বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

চোখ যখন নিরুপায়

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেই। হাতে নিয়ে হাঁটি। নইলে দূরে বসে থাকা কোন সুন্দরীর পানে চোখ আটকে যায়। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেও যখন চোখ ফেরাতে পারি না, ঠিক তখনই চশমাটা খুলে নেই। নিজেকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি  মুক্তি নেই।
ব্যপারটা প্রায়ই ঘটছে আজকাল। কোন বান্ধবীকে পছন্দ, চোখ আটকে যাবে। দূরে কাউকে দেখেও চোখ আটকে যাবে। নৈতিকতার অবক্ষয়, নাকি হৃদয়ের কল্পলোকের পরিস্ফুটন? হয়তবা বিস্ফোরণ।

আমি সবসময়ে আমি হতে চেয়েছি। এলো চুল আমার পছন্দের। কাঁধে শাল ঝুলিয়ে হাঁটতে আমার বেশ লাগে। চশমার কাচ ঘোলা হয়ে আসে প্রায়ই, অযত্নে। সেসবে ঢের আপত্তি সবের। প্রেমের জন্য চিঠি লিখতে জানা আমার কাছে আধুনিকতা, সবের কাছে মধ্যযুগীয় ভাবনা। আমার আমি হওয়ায় মানুষের যত আপত্তি আছে, সেগুলোকে আমি প্রায়ই থোড়াই কেয়ার করি। কিন্তু সবসময়ে পারি না।

আহমাদ বলে, মেয়েমানুষ দুরকমের। মায়ের জাত, আর প্রেমিকার জাত। চেনার সরল উপায় হল, প্রেমিকার জাতে বড় চুল ভালোবাসে। আর মায়ের জাতের কাছে বড় চুল অসহ্য, চক্ষুশূল।  আমি ক্লাসের শুরুর দিনগুলোতেই ভাগ দুটো ঠিক ঠিক করে ফেলেছিলাম। কারণ তখন আমার চুলগুলো ছিল ঝাঁকড়া এবং দীর্ঘ। কাঁধে শাল চড়িয়ে ক্লাসে যাই, বসি সবার সামনে। একদিন একজন শিক্ষিকা, যিনি একজন মাও বটে, বললেন ওসব চলবে না। আমার বান্ধবীদের মাতৃত্ববোধ বেরিয়ে এল। ওরা বলল, তোমাকে শাল ছাড়তে হবে, চুল কাটতে হবে। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে চলল, তুমি কেন এমন থাকো? আমি তখন আশেপাশে তাকিয়ে অসহায়ের মত করে মাথা নাড়লাম। আমার নিষ্ঠুর ছেলে বন্ধুগুলো আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। কান্না কান্না চোখে ভাবছি, এরা সবে কি মায়ের জাত? যেমন ছিল ঈশিতা আর রূপা। তখন দেহে প্রাণ ফিরে আসে। মীম বলে, ছেড়ে দে না ওকে। ও যেমন থাকতে চায় তেমনই থাকুক। আমি মীমের প্রতি প্রাণ ভরা কৃতজ্ঞতা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।

এবং বিকেলে আমাদের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুরপাড়ের সেলুনে গিয়ে বলি, চুলগুলো একদম ছোট করে ফেলুন। বেরিয়ে আসতে সোহাগ, শান্ত, আসাদুজ্জামান বলে, এবার একদম ঠিক আছে। আমার ইচ্ছে করে ওদের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলি। পরদিন ক্লাসে যাই গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে।


এই যে এতকিছুর বাইরে কিন্তু আমার আর একটা জগৎ আছে। জগৎ না বলে দলবল বলাই ভালো। সেখানে সবাই আমাকে এমনটা দেখতেই পছন্দ করে। আমার সেই দলবলের আশেপাশে গেলেই ঢাকার দূষিত বাতাসকেও অনেক বেশি হালকা লাগতে শুরু করে।

আমি কিন্তু সবকিছুর পরে সেই এলো চুল, শাল চাপানো একটা মানুষ। এবং হয়তবা একটা মানুষ এমনটা দেখতে পছন্দ করে বলেই অন্যদের শত কথা শুনেও আমি বদলাতে রাজী নই। সেই একটা মানুষ কে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি সবসময়ে চুপ। কারণ সেই মানুষটাও হয়ত উত্তরটা জানে না।

আচ্ছা, দূরে দেখতে পাওয়া কি অধিকার? যেমন ধরুন আজ ক্রিকেট খেলার সময়ের কথা। শর্ট অফ এ ফিল্ডিং করার কালে ওপাশের রাস্তা দিয়ে এক রমণী যাচ্ছিল। ওয়াইডিশ এলাকার ফিল্ডারদের চঞ্চলতায় আমি সৌন্দর্যটুকু ভেবে নেই। সাথে ভাবি, চোখ খারাপ হওয়ায় কি বঞ্চিত হচ্ছি? এরপর হাসি। কারণ চোখ ফিরিয়ে নেয়াই আমার স্বরূপ।

হাঁটতে আমার ভালো লাগে। একলা হাঁটতে বেশি ভালো লাগে। কেউ পাশে না থাকলে আমি হাঁটতে হাঁটতে জগতে মনোযোগ দেই। খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক কিছু দেখি। বুঝতে চেষ্টা করি জগতের নির্মমতাকে। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতম উপাদান হল খাদ্যশৃঙ্খল। যোগ্যতমের জয়। কেমন প্রাচীন এক গন্ধ নিয়ে বেড়ে ওঠা ঐতিহ্য। সেসব আমি শুধু দেখি। কখনো প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনায় ক্ষমতানুযায়ী সাময়িক বদল করতে ইচ্ছে হয় না। শুধু দেখি, এবং হাঁটি। মুখ ফিরিয়ে নেয়াও হয়তবা আমার স্বরূপ।

আমার সবকিছুতে বিরক্তি নিয়ে তাকানো মানুষজনকে আজকাল আমি দেখতে পাচ্ছি। তারা হাসে, এবং উপহাস করে। সেজন্য আমি তাদের চেয়ে সুখি। তাদের জন্য ভালোবাসা।

1 টি মন্তব্য:

  1. চমৎকার লিখেছেন।
    আরও 'ওমর ফারুক' হয়ে উঠবেন এই আশা রাখি।
    এখন গাঁটছড়া বাধার সময় হয়ে উঠেনি।

    উত্তরমুছুন