়নি। শুধু শুধু তোমরা গল্প ফাঁদতেছ ক্যান

বোরকা পরা পড়শিকে নিয়ে আমরা যখন থানা থেকে বের হয়েছি, তখন ওর বাবা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। একটা কুকুর শুয়ে ছিল সামনে, আমি শরীরের সব শক্তি জুগিয়ে একটা লাথি কষালাম। আৎকে উঠে কুকুরটা লাফিয়ে সরে গেল। একটু দূরে যেয়েই ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কাছে আসবার সাহস নেই যেন। লাথি মারার সাথে সাথে পড়শি শুধু বলল, 'আকাশ ভাই!

আমার খুনের ইচ্ছা আরও প্রবল হল।

তিন.
আমি ঠিক করেছি খুনটা ওই স্টুডিওতে করব। স্টুডিওর লোক চলে যায় সন্ধ্যার সাথে সাথে। প্রায় দিনই ওখানে সজল বসে, আটটা বাজতে অন্য বন্ধুরা আসে। আমার সময় ছয়টা থেকে আটটা। আমাকে আসতে হবে উল্টো দিক দিয়ে। ওখানকার রাস্তায় আলো নেই। এসে সোজা স্টুডিওতে ঢুকতে হবে। খুনটা করে বেরিয়ে আসব। আমার কাছে বাজারের ব্যাগ থাকবে। সেটাতে না, ছুরিটা থাকবে আমার কোমরে। কাগজ পেঁচিয়ে। কোরবানির সময়ে এই ছুরিটা ব্যবহার হয়। বাসায় কেউ না থাকা অবস্থায় আমি শীল ঘষে ছুরিটা ধার দিয়েছি। ওটা আছে আমার বিছানার নিচে। 

বাজারের ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যায় বের হলাম। প্রায়ই আমি বাজারটা বিকেলে করি। পটল, ঝিঙে, পাঙ্গাশ মাছ কিনে ফেরার পথে আমি দেখেশুনে ঢুকে পড়লাম দি নিউ সুচিত্রা স্টুডিওতে। কেউ আমাকে দেখেনি, এবং সজল একলা ছিল এখানে। আমি বললাম, চার কপি পাসপোর্ট, এক্ষুনি দিতে পারবি?
ওর আধখাওয়া সিগারেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'ইকোনমিক্স ছেড়ে কেরানিগিরি ধরবি?'
'না। একটা সোশ্যাল সোসাইটিতে এপ্লাই করব' উত্তেজনা চেপে বললাম। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে যোগ করলাম, 'ভেতরে আয় তো!'
আমি ভেতরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে কোমর থেকে ছুরিটা বের করে পেঁচানো কাগজ ছাড়ালাম। সজল সামনে থেকে বলল, 'তোর সাজ হল?'
'হয়েছে'। গলার স্বর কেপে উঠল যেন একটু।

প্রথমে যখন ছুরিটা ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, মূহুর্তে ওর চোখ বিস্ফোরিত হল। সজল এর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওকে মারা হচ্ছে। এবং দ্বিতীয়বার ছুরি চালাবার আগেই আকুতি করে উঠল, 'জানে মারিস না ভাই'। ভাই ডাকটা যেন আমাকে থমকে দিল। ছেলেবেলায় ভাই পাতিয়েছিলাম আমরা। আমি হিংস্র স্বরে বললাম, 'পুলিশে সব স্বীকার করবি আজকেই?' হুমড়ি খেয়ে পরল ও কার্পেট বিছানো মেঝেতে। কার্পেট লাল হয়ে যাচ্ছিল রক্তে। আবারো কাতর স্বরে বলল, 'জানে মারিস না। তোর পায়ে পরি।' এরপর হড়বড় করে বলল, 'স্বীকার করব আমি। আজকেই স্বীকার করব সব!' একই কথা বারবার বলতে লাগল সজল। বাঁচবার প্রচণ্ড আকুতি শুনতে পেলাম আমি ওর কণ্ঠে। কিন্তু ও একজনের বাঁচবার সাধ নিয়ে খুব সহজে ফুর্তি করেছে, গত সপ্তাহে, এখানেই। 

হঠাৎ করে আমার সব উত্তেজনা পানি হয়ে গেল। কোমল স্বরে আমি বললাম, 'আমি যদি তোর একটা চোখ উপড়ে নেই?' ওর তখন তেমন হিতাহিত জ্ঞান নেই। কাতরে বলে উঠল, 'জানে মারিস না। দুইটা চোখ নে। জানে মারিস না। জানে...' আমার তেমন কানে ঢুকল না। আমি সত্যি ছুরিটা ওর একটা চোখে ঢুকিয়ে দিলাম।  শেষবারের মত 'জানে মারিস না' বলে ও জ্ঞান হারাল। দুটো ক্ষত করেছি আমি। একটা চোখ নষ্ট করেছি, আর পেট। তেমন কিছুই না, আমার মনে হল। এক্ষুনি ওকে হাসপাতালে নেয়া দরকার, মনে মনে ভাবলাম আমি। 

বের হবার আগে হাতের রগগুলো কেটে দিলাম। ওর দেহের শেষ ঝাঁকুনিটা দেখে আমি বুঝলাম, আমি একটা খুনি। 

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক


Copyright © 2015 Tony Fed


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। এটা শুধু যে সময় নষ্ট করে তা না। অভ্যাস, দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সক্রিয়তা অনেকটা কমিয়ে দেয়। সেজন্য আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই। সামাজিক যোগাযোগের অন্য অনেক সাইটেই একাউন্ট আছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের বাংলাদেশে তেমন কেউ চালায় না বলে তাতে এডিক্টেড হতে পারিনি। যখন সবাই সেগুলো (টুইটার, গুগল প্লাস এসব) চালাবে, তখন ছেড়ে দেব। 

একটা বন্ধু আমাকে বলত, তুই বড় নার্সিসিস্ট! সবসময় নিজের কথা শোনাতে চাস। সত্যি বটে। কিন্তু কেন এটা আমার কাছে কোন সমস্যা লাগে না, এবং নার্সিসিস্টই রয়ে গেছি, তার ব্যাখ্যা আমার আছে। তার আগে বলি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর কথা।

মানুষ নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে ভালোবাসে। সমাজবিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, মোটামুটি দিনের চল্লিশ শতাংশ কথা আমরা নিজেদের সম্বন্ধে বলি। এর কারণটাও মজার। ডোপামিন! আমরা জানি, সেক্স করবার সময়, চকলেট খাবার সময় এই হরমোনটা নিঃসরণ হয় বলে আমাদের তখন অত ভালো লাগে। নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলবার সময়ও মস্তিষ্কের ভালোলাগার কেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক সেক্সের মত! তাই এত আনন্দ!

বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭

জীবন



এক
সজীব মিয়ার জীবনে আজ দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছে। সে বেশ উত্তেজিত। রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গল, এবং সে দেখল একটা মোটরসাইকেল তার পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা লোক কাতরাচ্ছে তার পাশেই। সজীব মিয়ার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল, এবং ক্ষুধাটা উবে গেল, যখন মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পরা লোকটার ব্যাগ খুলে দেখতে পেল ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। সে ব্যাগটা ধীরেসুস্থে চেইন আটকে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে যে জামা-প্যান্ট, একটা পুটুলিতে কিছু জিনিস, একটা ছেড়া তেল চিটিচিটে কাঁথা আর একটা পিভিসি ব্যানার- সেসব গুটিয়ে হেঁটে হেঁটে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিকে চলে গেল। একসিডেন্ট হয়েছে জহির রায়হান রোডে যেখানটায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার উঠে গেছে তার পাশে। সে তখন ঘুমিয়েছিল বার্ন ইউনিটের ধার ঘেষে ফুটপাতে। এখানে এমনি প্রতিদিন বেশ কিছু মানুষ ঘুমায়। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় সবাই উঠে মাথার ওপরের ঠাইয়ের খোঁজে চলে গেছে কোথাও। সজীব মিয়ার ঘুম পেয়েছে বৃষ্টি থামবার পরে। তাই এই জায়গাটা একদম খালি পেয়ে গেছে। 

সজীব মিয়ার বয়স হবে সাতাশ কিংবা আটাশ। এককালে তার চামড়া তামাটে রঙয়ের হয়তবা ছিল, কিন্তু এখন একদম নেই। রোদে পুড়ে চেহারা হয়েছে কুচকুচে কালো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে, গোঁফ আছে। নানারকম নেশার ভারে তার শরীর দাঁড়িয়েছে কাঠির মতন, লম্বাটে মুখ, চিবুকের হাড় স্পষ্ট।  হাড় জিরজিরে শরীরে জটাধরা উষ্কোখুষ্কো চুলের সাথে কপালের শিরাগুলোকে মনে হয় বলিরেখার মত। শরীর তার সামনের দিকে একটু বেঁকে গেছে। এখানকার আরো অনেক নেশাখোরের মত তারও জীবনে নির্দিষ্ট কোন ভাবনা কিংবা উদ্দ্যেশ্য নেই। কিন্তু হঠাৎ করে এতগুলো টাকা তার হাতে চলে আসায় সে কিছুটা বিচলিত। তার যে প্রয়োজন ছিল না টাকার, তা নয়। কিন্তু প্রতিদিন এটা সেটা কুড়িয়ে, এদিক সেদিকে ছুটকো চুরি করে যা হত, তা দিয়ে আধপেট ভাত আর নেশা হলেই হল।

রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

মা

এই পৃথিবীতে সবার একটা করে মা আছে। ঐ দেবদারু গাছ, উঁইপোকা, কিংবা আমার- সবারই আছে। এই সম্পর্কটাকে স্রষ্টার দান কিংবা বিবর্তনের ফল, যেভাবে যে বলুক, সেটা একটা ভালোবাসার সম্পর্ক।

আজ নিউট্রিশন ক্লাসে লেকচার ছিল প্রেগন্যান্সি নিয়ে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার জেনে বেশ খানিকক্ষণ থমকে ছিলাম। স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে ক্যালসিয়াম থাকে, সেটা এখন সবে জানে। মায়ের দুধেও ক্যালসিয়াম থাকে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ মায়েরা তো সেই পরিমাণে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার পান না, তবে ক্যালসিয়াম আসে কোত্থেকে? উত্তরটা চমকে যাবার মত। হাড্ডির একটা মূল উপাদান ক্যালসিয়াম, জানি সবে। মায়ের হাড্ডির কোষগুলো ভেঙ্গে ক্যালসিয়াম যায় দুগ্ধগ্রন্থিতে, সেই থেকে বাচ্চার ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন মেটে। একজন মা যখন ক্যালসিয়াম পাচ্ছেন না ডায়েটে, তখন তাঁর হাড্ডি ভেঙ্গে (আক্ষরিক অর্থেই) আমরা বেঁচে থাকি? 

আমার মায়ের জন্য ভালোবাসা। সকল মায়ের প্রতি ভালোবাসা। 
এবং শ্রদ্ধা (আজকাল এর বড় অভাব)।

শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭

আ জার্নি টু বোলপুর



এক.
আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রিন্ট করা একটা পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ছাদে। ওপাশে প্রীতি খেলছে আর দুটো ছোকরার সাথে। আমার সেদিকে মন নেই। আমি অপেক্ষা করছি মিমির জন্য। বলেছি সোজা ওপরে চলে আসতে, ক্লাস শেষেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের সহকারী অধ্যাপক সে। আমি এই মূহুর্তে অকর্মার মত ঘরে বসে আছি। ফুলার রোডে শিক্ষক ভবনে থাকছি আমরা প্রীতির জন্মের পর থেকেই। মিমি ছাদে ঢুকল, ধীর-স্থির ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, দারুণ খবরটা কি শুনি
আমি ভাবলাম, খানিকটা রহস্য না করে পারা যায় না। হাসলাম। ছেলেবেলা থেকে মিমির যে একটাই অভ্যাস, গুনগুন করে বলা, 'অসভ্য!' সেটা বলে ও আমার হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিল। একটুক্ষণ চোখ বুলিয়ে হাসল, 'আবেদন করবে?'
কাগজটা ছিল একটা চাকরির বিজ্ঞাপন। বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে। ওদের এগ্রো কেমিস্ট্রি বিভাগে দুজন অধ্যাপক নিচ্ছে, মূলত গবেষণার কাজে। 'বেশ তো, করো আবেদন!' এটুকু বলেই ও চেঁচাল, রাণী... রাণী... প্রীতি দৌড়ে এল। মায়ের কোলে ঝপিয়ে পড়ল। আমাদের একমাত্র মেয়ে এই প্রীতিলতা। বয়স চার এর একটু বেশি। বড় দুরন্ত হয়েছে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর নামে রাখা ওর নাম। এই নাম নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি বাড়িতে।

বুধবার, ১০ মে, ২০১৭

শুয়োর কা বাচ্চা


এক.
সালেহ মিয়ার দোকানটা ছোট। চায়ের দোকান সেটা। চা-রুটি-কলা বেচে কুলায় না। তাই সুঁই, কলম, চুলের খোপা জাতীয় অনেক কিছুই উঠিয়েছেন তিনি। তবু সেটা মুদি দোকান হয়ে উঠতে পারেনি। বসতভিটের সামনে টিনের ছোট ঘর তুলে বানিয়েছেন দোকানটা। তবে চারটে বাড়ি পরেই মণ্ডল ব্যাপারীর মুদি দোকান। সব রসদ সেখানেই আছে। অল্প পুঁজিতে সালেহ মিয়ার যা ওঠানোর সাধ্য, তাতে মানুষ টানবে না। অগত্যা এটুকু দিয়েই চলতে হয়। তবে পাশেই প্রাইমারি স্কুল, ওপাশে ব্রাক স্কুল। ছেলেমেয়েরা এক টাকা-দুই টাকা নিয়ে দৌড়ে আসে প্রায়ই। ক্লাসের মাঝে, টিফিন পিরিয়ডে, এমনকি ক্লাস শুরুর আগেও ভীড় লেগে থাকে ছেলেপেলের। তবে তাতে আর কত আয়? বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই দিনে পায় দুই টাকা, খুব অল্প কজনই পাঁচ টাকা। অনেকে কখনোই বাড়ি থেকে টিফিন খরচ বলে কিছু পায় না। বাড়িটাও ছোট। যা কিছু চাষ হয়, ছোট পুকুরে যা মাছ হয়, তা খেয়ে পরে বেচার উপায় নেই। 

সালেহ মিয়ার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোদে পোড়া মুখ, ভ্রু ঘন, কপালে এর মধ্যেই ভাজ পড়েছে। লম্বাটে মুখে সবসময় যেন রাজ্যের ক্লান্তি লেগে আছে। তিন মেয়ে তার। বড়টা ক্লাস এইটে পড়ে, মাঝেরটা ব্রাক স্কুলে এবার যাওয়া শুরু করল, আর ছোটটার বয়স দুই বছর। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু নেই বহু বছর হল। টানাটানি নেই, এমন কখনো যায় না। এক টুকরো জমিও নেই যে ফসল উঠলে মুখে হাসি ফুটবে। একটা গাভীর জন্য বড় সাধ। মেয়েগুলো বছরে একটা দিনও দুধ খেতে পায় না। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ দেবার কথা বলে যে আপারা বাড়ীতে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে যায় প্রায়ই, তাদের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারেন না তিনি। সুদের বোঝা বড় ভারী। ও পাড়ার এক বউ নিয়েছিল ঋণ। গরুই কিনেছিল। সাপে কামড়াল গরুটাকে, সেই সুদ সামলাতে এক টুকরো জমিই বেচতে হয়েছিল ওদের। 

বড় মেয়েটার নাম কমলা। তরতর করে বেড়ে উঠছে সে। এরমধ্যেই গ্রামের ছেলেরা আড়চোখে তাকায়। বাপের মত লম্বাটে মুখই পেয়েছে মেয়েটা। চিবুক যেন অনেকটা সুঁচালো। চোখগুলো বড় বড়, দেখলে মায়া পড়ে যায়। বিয়ের কত প্রস্তাব আসে। কিন্তু সালেহ মিয়া ফিরিয়ে

শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

স্বস্তি



অয়ন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, কেমন করে হল এসব? হরতালে সামনে এগিয়ে বড় একটা ইটের টুকরো ছুড়ে মেরেছিল পুলিশের দিকে, এবং কি সৌভাগ্য! এক পুলিশের হেলমেট ছিল না মুখে, ইটটা গিয়ে তার মুখেই লেগেছিল। ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে এলো, নাকটাও গেল বোধহয় বেচারার। ও হঠাৎ বিচলিত বোধ করছিল। সাধারণত বাম দলগুলো হরতালে নিরাপদ দুরুত্বে থেকে ইট-পাটকেল ছোড়ে, কিন্তু কেউ কারো ধরাছোঁয়ার ভেতরে যায় না। কাউকে আঘাত করার মনোবাঞ্ছা পুলিশের নেই, বিপ্লবিদেরও নেই। এর মাঝখানে একদম পাশে এক কাঁদানে গ্যাসের শেল পরায় কিছুক্ষণ মুখ থুবড়ে পরে ওকে খক খক করে কাশতে হয়েছিলো। অন্য একজন মুখের সামনে লাইটার জ্বেলে খানিকটা সুস্থ করে দেয়। সেটা সামলে ওঠার পরই অনেক বেশি রাগ নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল অয়ন। গুলি খাওয়ার আগে ফিরেও আসতে পেরেছিল আড়ালে। কিন্তু জলপাই রঙের পাঞ্জাবিটা। সেটা পুলিশদের চোখে আটকে ছিল। দুপুরের আগে আগে হঠাৎ ধাওয়া করে এসে ধরে ফেলেছিল। রাস্তার ওপরে রাইফেলের বাটের আঘাতে জ্ঞান হারিয়েছিল অয়ন শীঘ্রই। তবে কাল ইউটিউবে সেটার ভিডিও দেখে থমকে গিয়েছিল ও। জ্ঞান হারানোর পরে আট-দশজন পুলিশ ওকে বেধড়ক পিটিয়েছে। কোন এক পথচারীর মোবাইলে সে দৃশ্য ধারণ না হলেও হয়ত হত। অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ ওকে হাসপাতালে দিতে চায়নি, চেয়েছিল চৌদ্দ শিকে ভরতে। কিন্তু পথচারীদের বাধায় ওকে আনা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। পরদিন খোঁজ-টোজ নিয়ে পুলিশ যখন বুঝতে পেরেছে, কোন দলেই নেই ও, তখন অবাক হয়েছে, এবং মামলা না করেই চলে গেছে। এসব ইস্যুতে দলের লোক ছাড়া ধরে লাভ নেই। ছাত্রদের দু-তিনটে বাম সংগঠনও ঘুরঘুর করে চলে গেছে। দলের ফায়দা নেই, নিউজ ভ্যালু নেই এখন আর, তো হবে কী পাশে থেকে

এসব তিনদিন আগেকার কথা। এখন সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা, কিন্তু হাড়গুলো সব অক্ষত। পুলিশ কি আজকাল এনাটমি পড়ে? নিখুঁতভাবে কেমন করে পেটায় ঐ হুড়োহুড়ির মধ্যে? মাথায় আর উরুতে ছাড়া কোথাও ব্যান্ডেজ নেই। ফুরফুরে মেজাজে সোভিয়েতভ কৌতুকভ পড়ছিল। এসময় মিমি এল। মুখ থমথমে, ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বসল নিজে। এই তিনদিনে মিমি আসতে পারত, কিন্তু কেন যেন আসেনি। হয়তবা এই অবস্থা দেখতে চাচ্ছিল না। ফুরফুরে মেজাজ উবে গেল ওর মুখে ঝড় দেখে। নিঃশব্দতা ভাঙল একটু পর।
-না গেলে কী হত?
-গ্যাসের দাম বেড়ে যেত।
হেসে ফেলল মিমি। এমন সরল উত্তর আশা করেনি। মিমির মুখে মেঘ জমলেই আয়নের মুখে খই ফোটে। নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে সে। কিন্তু আজ এমন সোজাসাপ্টা কৌতুক! ব্যাগ থেকে একটা কাগজের ঠোঙ্গা বের করে দেয় মিমি। রোগী দেখতে এলে ফল-হরলিক্স নিয়ে আসতে হয়,

রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল



এক.
ক্লাস শেষ হল, অমনি জারিনের মেসেজ। কার্জনে এসো, লনে। গিয়ে দেখলাম ওর চুল ভেজা। একদম চুপুচুপে। বললাম, ভেজা কেন?
-কেঁদেছি।
-তবে চুল কেন?
-মুখ ধুতে গিয়ে।

আমরা মাটিতে বসলাম। এল বিয়ের কথা। বলল, কাল এলে না কেন?
-পেট ব্যাথা করছিল।
-মগবাজারে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-কাজী অফিসের সামনে?
-বলো কী! যা রোদ।

তখন ফোনে রাইমার মেসেজ এল, "ল্যাব করছ তো?" যেতে হবে ল্যাবে। পথে কয়েকটা কাঠগোলাপ কুড়িয়ে নিলাম ত্রিপল-ই এর সামনে থেকে। তখন সোহান নামের পিচ্চি ফুলওয়ালা পাশ থেকে যেতে যেতে বলল, 'যেইডা মাগনা পাওয়া যায়, সেইডাই নিবেন!' এই একটু আগেও ছেলেটা আমাকে জ্বালাতন করেছে, একটা গোলাপের জন্য। কিন্তু শুকনোগুলোও চায় দশ টাকা। ল্যাবে গিয়ে দিলাম রাইমাকে, ও সেটা ব্যাগে রাখল, সাথে বলল, 'খাবার আনলেই তো হত!'

এই আমার দুই প্রেমিকা। আমরা বিয়ে করছি। আমি এবং রাইমা, আমি এবং জারিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, দুজন শিক্ষার্থী বিয়ে করে ফেললে নাকি তারা থাকতে পারে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। হলে চল্লিশ জনের গণরুম দেখে আমি ক্লান্ত। ওখানে থাকা যায় নাকি? আমার শখ, দুটি বিয়ে করে দুটি রুম নেব, একরুমে থাকবে দুই সতিন (সুফিয়া কামালে রাইমার রুম নম্বরও যে ২০৩!), অন্য রুমে আমি একা। কারণ গণরুমে আছে ছারপোকার উৎপাত! তবে শ্রাবণ বলে, 'এখানে ছারপোকা, ওখানে উকুন। আপনি কোনটা চান?'

আগামী সপ্তাহে, সোমবার বিকেলে বিয়ে করব আমি আর রাইমা। এই বুধবার সকালে আমাদের ব্যাচেলর জীবনে শেষ ডেট। ক্লাসটা মিস দিতে হবে, তারচেয়ে কষ্টের,

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

আবার তুমি সাহসী হও

Image result for only thing is to fear
"...আর আজ কিন্তু এসব নিয়ে আমি কাঁদিনি।  বললাম না আমি সাহসী হয়েছি অনেক।
আমি এজন্য আগে ভালবাসতে ভয় পেতাম ..."


সাহস কী? সাহস কি এই তৈরী হয়, এই উবে যায়? তোমার সাহস কি আবার উবে গেছে? এই যে দিনের পর দিন দুঃখে থাকতে, কষ্ট হত না? সেসব থেকে কি একটাবারও বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হয়নি? সাহসের দরকার ছিল, এইটুকু তোমার সাহস? যেটা এক সপ্তাহ পর উবে যায়

ভাষা, ভালোবাসা





আমার নানারকম স্বপ্ন আছে। সেসব কাজ করে নানাভাবে। শখের বশে স্বপ্ন বুনি আমি, এরপর ছুটি তার পেছনে। তেমনি কোন একদিন মনে হয়েছিল ভাষা শিখব। অনেক অনেক ভাষা শেখার ইচ্ছা তখন দানা বেঁধেছিলো। কেন ভাষা শিখব আমি জানতাম না তখন, কিংবা এখনো। একেক সময় একেক ভাষার কথা ভাবি, হয়ে ওঠে না শেখা। 

জন্মের পর থেকে শিখেছি বাংলা। পড়তে আর লিখতে শিখেছি। বলতে পারিও বেশ। কারণ এটা আমার মাতৃভাষা। এরপর আর অনেক ভাষা শিখতে হবে, তখন জানতাম না। তবে সেই শৈশবে অক্ষর চেনার পর নিজে নিজে উচ্চারণ করে পড়তে, লিখতে শিখে গিয়েছিলাম আর দুটো ভাষা। ইংরেজি আর আরবি। অনেক পরে এসে হয়ত সেটা কাজে দিয়েছে, অন্য ভাষা শেখার সাহস যুগিয়েছে মন নিজেকে। আরেকটু পরের বয়সে ঊর্দু অক্ষরটা চিনতাম, লিখতে পারতাম। পড়তে কষ্ট হত, কারণ ঊর্দূর ফন্টগুলোকে আমার মনে হত আরবির বাজে হাতের লেখা সংস্করণ। এসব গল্প বয়স আট হবার আগের।

আমার কাছে আমার স্বপ্ন বড়, তাই মূল গল্প সেটাই, যেখানে স্বপ্নের কথা শুরু। একটু বয়সে যখন অনেক বই পড়লাম তখন ভাবলাম ভাষা শিখতে হবে আমাকে। শিখতেই হবে। ইচ্ছে হল তাই শিখতে হবে। কিংবা তখন যত বই অনুবাদ পড়তাম, সেগুলো আসল ভাষায় পড়তে ইচ্ছে হত। আর আগ্রহ ছিল প্রাচীন লিপির প্রতি। অসুস্থ থাকতাম অনেক বেশি, একটা সময়ে যেতাম ঢাকা মেডিকেলে। সেসময়ে মায়ের সাথে দুটো জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস ছিল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে। জাতীয় জাদুঘর, কিংবা পাবলিক লাইব্রেরী (শিশু পাঠকক্ষ, যেটার নাম সম্ভবত সুফিয়া কামালের নামে)। জাদুঘরে অনেক সময় নিয়ে দেখতাম বাংলা লিপির বিবর্তন। বুঝতে চেষ্টা করতাম কেমন করে শেখা সম্ভব। কিন্তু যত শিলালিপি সংরক্ষিত থাকত, তার কিছুই ঐ বর্ণ ব্যবহার করে লেখা না। সব ফার্সী, পর্তুগিজ, কিংবা আরো প্রাচীন কিছুতে লেখা। সেসব আর বোঝা হত না। 

শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে


রাতে, যখন প্রজাপতি তারাটা ডুবে যায়, তখন আমার রাত শুরু হয়। তার আগ পর্যন্ত মানতে কষ্ট হয়, আমি বেঁচে আছি। নিজেকে অপমান করতে ইচ্ছে হয়। এসব খেয়াল। প্রয়োজন নেই এসবের। আমার প্রয়োজন স্বেচ্ছাচারী হয়ে বেঁচে থাকা। স্বেচ্ছাচারিতা আমাকে আনন্দ দেয় না, দুঃখ দেয়। তবে সেটা আমাকে আর সবার সাথে তাদের মত হয়ে মিশতে সাহায্য করে। এমন করে দেয়, যাতে কিছু কাছের মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে বলতে পারে, "কটা দিন আগেও তুই অনেকটা ভালো ছিলি। এখন কেমন যেন হয়ে গেছিস।" এই যে কয়টা দিন আগের গল্প, সেটা চলছে, এবং চলতে থাকবে অনেকক্ষণ, অনেকটা বছর ধরে, বারবার। নানা জনের কাছ থেকে নানাভাবে এই বাক্যটা শুনতে শুনতেও অভ্যস্ত হতে পারিনি। অস্বস্তি নিয়ে বারবার শুনছি, শুনে যাচ্ছি।
এই আকাশে আমার কি মুক্তি আদৌ আছে? আমার আকাশগুলো সবসময়ে ঝাপসা হয়ে আসে এসবে, এসব দুঃখে। আমি কোনগুলোকে আলো বলব? কোন আলো তো কোথাও সেকেলে, কোথাও অন্ধকার। আলোর খোঁজ তবে কেমন করে করতে হয়? আমাকে জানতে হবে।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

দুঃখ-হিংসা-বেদনা

প্রেম শব্দটা সত্যি গোলমেলে। ঠিক কতটুকুকে আমরা প্রেম বলব, কতটুকুকে ভালোবাসা বলব, তার কোন মাপ নেই। আর সেই মাপের প্যাচের অভাবেই সবকিছুর সীমানা ওভারল্যাপিং করে বসে আছে। আমরা সেই সীমানার খোঁজে আকুল হই। বন্ধুত্ব আর প্রেমের ব্যাপারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমরা ছাঁচে বাধতে চাই, আলাদা করতে চাই। কিন্তু এটা কতটা আলাদা? ফ্রয়েডিয়ান সাইকোলজির যে অংশগুলো নিয়ে আমরা কৌতুক করে থাকি, সে অংশগুলো আমার মানতে ইচ্ছে করে। এগুলো আলাদা করা খুব কঠিন।

হিংসা দিয়ে হয়ত বোঝা যাবে। পছন্দের মানুষকে অন্য কারো সাথে প্রেমালাপে মত্ত বা সেরকম কিছু দেখলে বুক কষ্টে ফেটে যায়। এখানে ফ্রয়েড একদম ঠিক। এই যে এমা ওয়াটসন, রুপার্ট গ্রিনকে যে দৃশ্যে চুমু খায়, আমার সত্যি বুকে ব্যাথা করছিল। কাউকে কারো সাথে দুষ্টুমির ফ্ল্যার্ট করতে দেখলেও ইচ্ছে হয় চুবিয়ে মারি ছেলেটাকে।

শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭

সিরিঞ্জ


'হ্যালো রুদ্র!', ফোনের ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর।
রুদ্রের মনে পড়ে যায় অনেক পুরনো একটা বাক্য। 'তুমিইতো রুদ্র, যে দৌড়াতে পারে'। একজনের পরিচয় হিসেবে দৌড়াতে পারা বেশ অস্বস্তিকর। রুদ্রের একটা পদক আছে জাতীয় স্প্রিন্টে। তাই বলে দৌড়াতে পারে- এমন করে অপরিচিত একটা মেয়ে বলে বসলে বিরক্ত হবার কথা তার। কিন্তু রুদ্র বিরক্ত হতে পারেনি সেদিন। তবে আজ সন্ধ্যার একটু পরে ব্যাচেলর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়া সেই পুরনো কণ্ঠস্বর কিছুটা বিরক্তি জাগায়। রুদ্র ছোট্ট করে উত্তর করে, 'বলছি'। ওপাশ থেকে টেনে টেনে কণ্ঠস্বর বলে, 'আমি মিলি'। মিলির পরিচয় ঠিক এখানে শুরু নয়। ফিরতে হবে সেই দিনে। সেদিনও একটা কণ্ঠস্বর ছিল এই মিলি। পেছন থেকে বলেছিল, 'তুমিইতো রুদ্র, যে...'। সেটা ছিল বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র উৎসব, পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান মিলনায়তনে। চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্র, আর পেছন থেকে ডাক শুনেছিল মিলির। আজ যেমন 'চিনেছি' বলার আগে বিরক্তি কাটাতে রুদ্র একটু সময় নেয়, সেদিনও এরকম সময় নিয়েছিল। কৌতূহল কাটাতে। এরপর ধীরে ধীরে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, 'হ্যাঁ। এবং আমি হামাগুড়ি দিতেও জানি'

'মার্কস লোকটা কেমন?' ফোনের ওপাশ থেকে কথা শুরু হয়।

বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭

নারী দিবসঃ আমার শ্রদ্ধা আমার ভাবনা


আমার ভাবির যেদিন মেয়ে হয়, সেদিনকার কথা। আমি শুনলাম কথাটা, অনেক দূরে বসে, এবং ধ্বক করে উঠল বুক। মেয়ে! আবারো সেই ভোগান্তি!
আমাদের জন্য ভোগান্তি নয়, কিন্তু আমি যতই অস্বীকার করি, আমার প্রিয়তমা ভাতিজীর জন্য সেটা ভোগান্তির হবেই। ওর জীবনের নানারকম কষ্টের একমাত্র কারণ হবে ও নারী। এবং সেই কষ্টগুলোর প্রতিটির পেছনে কাজ করবে অন্য কারো অন্যায়। আমরা সেটা সহ্য করব। প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে সয়ে আসছি।

বাণী গল্প রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন যেভাবে-
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে, মাটির কাছে ধরা দেবে ব'লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।
তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ, অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই-- আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।
 

আচ্ছা, একটা বখাটের দল যখন রাস্তায় হেঁটে যাওয়া একটা মেয়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, তখন মেয়েটার কেমন লাগে? আমি সাইকোলজির ছাত্র নই, আমার ওসব বোঝার সত্যিকারের ক্ষমতাটা নেই। আসলে, পুরুষ হয়ে জন্মানোয় আর কখনো ওটা জানার সুযোগ হবে না। এবং এই বিশ্রী স্বাদটা নেবার ইচ্ছে কারো শখে জাগবেও না কখনো। কিন্তু সেই পুরুষগুলো? যাদের চোখ জ্বলজ্বল করে, কিংবা ঠোট ভিজে ওঠে? ওদের কখনো মনে হয়েছে কথাগুলো?

ভারতীয় একটা সাইটে দেখলাম ওঁরা লিখেছে,
মেয়েদের এটা করা উচিৎ না,
মেয়েদের ওটা করা উচিৎ না...
আসলে মেয়েদের এসব চুতিয়াদেরকে জন্ম দেয়াই উচিৎ না যারা এসব বলে। 

এটা তাঁরা ছেপেছে কৌতুকের মত করে ইলাস্ট্রেশন করে। আসলে মেয়েরা মা হন বলে তাঁরা এত মহৎ হয়ে পড়েন। যে ছেলেটা ঐসব অশ্লীল কথা সাবলীল ভঙ্গিতে বলে যেতে পারে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে, তার কখনো মনে পড়ে না, তার মা একসময় তরুণী ছিলেন, এবং তার মত অনেক ছেলেরা ঠিক ঐভাবে ঐ মন্তব্যগুলো করেছে তাঁকে নিয়ে। সেই মা কখনো জানতে পারেন না, তরুণী থাকতে যে শব্দগুলো তাঁকে সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে জীবনে, সেই শব্দগুলো তাঁর ছেলে বাইরে অবলীলায় উচ্চারণ করে কোন মেয়েকে কুঁকড়ে দিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে, এবং ঘরে এসে অবলীলায় ভাত গিলছে। মায়ের কথাটা ভাবলে হয়ত ভাতগুলো গলায় আটকে যেত। 

সাম্যতা বা স্বাধীনতার অর্থ কিন্তু আমরা আজকাল প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু সেই গুলিয়ে ফেলবার অনেক আগে, একদম শুরুতেও কিন্তু আমরা বৈষম্য টেনে আনি। ধরুন আমার বাবা যদি আমাকে আজ ফোন করে বলেন, 'তুমি লিখেটিখে কিছু টাকা পাও না? আগামী মাসে আমাকে দেড় কোটির মত টাকা দিও তো, জমি কিনব একটা।' আমি কি তখন হাসব? আমাকে যদি বলা হত ভাতিজার জন্য চিপস কিনে এনো, কিংবা মায়ের জন্য এক কেজি আপেল এনো, সেটা স্বাভাবিক ছিল। সেটা হয়। কিন্তু কেমন করে আমি দেড় কোটি জোগাড় করব? সামর্থের প্রশ্ন আসে এতে। কিন্তু সেই সামর্থ্য কি আমার আছে? এক মাসে সেই টাকা জোগাড় করার মত সামর্থ্যও কি আমার আছেনেই। আমরা সাম্যতার বিচার করব শারিরীক-মানসিক সামর্থ্য দিয়ে। 

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

গাউন





এক.
মধুর ক্যান্টিনে চা ফুঁকছি। একলা বসে, অসময়ে। ব্যাপারটা সিগারেটের মত, ক্যাফেইন নেবার পদ্ধতি, তবে এতে ফুসফুসের জোরে কিছু বাতাস বের করে দেয়া হয়, চা কে ঠাণ্ডা করতে। বসেছি কাউন্টারের সামনের টেবিলটায়, ভিড়ভাট্টা নেই একদম। আমার চোখ বারবার যাচ্ছে ঐ ওপাশের টেবিলটাতে, যেখানটায় একটা মেয়ে বসে আছে। কিছু খাচ্ছিল হয়তবা, কিংবা কারো জন্য অপক্ষা করছে। হয়তবা বেকার সময়ই কাটাচ্ছে। আমার শেষটা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে। কারন ফুটফুটে চেহারার মেয়েটাও বেশ কবার চেয়েছে এদিকটায়। আমি চা শেষ করলাম, এবং আর এক কাপ চা নিলাম। ফ্রয়েড ভক্তরা এর একরকম ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু আমার চায়ের নেশা, তাই তৃতীয় কাপ।

চা শেষ করে আমি বিল মিটিয়ে সোজা হেঁটে গেলাম সেই টেবিলটায়। বললাম, তুমি কি জানো, বিল ক্লিনটন ঠিক এ পরিস্থিতিতে কী বলেছিলেন?
মিষ্টি করে মেয়েটা হাসল, আলতো করে মাথা নাড়ল। বলল, লিভিং হিস্ট্রি-র গপ্পো।
আবারো বলল, আমি অরুণা।
আমি কশ্যপ।
এবারে শব্দ করে হাসল অরুণা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সত্যিকারের নামটা জানতে। বললাম, আমি রাহি।
-ফাইন আর্টস, ফার্স্ট ইয়ার।
-ফিজিক্স, ফার্স্ট ইয়ার।
আমি ফিজিক্সের ছাত্র হয়ে কক্ষনো অধিকার রাখি না মায়াবতি এক ফাইন আর্টসের ছাত্রীর দিকে তাকাতে। পুরো ক্যাম্পাসের বহু সিনিয়রের চোখ সবসময় চোরা দৃষ্টি ফেলে এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি। তবু আমি হেসে বলি, আমরা বের হতে পারি। কল্পনার মত সুন্দর করে মাথা নাড়ে অরুণা। আমরা বের হই মধু থেকে।

-একলা চুপচাপ বসে ছিলে যে? অপেক্ষা?

বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

চোখ যখন নিরুপায়

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেই। হাতে নিয়ে হাঁটি। নইলে দূরে বসে থাকা কোন সুন্দরীর পানে চোখ আটকে যায়। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেও যখন চোখ ফেরাতে পারি না, ঠিক তখনই চশমাটা খুলে নেই। নিজেকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি  মুক্তি নেই।
ব্যপারটা প্রায়ই ঘটছে আজকাল। কোন বান্ধবীকে পছন্দ, চোখ আটকে যাবে। দূরে কাউকে দেখেও চোখ আটকে যাবে। নৈতিকতার অবক্ষয়, নাকি হৃদয়ের কল্পলোকের পরিস্ফুটন? হয়তবা বিস্ফোরণ।

আমি সবসময়ে আমি হতে চেয়েছি। এলো চুল আমার পছন্দের। কাঁধে শাল ঝুলিয়ে হাঁটতে আমার বেশ লাগে। চশমার কাচ ঘোলা হয়ে আসে প্রায়ই, অযত্নে। সেসবে ঢের আপত্তি সবের। প্রেমের জন্য চিঠি লিখতে জানা আমার কাছে আধুনিকতা, সবের কাছে মধ্যযুগীয় ভাবনা। আমার আমি হওয়ায় মানুষের যত আপত্তি আছে, সেগুলোকে আমি প্রায়ই থোড়াই কেয়ার করি। কিন্তু সবসময়ে পারি না।

আহমাদ বলে, মেয়েমানুষ দুরকমের। মায়ের জাত, আর প্রেমিকার জাত। চেনার সরল উপায় হল, প্রেমিকার জাতে বড় চুল ভালোবাসে। আর মায়ের জাতের কাছে বড় চুল অসহ্য, চক্ষুশূল।  আমি ক্লাসের শুরুর দিনগুলোতেই ভাগ দুটো ঠিক ঠিক করে ফেলেছিলাম। কারণ তখন আমার চুলগুলো ছিল ঝাঁকড়া এবং দীর্ঘ। কাঁধে শাল চড়িয়ে ক্লাসে যাই, বসি সবার সামনে। একদিন একজন শিক্ষিকা, যিনি একজন মাও বটে, বললেন ওসব চলবে না। আমার বান্ধবীদের মাতৃত্ববোধ বেরিয়ে এল। ওরা বলল, তোমাকে শাল ছাড়তে হবে, চুল কাটতে হবে। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে চলল, তুমি কেন এমন থাকো? আমি তখন আশেপাশে তাকিয়ে অসহায়ের মত করে মাথা নাড়লাম। আমার নিষ্ঠুর ছেলে বন্ধুগুলো আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। কান্না কান্না চোখে ভাবছি, এরা সবে কি মায়ের জাত? যেমন ছিল ঈশিতা আর রূপা। তখন দেহে প্রাণ ফিরে আসে। মীম বলে, ছেড়ে দে না ওকে। ও যেমন থাকতে চায় তেমনই থাকুক। আমি মীমের প্রতি প্রাণ ভরা কৃতজ্ঞতা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।

এবং বিকেলে আমাদের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুরপাড়ের সেলুনে গিয়ে বলি, চুলগুলো একদম ছোট করে ফেলুন। বেরিয়ে আসতে সোহাগ, শান্ত, আসাদুজ্জামান বলে, এবার একদম ঠিক আছে। আমার ইচ্ছে করে ওদের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলি। পরদিন ক্লাসে যাই গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে।

রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আনন্দভ্রমণে

 দূর-দূরান্তে ঘুরবার আগ্রহ আমার বহুকালের। কখনো একলা ঘুরতে ভালো লাগে, কখনোবা অনেকের সাথে। শুধু দূরে নয়, দিনভর আশেপাশে কাজে-অকাজে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটাও আমার খুব বেশি। কম খাওয়া, না খাওয়া আমার প্রায় শূন্য ওজনের একটা কারন হতে পারে, তবে অন্য কারণটা হল দিনভর ছুটে বেড়ানো। যা খাই, তার অনেকটা দখল করে নেয় আমার ভ্রমণপিয়াসু কর্মকান্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যায়ন এর শুরু ২০১৭ সালের শুরুতে। আর জানুয়ারিতেই একটা পিকনিক পেয়ে যাওয়া রীতিমত অভাবনীয়। অল্প কয়জনের দেখলাম আগ্রহ নেই এটা নিয়ে তেমন। বাকিরা সবাই মুখিয়ে থাকলাম পিকনিকের তারিখের জন্য। উপরি পাওনা দুদিনের ছুটির ব্যপারটাও মাথায় ছিল সবার। এবং এজন্য যে অতি অপ্রিয় দুটি ক্লাস মিস হবে, সে আনন্দও সচেতনভাবে পাচ্ছিলাম।

আমরা প্রায়ই টিএসসিতে বসি আড্ডা দিতে। সে আড্ডা কখনো বারান্দায় পা বিছিয়ে, কখনো ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে গোল হয়ে, কখনো বাইরের পার্কিং লটে, কিংবা ভেতরের লনে বসে। সে আড্ডায় সব বিষয়কে ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আসে বন্ধুকে রসাত্মক আক্রমণ। সে আক্রমণের বিষয়বস্তুগুলো সবসময়েই হয় নির্মম, এবং কখনোবা ছাপার অযোগ্য। এছাড়া পড়াশুনার কথা, বইয়ের কথাও কখনো ঘুরেফিরে উঁকি দেয় আমাদের আড্ডায়। সে আড্ডার প্রতিটা মূহুর্ত সবার জন্য আনন্দ উদ্দীপক। আমরা পিকনিকের জন্য মুখিয়ে ছিলাম, হয়তবা পিকনিকে এই আড্ডার আনন্দের বিস্ফোরিত রূপ কপালে জুটবে বলে।

দিনটি ছিল ২৩ জানুয়ারি, প্রথম বর্ষের ছেলেপুলেকে আসতে বলা হয়েছে ভোরবেলাতেই। আমাদের সেসবের বুঝি তেমন তোয়াক্কা ছিল না। হেলেদুলে দুজন, চারজন করে এসে জড়ো হতে লাগল অনেকটা সময়। এসেছেন শিক্ষকেরা, বড়রাও। সবাই মিলে বাসে ওঠার আগে বাধ্যতামূলক ফটোসেশন। অবশ্য সেটাকে সেলফি সেশন বললে তেমন অপরাধ হবে না। এর ফাঁকে পিলো পাসিং খেলার জন্য আনা বালিশটা ধার করে আমি আমাদের ভবনের নিচতলার ওয়েটিং বেঞ্চিতে ঘুমাবার আয়োজন খুঁজি। কিন্তু শোয়ার একটু পরেই এক বেরসিক ছেলে এসে জানায়, বালিশটা এক বড় আপুর বাসা থেকে আনা। কোথায় কী! আমি বালিশ নিয়ে ভো দৌঁড়। রিংকিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলি, আমি ভেবেছি বালিশটা তোর। এরপরে সবাই মিলে সেলফি তুলতে শুরু। মেয়েদের কেউ শাড়ি না পরায় আমিও পাঞ্জাবি পরিনি। তবে আয়াত সেসবের তোয়াক্কা না করে ঝলমলে পাঞ্জাবি গায়ে হাজির। তখন মনে হল, আমি কী দোষ করেছিলামরে বাবা!

সেলফিতে মেয়েরা দেখা দেয় শহরের সকল আটা-ময়দার সংগ্রহ নিয়ে। আর আমরা প্রায় সবাইই এলোমেলো সেই ভঙ্গিতে। মিলনের ব্যাগ থেকে বেরোয় সেলফি-স্টিক নামের অতি অদ্ভুত এক উদ্ভাবন।

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনগুলো

অনেক ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে হত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। কখনো মনে হত পড়ব বাংলায়, কখনোবা সাংবাদিকতায়। অঙ্কে পড়তে ইচ্ছে হয়েছে, ইচ্ছে ছিল বোটানি পড়বারও। ইচ্ছেগুলো কখনো ফানুসের জন্য জমে থাকেনি, আগ্রহগুলো ছুটেছে স্রোতের মত।

যখন নির্দিষ্ট করে ভাববার সময় হল, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ  নামে একটা বিষয় পড়ব বলে সিধে হলাম। সেই শখের চ্যারিটি করে বেড়ানো, ইউনিসেফের হয়ে গ্রাম গ্রাম ধরে বদলে দেবার স্বপ্ন, সেসব জেঁকে বসে খুব করে। কিন্তু সেখানে পড়া হবেনা, কঠোর সব পরামর্শ। আমি ঘাড় কাত করে সব শুনে যাই। তারপর ভাবতে হয়, কেমিকৌশলে পড়লে আমি সেদিকে ছুটতে পারব স্নাতকোত্তরে। তারপরে আসে পুষ্টি প্রতিষ্ঠানে পড়ার কথা। আমি আবারও আবিষ্কার করি, আমার সেই স্বপ্নগুলোর আরো কাছে এই বিষয়টা পৌঁছে দিতে পারে। কখনো লজ্জা হত, কারন এদেশে বিষয়টার নামে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে খুব করে পড়াশুনা হয়। ছেলে হয়ে সেখানে কে যায়?

সেই প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিনটায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমি আমার মন ভালো হওয়ার হাঁটা শুরু করি এদিক ওদিক। আমার যখন মন ভালো থাকে, কিংবা খারাপ থাকে, আমি তিন-চার কিলোমিটার হাঁটি শহরের রাস্তা ধরে।

কয়েক বছর আগে আমি আঙ্গুল গুণে বের করেছিলাম, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারি, তবে স্নাতক শেষ করে বের হব যখন, তখন একশ বছর বয়স হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমার কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু মনে হতে থাকে সেটাকে। আমি এখন সেই স্বপ্নের খুব কাছে।

পাঠ পরিকল্পনা হাতে পাবার পর শেষ লজ্জাটুকুও আমার দূর হয়, এখানে ঘরোয়া পুষ্টি প্রকল্প নিয়ে পড়তে আসিনি আমি। অণুজীববিজ্ঞান, রসায়ন, ব্যাবচ্ছেদ বিদ্যা, অর্থনীতি, মানব পুষ্টি, শরীরবিদ্যা, জীব-রসায়ন এর মত সব বিষয়ই পড়তে হবে এখানে। নেই ঘরোয়া পুষ্টির একটুখানি পড়াও। পাবলিক হেলথ এর পড়াও অনেক। পড়তে শুরু করলাম, এবং এবছরের জন্য পড়াশুনার কথা এখানেই শেষ।

প্রথম দুয়েকটা দিন অনেকটা চুপ করেই কাটে। তারপর শুরু হয় নানারকম আনন্দ। আমরা ধীরে ধীরে অনেককে তুই বলতে শিখি। ক্লাস করে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসিতে গিয়ে বসি। অনেকক্ষণ করে গল্প করি, আর মাঝে মাঝে দুপুরে খেতে বসি ক্যাফেটেরিয়ায়। সেই অল্প একটু ভাত, একটুখানি আলু ভর্তা, আর মুরগির মাংস। মুরগির প্রতিটি টুকরো এত ছোট হতে পারে কখনো ভাবিনি। মাঝে মাঝে খেয়েছি এমন ছোট টুকরোর রান্না, তবে অন্ততর পাঁচ-সাত টুকরো। কখনোবা গলার এক টুকরো পরে পাতে। ঝোল থাকে স্বচ্ছ, বাটি ভরা। তাই দিয়ে আধপেট খেয়ে বলি, হল তো লাঞ্চ, এবার আড্ডায় বসি।

প্রথম দিককার আড্ডায় পাই ছেলেদের দল থেকে শ্রাবণ, মিলন, তানজির, জায়েদ আয়াতদেরকে। আর মেয়েদের মধ্যে অন্তরা, আমেনা, রিংকি, মীম। প্রথম দুয়েক সপ্তাহ এর আড্ডায় ঘুরেফিরে এই কজনের সাথে আরো দেখা যায় অনেককে। আস্তে আস্তে আড্ডার প্রবণতা আর বাড়ে। সবাই যোগ দিতে শুরু করে আড্ডায়। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাটাতে শুরু করি আমাদের সময়গুলো।

এর মধ্যেই চলে আমার অনেক পছন্দের কাজ। বিজ্ঞান লেখা, এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো থাকে মূল আকর্ষণ। 

[অসমাপ্ত! আমি দুঃখিত, একটা লেখা ছেড়ে একবার উঠলে, মন খারাপে কিছু সময়ে ডুবলে সেটা আর কখনো লেখা হয়ে ওঠে না। এটা আর কখনো লেখা হবেনা। এরকম কিছু ডায়েরি ঘেটে পরে কখনো লিখব। ]