রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল



এক.
ক্লাস শেষ হল, অমনি জারিনের মেসেজ। কার্জনে এসো, লনে। গিয়ে দেখলাম ওর চুল ভেজা। একদম চুপুচুপে। বললাম, ভেজা কেন?
-কেঁদেছি।
-তবে চুল কেন?
-মুখ ধুতে গিয়ে।

আমরা মাটিতে বসলাম। এল বিয়ের কথা। বলল, কাল এলে না কেন?
-পেট ব্যাথা করছিল।
-মগবাজারে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-কাজী অফিসের সামনে?
-বলো কী! যা রোদ।

তখন ফোনে রাইমার মেসেজ এল, "ল্যাব করছ তো?" যেতে হবে ল্যাবে। পথে কয়েকটা কাঠগোলাপ কুড়িয়ে নিলাম ত্রিপল-ই এর সামনে থেকে। তখন সোহান নামের পিচ্চি ফুলওয়ালা পাশ থেকে যেতে যেতে বলল, 'যেইডা মাগনা পাওয়া যায়, সেইডাই নিবেন!' এই একটু আগেও ছেলেটা আমাকে জ্বালাতন করেছে, একটা গোলাপের জন্য। কিন্তু শুকনোগুলোও চায় দশ টাকা। ল্যাবে গিয়ে দিলাম রাইমাকে, ও সেটা ব্যাগে রাখল, সাথে বলল, 'খাবার আনলেই তো হত!'

এই আমার দুই প্রেমিকা। আমরা বিয়ে করছি। আমি এবং রাইমা, আমি এবং জারিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, দুজন শিক্ষার্থী বিয়ে করে ফেললে নাকি তারা থাকতে পারে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। হলে চল্লিশ জনের গণরুম দেখে আমি ক্লান্ত। ওখানে থাকা যায় নাকি? আমার শখ, দুটি বিয়ে করে দুটি রুম নেব, একরুমে থাকবে দুই সতিন (সুফিয়া কামালে রাইমার রুম নম্বরও যে ২০৩!), অন্য রুমে আমি একা। কারণ গণরুমে আছে ছারপোকার উৎপাত! তবে শ্রাবণ বলে, 'এখানে ছারপোকা, ওখানে উকুন। আপনি কোনটা চান?'

আগামী সপ্তাহে, সোমবার বিকেলে বিয়ে করব আমি আর রাইমা। এই বুধবার সকালে আমাদের ব্যাচেলর জীবনে শেষ ডেট। ক্লাসটা মিস দিতে হবে, তারচেয়ে কষ্টের,
নীল পাঞ্জাবীটা ধুতে হবে। রাইমাও সেদিন নীল জামা পরবে।

দুই.
ঘুম থেকে উঠতেই রোদ উঠে গেল, আমি বললাম 'শীট'! মনে পড়ল, ম্যাডাম বলেছিলেন, 'ডোন্ট সে শীট!' কাপড় ইস্ত্রি করতে শুরু করলাম, তখন এল রাইমার ফোন। আমি আবারো বললাম, 'শীট!' ধরলাম ফোন, বলল রাইমা, বেরিয়ে পড়নিতো?
-হ্যাঁ বেরিয়েছি।
-এটা কী করলা! এক্ষুণি ঘরে যাও।
-কেন? দেখা করবা না? রাগ করলে?
-ঘরে যাও, ভার্সিটির হেলথ কার্ডটা নিয়ে এসো।
-কেন?
-নিয়ে এসো।
ফোন রেখে দিল। আমি বোকার মত কার্ড নিয়ে গেলাম।

দেখা হল ডাকসুতে। অল্প পয়সায় খাওয়াটা সারলাম। হাঁটতে হাঁটতে আসতে হলে শহীদ মিনারের এখানে। ভার্সিটির কেন্দ্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রে। কার্ড নিয়ে রাইমা কিসব ব্যাবস্থা করল। এরপর আমাকে বলল, রক্ত দিয়ে এসো। আমি কাগজ নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকলাম, কিন্তু কেমন করে আপত্তি করি! প্রেমিকাদের জন্য আমার রক্ত উৎসর্গ করতেও কার্পণ্য নেই - কত লিখেছি একথা! এখনো তো সে প্রেমিকা, বউ নয়। কিছু না জেনে দিয়ে এলাম এক সিরিঞ্জ রক্ত। ভাবলাম, আহা! কত মশার পেট বাঁচাত এই রক্ত।

এরপর রাইমাকে টিএসসিতে বসিয়ে আমি গেলাম একটু ওপাশে। রোকেয়া হলের সামনে, সামিয়াকে কিছু টাকা দিতে। ও পেত। কথা ছিল, রোকেয়া হলের ফুচকা খাওয়াবে, কিন্তু নিল একটা ঝালমুড়ি। কারণ ফুচকা তখনো খোলেনি। খেতে খেতে বলল, 'কাউকে বলিস না কিন্তু!' ভাবলাম, আহা বলে কী! কেমন করে বলব? সামনে আমার দুটো বিয়ে।

বিয়ের চুড়ি কেনা হল। আর কিছু কেনা হল না, কারণ টাকা নেই।

তিন.
পরদিন ক্লাস এগারোটায়, গেলাম সাড়ে দশটায়। ইন্সটিটিউটের গেটে পৌঁছতেই দেখলাম মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে রাইমা। থমথমে মুখ, যুদ্ধের পূর্বাভাস। কিন্তু আমি চাই শান্তি। ডেকে নিয়ে গেল ক্যান্টিনে। কোকের বোতলে স্ট্র লাগিয়ে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখল। একটা কাগজ এগিয়ে দিল, HIV টেস্টের রিপোর্ট! চেঁচিয়ে বলতে গেলাম, 'তুমি আমায় অবিশ্বাস করো রিয়া!' কিন্তু থমকে যেতে হল, কারণ রেজাল্ট পজিটিভ। আর বাংলা সিনেমাও বেশি দেখা হয়ে গেছে, এটা রাইমা, রিয়া নয়। মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল চিন্তা। আমি এরমধ্যে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। কেমন করে হল? সবসময়েই আমি 'সেফটি' খরচ বাবদ দুই টাকা রাখতাম, তবে?

চেঁচিয়ে উঠলাম, 'এ হতেই পারে না রাইমা!' ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রাইমা। ক্যান্টিন বয়কে ডেকে বললাম, টিস্যু নিয়ে আয়। নিয়ে এল দৈনিক কেটে বানানো বাংলা টিস্যু! ছুড়ে ফেললাম মেঝেতে, 'এরচেয়ে টয়লেট টিস্যু ভালো।' স্বগতোক্তির মত করে বললাম। নাইম নামের ছেলেটা সোজা গেল টয়লেটে, নিয়ে এল। ভাবলাম, এইডস আমার অকারণে হয়নি।

কিন্তু বিশ্বাস করি কেমন করে? বললাম, 'কিছু নিশ্চয়ই ভুল আছে।' আর এই রিপোর্টের কথা যদি জারিনের কানে যায়? তবে দুটো বিয়েই ভেঙ্গে যাবে এক্ষুণি। গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। রক্ত দিলাম, পিছে পিছে মুখ ভার করে ঘুরল রাইমা। দুদিনের অপেক্ষা। শনিবার রিপোর্ট। এ বিয়ে পোস্টপন্ড, ঐ বিয়ে নিয়ে ভাবতে লাগলাম।

শুক্রবার রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরলাম অনেক, অবশ্যই জারিনের সাথে। ওদিকে নিশ্চয়ই রাইমা মুখ ভার করে বসে আছে। সুফিয়া কামাল হলের সামনে একবার হেঁটে এলে হত। ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে চুড়ি ভাঙচুর তো হত!

শনিবার রিপোর্ট আনলাম, HIV test রেজাল্ট নেগেটিভ! ব্যাপারটা কোথায়? গেলাম এবার সলিমুল্লায়, রোববার সে রেজাল্টও নেগেটিভ। দিলাম প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করে। হৈ চৈ পড়ে গেল, একটা কোমল ছেলেকে এমন অপমান! তদন্ত কমিটি হল তিন সদস্যের। একজন মাইক্রবোয়ালোজির, একজন পাবলিক হেলথের, একজন ইংরেজির প্রফেসর। সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা হল, একত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে, কেমন করে হল এই ভুল? একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ইংরেজি কেন? প্রক্টরের সরল উত্তর, 'টেস্টের রিপোর্ট ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল'

কিন্তু সাংবাদিকরা পিছু নিল। সাতদিনের মাথায় ফাঁস হল, দু জায়গায় আমি দিয়েছি মোট চারশ আশি টাকা। ঢামেকের রিপোর্ট রুমে তিনশ, সলিমুল্লাহর রিপোর্ট রুমে দেড়শ, পিয়নকে ত্রিশ।  

চার.
-'হ্যালো!'
-জারিন, বলো।
-তুমি ফ্রী আছ?
-আছি তো!
-একটা কথা বলব, কাউকে বলবে না তো?
-কেন বলতে যাব? তুমি আমাকে চেন না?
-চিনি বলেই তো বলছি! তবে এটা খুব সিক্রেট যে। তুমি আমার আপন ভাইয়ের মত, তাই তোমাকে বলছি বিশ্বাস করে।
-খুক খুক!
আলতো করে কাশলাম, ভারী জিনিসকে হালকা করে নেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। তাই বিষম খাবার ব্যাপারকে কাশি দিয়েই পার করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ততক্ষণে,
-এই শুনছ তো?
-হু বলো। কাউকে বলব না।
-আমাদের ডিপার্টমেন্টের থার্ড ইয়ারের যে ভাইয়ার কথা তোমাকে বলেছিলাম না? ঐ যে চুল বড় বড়, স্পাইক করা! পহেলা বৈশাখে আমার ছবি তুলে দিল... শুনছ তুমি?
-শুনছি। তোমার পেছনে ঘুরত...
-অসভ্যের মত করে কথা বলছ কেন! ঘুরত মানে কি। ভাইয়া না সত্যি আমাকে অনেক পছন্দ করে। কাল বিকালে আমাকে সাতটা গোলাপ দিয়েছে। আর আমি কি হাবা জানো? নীল নয়নতারা দিয়েছি, তাও ছয়টা! লাল গোলাপই দিতে হত না তুমি বলো...

গ্যালো গ্যালো আমার অস্তিত্ব।

পাঁচ.
প্রোক্টর ক্ষেপলেন। আবারও এইচআইভি টেস্ট করতে নির্দেশ দিলেন। এবার পর্যবেক্ষণ করবে তদন্ত কমিটি। সাতদিনে HIV টেস্টের যে রিপোর্ট ঢাকা মেডিকেল দিল, সেটা না দিলেই ভালো হত। আমি আর শ্রাবণ সেই রিপোর্ট নিয়ে মুখ ভার করে গেলাম ডাকসুর দিকে। চিকিৎসার ফান্ড রাইজিং নিয়ে ভাবতে হবে এবার। শ্রাবণ একটা খসড়া লিখে রেখেছিল, কারণ ও জানত ঢাকা মেডিকেলও একই রিপোর্ট দিবে, কারণ ওর আমাকে নাকি চেনা আছে! পোস্টারের ভাষাটা আবার আমাকেই দেখতে হচ্ছে। যেবার নাফিসের কিডনির অসুখ হল, পোস্টার আমি লিখেছি। কিন্তু নিজের অসুখের চিকিৎসায় দান পেতে কেমন করে নিজে লিখি? তাই বলে ভাষার ধারটা একটু বাড়িয়ে দিতে তো দোষ নেই।
চায়ে সিঙ্গারা চুবিয়ে খেতে খেতে শ্রাবণ বলে, 'শ্লা এ দফা যদি বেঁচে যাও, কী-বোর্ড আর কলমের বাইরে কোথাও তাকাইও না। সুবিধা করতে পারবা না।'
-আরে! ঐসব কী কথা? ছোট্ট মিসটেক, আর হবেনা। আরেকটু হইলেই তো মামা ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে দুইটা রুম ভাও কইরা ফ্যালতাম...
-সেইটা না পারলেও মেডিকেলের ওয়ার্ডে একটা সিট তো ম্যানেজ হইছে!
-গণরুমের চেয়ে ভালো।
-গণরুমে স্বাধীনতা আছে।
-হাসপাতালে সুন্দরী নার্স আছে।
-ভূতে রাম নাম নিব, কিন্তু সুন্দরী নার্সে এইডস রোগী ছুঁইব না!
হতাশ কণ্ঠে বিড়বিড় করলাম, 'শালা!'

পোস্টারের খসড়ায় শ্রাবণ লিখেছে, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী, এইডস রোগে আক্রান্ত...'
বা-বা-বাহ! আগে অসচ্চরিত্রবানেরা আক্রান্ত হত। আজকাল মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকেও এইচআইভিতে ধরে!

1 টি মন্তব্য: