এক.
সালেহ মিয়ার দোকানটা ছোট। চায়ের দোকান সেটা।
চা-রুটি-কলা বেচে কুলায় না। তাই সুঁই, কলম, চুলের খোপা
জাতীয় অনেক কিছুই উঠিয়েছেন তিনি। তবু সেটা মুদি দোকান হয়ে উঠতে পারেনি। বসতভিটের
সামনে টিনের ছোট ঘর তুলে বানিয়েছেন দোকানটা। তবে চারটে বাড়ি পরেই মণ্ডল ব্যাপারীর
মুদি দোকান। সব রসদ সেখানেই আছে। অল্প পুঁজিতে সালেহ মিয়ার যা ওঠানোর সাধ্য,
তাতে মানুষ টানবে না। অগত্যা এটুকু দিয়েই চলতে হয়। তবে পাশেই
প্রাইমারি স্কুল, ওপাশে ব্রাক স্কুল। ছেলেমেয়েরা এক টাকা-দুই
টাকা নিয়ে দৌড়ে আসে প্রায়ই। ক্লাসের মাঝে, টিফিন পিরিয়ডে,
এমনকি ক্লাস শুরুর আগেও ভীড় লেগে থাকে ছেলেপেলের। তবে তাতে আর কত আয়?
বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই দিনে পায় দুই টাকা, খুব
অল্প কজনই পাঁচ টাকা। অনেকে কখনোই বাড়ি থেকে টিফিন খরচ বলে কিছু পায় না। বাড়িটাও
ছোট। যা কিছু চাষ হয়, ছোট পুকুরে যা মাছ হয়, তা খেয়ে পরে বেচার উপায় নেই।
সালেহ মিয়ার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোদে
পোড়া মুখ, ভ্রু ঘন, কপালে এর মধ্যেই ভাজ পড়েছে। লম্বাটে মুখে
সবসময় যেন রাজ্যের ক্লান্তি লেগে আছে। তিন মেয়ে তার। বড়টা ক্লাস এইটে পড়ে, মাঝেরটা ব্রাক স্কুলে এবার যাওয়া শুরু করল, আর
ছোটটার বয়স দুই বছর। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু নেই বহু বছর হল। টানাটানি নেই,
এমন কখনো যায় না। এক টুকরো জমিও নেই যে ফসল উঠলে মুখে হাসি ফুটবে।
একটা গাভীর জন্য বড় সাধ। মেয়েগুলো বছরে একটা দিনও দুধ খেতে পায় না। কিন্তু
ক্ষুদ্রঋণ দেবার কথা বলে যে আপারা বাড়ীতে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে যায় প্রায়ই,
তাদের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারেন না তিনি। সুদের বোঝা বড় ভারী। ও পাড়ার
এক বউ নিয়েছিল ঋণ। গরুই কিনেছিল। সাপে কামড়াল গরুটাকে, সেই
সুদ সামলাতে এক টুকরো জমিই বেচতে হয়েছিল ওদের।
বড় মেয়েটার নাম কমলা। তরতর করে বেড়ে উঠছে সে।
এরমধ্যেই গ্রামের ছেলেরা আড়চোখে তাকায়। বাপের মত লম্বাটে মুখই পেয়েছে মেয়েটা।
চিবুক যেন অনেকটা সুঁচালো। চোখগুলো বড় বড়, দেখলে মায়া পড়ে যায়। বিয়ের কত প্রস্তাব
আসে। কিন্তু সালেহ মিয়া ফিরিয়ে
দেন সবাইকে। তার বড় শখ, মেয়েটা স্কুলের আপা হবে। মেয়েও ছোটবেলা থেকে তাইই বলে। পড়াশুনায় খুবই ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল, পুরো উপজেলায় সেকেন্ড। প্রাইমারি স্কুলের বড় ম্যাডাম তাকে ডেকে বলেছিলেন, মেয়ের যেন পড়াশুনার কোন ক্ষতি না হয়। অনেকটা হুমকির স্বরেই বলেছিলেন, মেয়েকে ভার্সিটিতে পড়ানোর আগে বিয়ের কথা উঠালে গ্রামছাড়া করবেন সালেহ মিয়াকে। সব সাহায্যেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আপা অবসরে চলে গেছেন, তার খোঁজ জানা নেই। ছোট মেয়ে দুধ ছেড়েছে, এখন দুটা ভালো খাবার দিতে হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের এক আপা এসে শুধু বড় বড় কথা শুনিয়ে যায় কী খাওয়াতে হবে তার, কিন্তু সেসব কোত্থেকে আসবে, সে উপায় তো তারা বাতলে দিতে পারেন না। আর কিছু টাকা হলে খাওয়ার কষ্টটা কমত।
দেন সবাইকে। তার বড় শখ, মেয়েটা স্কুলের আপা হবে। মেয়েও ছোটবেলা থেকে তাইই বলে। পড়াশুনায় খুবই ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল, পুরো উপজেলায় সেকেন্ড। প্রাইমারি স্কুলের বড় ম্যাডাম তাকে ডেকে বলেছিলেন, মেয়ের যেন পড়াশুনার কোন ক্ষতি না হয়। অনেকটা হুমকির স্বরেই বলেছিলেন, মেয়েকে ভার্সিটিতে পড়ানোর আগে বিয়ের কথা উঠালে গ্রামছাড়া করবেন সালেহ মিয়াকে। সব সাহায্যেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আপা অবসরে চলে গেছেন, তার খোঁজ জানা নেই। ছোট মেয়ে দুধ ছেড়েছে, এখন দুটা ভালো খাবার দিতে হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের এক আপা এসে শুধু বড় বড় কথা শুনিয়ে যায় কী খাওয়াতে হবে তার, কিন্তু সেসব কোত্থেকে আসবে, সে উপায় তো তারা বাতলে দিতে পারেন না। আর কিছু টাকা হলে খাওয়ার কষ্টটা কমত।
গত তিনটে বৈশাখ সালেহ মিয়া খুব আতঙ্কে কাটিয়েছেন, কিছুই হয়নি।
এবার যখন সব আতঙ্ক ফিকে হয়ে এসেছে, আল্লাহ বাঁচাবে, এই ভরসায় দুশ্চিন্তা ছেড়ে দিয়েছেন, তখনই এল
ধাক্কাটা। বৈশাখের প্রথম দিনে, ভর দুপুরে ঝড় এসে তার ঘরটার
চাল উড়িয়ে নিল। দুইটা ঘর, সাথে রান্নাঘর, আর বারান্দা ছিল তার। পুরো চালটাই উড়ে গেল। তিনি যেন অথৈ সাগরে পরলেন।
তিনি গিয়েছিলেন বাজারে, ঝড়ে আটকা পড়েছিলেন। বিকেল হবার আগেই
প্রকৃতি একদম শান্ত হয়ে গেল, আর বাড়িতে ফিরে দেখেন এই
অবস্থা। ঘরের সব ভিজে একশেষ। ছোট মেয়েটা তারস্বরে কাঁদছে, বউ
পাথরের মত মুখ করে বসে আছে। স্বামীকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনিও। পাশের বাড়ির
হালিদের একটা ঘরে জায়গা হল আপাতত। আসবাব তো তেমন নেই, যা
রাখা যায় ঘরে রাখলেন, কিছু নিলেন দোকানঘরে। রাতের বেলা সালেহ
মিয়া থাকবেন দোকানে, তিন মেয়েকে নিয়ে বউ ওই বাড়ি। কমলা তখনো
স্কুল থেকে ফেরেনি। পহেলা বৈশাখের কত অনুষ্ঠান হয় স্কুলে। ঝড়ের কারণে নিশ্চয়ই সব
ভণ্ডুল হয়েছে। হাইস্কুল প্রায় দুই মাইল দূরে। সেখান থেকে ফিরতে সময় তো লাগে।
অনুষ্ঠানে গান গাবে বলে ওর মায়ের একমাত্র ভালো শাড়িটা ধুয়ে নীল দিয়ে পরেছে মেয়েটা।
সেই সাজে একটু ক্লান্তি মেখে যখন বাড়ি এল, তখন প্রায়
সন্ধ্যে। সেই গোধূলির লাল আলোতে মেয়েটা চেঁচিয়ে ওঠে, আল্লাহ!
সারারাত একলা শুয়ে ভাবেন সালেহ মিয়া, ব্যাবস্থা কি
কিছু হবে না? এপাশ-ওপাশ করতে করতে সিদ্ধান্ত নেন, ঋণ এবার নেবেনই কিছু টাকা। পেটে ভাত নেই, তাই বলে মাথার
একটু ঠাইও হবে না? সকাল হতেই যান ব্যাংক অফিসে। দশ হাজার
টাকা নেন, শয়ে বারো টাকা সুদে। টিন কিনে ঠেলায় করে বাড়ি
ফেরেন। দুজন মিস্ত্রীর সাথে খাটাখাটনিতে লেগে যান তিনি। দুইদিনেই চাল সারা হয়ে
যাবে আশা করা যায়। পুরনো কিছু টিন তো কাজে লাগানো যাচ্ছেই। সাদিয়া মেয়েটা স্কুলে
যায়নি। ব্রাক স্কুলের আপারাও একবার এসে দেখে গেছে কাজের অবস্থা। হালিমার কাছে
শুনেছে বোধহয়। তার স্ত্রী আমেনা বেগমকে বলে গেছে, মেয়েটাকে
কাল যেন স্কুলে পাঠায়। বাড়িতে তো মেয়েটার বসে থাকবারও জায়গা নেই। কাজের মধ্যে
জ্বালাতনও করবে। তারচেয়ে স্কুলে গিয়ে খেলুক। তবে কমলা সেই সকালেই স্কুলে চলে গেছে।
ও জানে, স্কুল কামাই দিলে আর ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া হবেনা,
আর এই বছর তো বোর্ড পরীক্ষাও আছে। অনেকে ব্যাচে পড়ে, ওর তো সেই সাধ্য নেই। ঝড়-বন্যা কিছুতেই ক্লাস ফাঁকি দেবার উপায় নেই। আর
স্কুল ওর ভালোই লাগে। কত গল্প হয়, গান গাওয়া যায় দলবেঁধে।
দুই.
প্রথম মাসের কিস্তি জমা দিয়ে দোকানে এসে মুখ ভার
করে বসে ছিলেন সালেহ মিয়া। দীর্ঘশ্বাসের সাথে দুশ্চিন্তায় তার ঠোট একটুখানি বেঁকে
যায়। এতদিন ভাবতেন কিস্তি টানা খুব শক্ত। কিন্তু এটা আসলে ভয়াবহ! টানাটানির সংসারে
অতিরিক্ত আয় নেই,
কেমন করে তিনি টাকা কয়টা জমাবেন প্রতি মাসে? আরেকটু
স্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন দেখতেন, সেখানে ঝড় যেন উল্টো পথে নিয়ে
গেছে জীবনটাকে। তখনই কমলা আসে, বসে তার তার পাশ ঘেষে পা
ঝুলিয়ে। বলে, আব্বা চা দেও!
-যা ছেড়ি! ছোট মাইনষে চা খায় না।
-ভালো খবর আছে একটা।
-তাইলে একটা সন্দেশ খা।
কৌটা খুলে নিজেই এক টাকা দামের একটা সন্দেশ তুলে
দেন মেয়ের মুখে। নিজ থেকে জিজ্ঞেস করেন না খবরটা কী। নিশ্চয়ই কোন পরীক্ষায় ফার্স্ট
হয়েছে মেয়ে, নইলে কোন স্যার-ম্যাডাম খুশি হয়ে বই-টই দিয়েছে কিছু। মাঝে মাঝেই এমন 'ভালো' খবর আনে মেয়ে।
মেয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা নীল ফর্ম বের করে। এই
ব্যাগটা দিয়েছিল উপজেলা থেকে বছরের শুরুতে, সব ক্লাসের ফার্স্ট যে মেয়ে হয়েছে
তাদেরকে। আজব এক ব্যাগ, পানি ঢোকে না একফোঁটা। সেই ফর্ম
দেখিয়ে বলতে থাকে, দুই হাজার টাকা মাসে বৃত্তি দিব, পাঁচ বছর। এইসব লিখে দিতে হবে, ছবি তুলতে হবে,
স্কুলের বড় আপার সাইন লাগবে, আর বাবার মাসিক
আয় যে আট হাজার টাকার কম, সেটার একটা প্রমাণ লাগবে, চেয়ারম্যানের সাইনওয়ালা। সবকিছু খামে ভরে ঢাকায় পাঠাতে হবে। হাতে কিছু সময়
আছে। পনের দিনের মধ্যে পাঠাতে হবে লেখা আছে। সালেহ মিয়া ভাবেন, আরেকটু আগে পাঠাতে বলত ওরা, তাহলে টাকাটাও আগে আগে আসত।
তিন.
পরদিন বিকালে গ্রামের পোস্ট অফিস থেকে বিশ টাকা
দিয়ে ছবি তুলে আনে কমলা। উচ্ছ্বাস ভরে সাদিয়া দেখতে থাকে সেই ছবি, আর সবাইকে
দেখাতে থাকে, আফারে সিনেমার নায়িকার মতন লাগে।
ফর্মে সাইন দেন বড় ম্যাডাম, আর লিখে দেন
প্রশংসা পত্র। ওর স্কুলের যে রেজাল্ট ও লিখেছে, তাতে
বৃত্তিটা না পেয়ে উপায় নেই। ফাইভের রেজাল্ট, আর তার পর থেকে হাইস্কুলে
প্রতিবার ফার্স্ট।
উপজেলা অফিসে দুদিন পরে যান সালেহ মিয়া। কোথায়
যেতে হয় তা তিনি জানেন না। নতুন তিনতলা বিল্ডিং, অনেকগুলো রুম। পেছনে কয়েকটা
ভাঙ্গা একতলা ঘরে ভূমি অফিস। সেখানে তাকে আসতে হয়েছে। কিন্তু এই বিল্ডিং এ কার
কাছে যাবেন, কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। চৌকিদার মতন
এক বুড়ো, নীল শার্ট পরা, গেটের সামনে চেয়ার
নিয়ে বসা, তার কাছেই গিয়ে বলেন, আয়ের
সনদ লাগবে। বুড়ো খেঁকিয়ে ওঠে, ভেতরে যাও, আমি কি চেয়ারম্যান নাকি? ম্লান বদনে ঢোকেন তিনি
ভেতরে। এই অফিসে তাদের গ্রামের একটা মানুষও কাজ করে না নাকি? এ ঘর ও ঘর করে উঁকি দিতে থাকেন সালেহ মিয়া। নিচতলায় কোন রুমেরই দরজা খোলা
পাওয়া যায় না। বিভিন্ন গ্রামের অপরিচিত মানুষজনকে দেখতে পান তিনি, যাদের সবাইই ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। সবার চোখেই ক্লান্তি, অনিশ্চয়তা।
দোতলায় একটা রুম পাওয়া যায় লম্বা লাইন। ডিজিটাল
কক্ষ। মানুষজন বেশিরভাগই এখানে বিদেশ যাওয়ার সাধে এসেছে। কেউ কেউ বিদেশে কাজ করা
পরিবারের সদস্যের সাথে ভিডিওতে কথা বলতে এসেছে। এই ঘরে তার কাজ নেই। ঘুরে টুরে
তিনতলায় একটা ঘর পেয়ে যান শেষে, যেটায় লেখা 'অফিস কক্ষ'। তিনটে টেবিলে কাজ করছে দুই বুড়ো, আর এক ছোকরা।
ঘরের দরজায় দাঁড়ানো এক পিওন। বাইরে অপেক্ষারত কিছু মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বারান্দায় বসে। কেউ আবার ইতস্তত হাঁটছে। দাঁড়ানো পিওনকেই সালেহ মিয়া
ধরেন, তার একটা আয়ের সনদ চাই। উষ্কোখুসকো দাঁড়িতে ভরা গাল পিয়নের।
লোকটা জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোন গ্রামে?
-তেরভূ।
-কী করবা?
-মাইয়ার বৃত্তি পাইতে দিতে হইব।
-মাইয়া স্কুলে যায়?
-ফার্স্ট হয় প্রতিবার। ক্লাস এইটে পড়ে।
আগ্রহ ভরে একটু দ্রুতই যেন বলে যান সালেহ মিয়া।
-তুমি করো কি?
-চায়ের দোকান চালাই। জমি-টমি নাই।
-পেটে ভাত নাই আর মাইয়ারে ইশকুল পাঠাও?
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে পিওন বুড়ো।
-বড় সাধ ছিল ভাই।
-মাইয়াতো যাইব অন্যের বাড়ি। তুমি উপোস
দিলে লাভটা কী?
আমতা আমতা করেন সালেহ মিয়া। পিওন বলে, যাও ওয়েট করো।
দেখি কখন দেওয়া যায়। যেন সার্টিফিকেট ঐ পিওন দিবে। কিন্তু তাকে টপকে কি ঢোকা যায় আর?
সেই 'ওয়েট' আর শেষ হয়
না। দুয়েকবার পিওনকে বলতে গিয়েও বকা খেয়ে ফিরে আসতে হয় সালেহ মিয়াকে। এক ঘরেই
জন্ম-মৃত্যু সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, চরিত্র
সনদ, আয় সনদ আর কত কি! তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কিছু হয়
না, শেষে তিনি ফিরে যান গ্রামে। আজকের মত আর অপেক্ষা করলে
দোকান খোলা হবে না। পরদিন ছুটি, তার পরদিনও। সরকারি চাকুরেরা
দুই দিন ছুটি পায় সপ্তাহে, আর মানুষের জন্য নানারকম যাতনার
সৃষ্টি করে দেয় সব কাজে।
সোমবার যান আবার। একদম সকাল সকাল। দোকান খুলে
বসতে হয় আমেনা বেগমকে। এইবার পিওনকে বলতেই সে খেঁকিয়ে ওঠে, মিয়া তোমারে
না ঐদিন দাঁড়াইতে কইলাম! তুমি গ্যালা কই? মুখ নিচু করে বলেন
সালেহ মিয়া, দোকান খুলতে হইত ভাইজান।
-তোমার দোকানই খুলো। কাম করা লাগবে না।
- আজকে যদি হয়। পরিবারে দোকান খুলছে
আজকে।
-যাও ওয়েট করো।
কত মানুষ পরে এসে ঢোকে, আর চাষাভূষা
জাতীয় লোকগুলো, মহিলারা বারান্দায় বসে অপেক্ষাই করতে থাকে।
এবং একসময় হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেন সালেহ মিয়া, কিছু ঘুষ
দিতে হবে পিওনকে। কিন্তু সত্যিই কি এছাড়া উপায় নেই কোন? আরও
অপেক্ষা করে তিনি বোঝেন, সবাইই শেষ পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে ঢোকে।
যারা অপেক্ষা করে, তারা বোঝার জন্যই অপেক্ষা করে, আর কোন উপায়ে কাজ সারবার কোন উপায় আছে কিনা। যেখানকার যে নিয়ম!
কমলার কাছে একটা গল্প শুনেছিলেন, সেই গল্পটা
মনে পড়ে সালেহ মিয়ার। এক মাদ্রাজি ব্যাপারী এক ইংরেজ বাবুকে বলেছিল, এই অভাগা দেশে মানুষ তিনধরনের। একদল সজ্জন, তাঁরা
ঘুষ নেয় না। আরেকদল বজ্জাত, তারা ঘুষ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু একদল
শুয়োরের বাচ্চা আছে, যে ঘুষ নিয়েঅ কাজ করে। কিন্তু শেষ দলটা
হল শুয়োরের বাচ্চা। তারা ঘুষ নিয়েও বকতে পারেন না। তিনি কোন দলের সামনে ঘুরছেন কে
জানে!
বিশটি টাকা বেরিয়ে যায় ভেতরে ঢুকতে। তবে সেটাকে
ক্ষতি বলে মনে হয় না। এই বৃত্তিটা কমলা পেয়ে গেলেই তো কিছুটা অভাব ঘুঁচবে, মাসে দুই
হাজার করে টাকা পাওয়া যাবে। কল্পনা করতেই যেন একটুখানি শিহরণ বয়ে যায়।
সত্যিই কি কিস্তি নিয়ে ভাবতে হবে না অত? দোকানে
ঠিক করে বসতে পারবে? মেয়েটার পড়াশুনা আর ভরণ পোষণ নিয়ে ভাবতে
হবেনা আর?
এরমধ্যেই এক বুড়োর টেবিলের সামনে এসে বসেছেন, প্রশ্নও এল
দ্রুত। একবার যেন ভ্রু কুঁচকে তাকাল এই কর্মকর্তা। এ ঘরের সবাই ঢিলেঢালা গোছের।
কারো যেন কাজ শেষ করবার কোন তাড়া নেই। কিছু মানুষ ঘরের ভেতরই দাঁড়িয়ে।
-কী লাগবে?
-একটা আয়ের সনদ।
-বাড়ি কই?
-তেরভূ।
-করো কি?
-চায়ের দোকান দেই।
-মাসে কত কামাও?
-চার পাঁচ হাজারের মতন।
এবার হঠাৎ করে যেন অবহেলা ঠিকরে পড়ে লোকটার চোখ
থেকে। এতক্ষণ তবু শুনছিল,
এখন অন্যদিকে তাকায়, পাশে বসা লোকটার
চারিত্রিক সনদ লিখতে থাকে। সেটা লোকটার হাতে তুলে দিয়ে হাঁক দেয়, আরেকজন পাঠাও! সালেহ মিয়া অবাক হন, অপেক্ষা করেন। এবারে
আসা লোকটাও চাষা ধরনের। তার প্রয়োজন ছেলের জন্ম নিবন্ধন। বিরক্তি প্রকাশের ভঙ্গিতে
লোকটা ইশারা করে পাশের টেবিল। পরের জন আসে। তার সাথে কথা বলতে বলতে আবারো মন দেয়
সালেহ মিয়ার দিকে।
-আয়ের সনদ দিয়া করবা কী? অনুদান নিবা? বাঙ্গালির এই এক সমস্যা, দান-খয়রাত ছাড়া...
কথার মাঝে বাগড়া না দিয়ে পারেন না সালেহ মিয়া।
বলে ওঠেন, 'মেয়ের বৃত্তি'।
আলস্যে হেলান দেয় লোকটা। চেয়ারে তোয়ালে দেয়া, যেন মাথার তেল
চেয়ারকে তেল-চিটচিটে না করে ফেলে। তাকায় সালেহ মিয়ার দিকে। গল্প জোড়ার ভঙ্গিতে বলে,
'ও বৃত্তি? আমার ভাতিজা আছে একটা। মাথা একদম
খোলা। ঢাকায় পড়ে কলেজে। মেট্রিকে বৃত্তি পাইছিল, আড়াইশ টাকা
করে দেয় মাসে।'
এরপর আবার মগ্ন হয়ে অন্য লোকটার জন্য বিশাল টালি
খাতা খুলে বসে। ধীরে ধীরে পাতা উল্টে একটা জায়গায় থামে। কাগজে টুকে নেয় কিছু।আবার
তাকায় সালেহ মিয়ার দিকে। 'আমার ভাই হইল ঢাকায় মাছের আড়ত নিছে। বিশাল কারবার। কাওরান বাজারে বড়
দোকান। সাততলার উপরে থাহে, লিফট দিয়া তরতর কইরা ওঠা যায়'। কথা বলার মাঝখানে একটা ফর্মে কিছু লিখে পাশের
মানুষটাকে দেয়। একটু থেমে খেই ধরে আগের কথার। 'তার একটাই
পোলা। বিয়া করছিল টাঙ্গাইল, সেই বিয়া টেকে নাই। বউটা ছিল
খন্নাস! এহনকার বউডা ভালো আছে। পর্দা-পুষিদা করে...'। কথা
ফুরায় না লোকটার। বাড়ির ঘেরে যে বড় বড় পাঙ্গাশ হয়েছে, একেকটা
দেড় কেজি ওজন, সেসবও শুনতে হয় সালেহ মিয়াকে। এরা নিজের গল্প
শোনাতে ভালোবাসে। অর্থবিত্তের গল্পও, আর সেসবে ভালো শ্রোতা
তো গরীবেরা। অসহিষ্ণু কণ্ঠে এবার সালেহ মিয়া বলেন, 'আমার
কামডা?'
এতক্ষণে থামে লোকটা। ডেস্কের পাশের তাকে খুঁজতে
থাকে ছাপানো প্যাড। সেই প্যাডে দেখা যায় পৃষ্ঠা নেই। সেই প্যাড সরিয়ে রাখতে রাখতে
বলে, 'কাইল বিকালে আসো। গুদাম থেকে প্যাড আনান লাগবে'।
পরদিনও অনেক ঝক্কি পেরিয়ে সেই রুমে ঢুকতে হয়, এবং বলা হয়
গুদামে প্যাড নেই। আগামী সপ্তাহে আসতে হবে, রবিবারে। সালেহ
মিয়া বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফেরেন। তিনি আর বিবি আধপেট খেয়ে বাঁচতে পারেন। সাদিয়া,
সুফিয়া ছোট মানুষ, খায় খুব অল্প। খাবার খরচের
অনেকটা যায় কমলার পেছনে। আনুষাঙ্গিক কিছু খরচও তো আছে। সত্যি মেয়েটার ভরণ-পোষণই চলছে
না। দুশ্চিন্তায় সময় কাটতে থাকে তার। কিছুই কি করার নেই? যদি
কিস্তির বোঝা না থাকত, চলত তবে। কিন্তু এখন কিস্তি দিতে হয়।
মেয়েকে ঘরে ধরে রাখার মত জোর পান না মনে। বাণের জলেই কি ভাসতে হবে মেয়েটাকে শেষ?
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঠানো যাবে ফর্ম। রোববারে
সালেহ মিয়া যান ইউপি অফিসে। সেই দাঁড়িয়ে থেকে, ধাক্কাধাক্কি করে বিশটি টাকা খরচা করে
তাকে ঢুকতে হয় অফিসঘরে। এবং মাথায় যেন বাজ পরে। এখনো আয়ের সনদের প্যাড ছাপানো হয়
নাই। কেন, তার উত্তরে শুনতে হয়, একটা
কাজ তো ঝট করে হয় না। সময় লাগে সবকিছুতে। এবং যে বাঙালি তাড়াহুড়ো করে বলে এই
অবস্থা, সেটাও মনে করিয়ে দেয়া হয়। এরপর কর্মকর্তা অন্যদের
দিকে মনোযোগ দেয়, সালেহ মিয়া কিছুক্ষণ উপেক্ষিত হয়ে বেরিয়ে
আসেন। এবার দারোয়ানকে বলেন, কিছু একটা ম্যানেজ না হইলে বড়
সমস্যায় পড়ব ভাইজান। দারোয়ান বলে, তোমারে কি কেউ মাগনা কাম
কইরা দিব মিয়াঁ? কিছু ছাড়ো। বলেই তাকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে
সরিয়ে দিয়ে দরজার পথ খালি করে। সালেহ মিয়ার আন্দাজ নেই কত টাকায় কাজ সিদ্ধি হতে
পারে। আবারো শরণাপন্ন হতে হয় দারোয়ানের কাছে। সে পাক্কা দালালের মত করে বলে,
পাঁচশ দিও।
পাঁচশ টাকা পাওয়া অত সহজ না। গ্রামে ফিরতে হয়
তাকে। ভাবতে হয়, পাঁচশ টাকা কি দিতেই হবে? কমলার আগ্রহে তাকে আবারো
যেতে হয় ইউপি অফিসে। দোকানের ক্যাশ ভেঙ্গে। নোটটা
টেবিলে রেখে বলেন, ভাইজান কালকের মধ্যে ছাপান যায় না?
এবারে লোকটাকে ধূর্ত শেয়ালের মত লাগে। বলে, আজকেই প্রেসে
পাঠামুনে। এইসব কামে সময় লাগে, কিন্তু তোমার যেহেতু দরকার,
ফেলায়ে তো রাখা যায় না। তুমি গরিব মানুষ, তোমার
লাইগা যতটুকু পারা যায় আমাগোই তো করা উচিৎ। তুমি পরশু আসো, আমি
সাইন লইয়া রাখমু চেয়ারম্যান সাবের।
মঙ্গলবারও কিছু সমাধা হয় না। হতভম্ব হয়ে সালেহ
মিয়া আবিষ্কার করেন,
কর্মকর্তা লোকটা কিছুই করেনি আসলে এই দুদিনে। দুইটি একশ টাকার নোট
রাখেন আবার সেই টেবিলটায়, বলেন, অন্য
একটা কাগজে আইনা দেন না ভাই!
-বুঝলা ভাই, এইসব
ছাপাছুপি একদিনে হয় না। তোমারে আইনা দিমুনে এক কাগজে প্রিন্ট কইরা। আগামী সপ্তায়
আসো।
-কালকে আমার পাঠাইতে হইব ঐডা ঢাকায়।
-তাইলে ক্যামনে?
-কালকেই ভাই আইনা দেন।
-ডিজিটাল সেন্টারে কাম করাইতে হইব। তুমি
এক কাম করো, পিওনরে দুইশ টাকা দিয়া যাও, ঐখান থেইকা লেখায় আনব। কম্পিউটারের কাম...
বিমর্ষমুখে মাথা নাড়েন সালেহ মিয়া। আজ তার কাছে
টাকা ছিল। প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। ভাবছেন, কাল পেলে পাঠানো যাবে কুরিয়ারে,
পরশু শেষ তারিখে ওটা ঢাকা পোঁছবে। আর তাতেই আশা করা যায় চাপ কমবে
কিছুটা।
পরদিন তাকে দেখতে হয় অন্য চিত্র। শুনতে হয়, এই কাজ এইভাবে
হয় না। বড় কাজে সময় লাগে, যারা অত তাড়াহুড়া করে, তাদের আসা উচিৎ না নাকি সরকারি দফতরে। এক সপ্তাহ পরে এলে পেয়ে যাবে সে
আয়ের সনদ। অল্প পয়সা আয়, আর সেটার সনদ নিয়ে এত আদিখ্যেতার জন্যও
শুনতে হয় তিরস্কার। এতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয় তাকে। চেঁচিয়ে ওঠেন,
এবং দারোয়ান কাম পিওনের অর্ধচন্দ্র কপালে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাকে বের
হতে হয়, চোখে জল নিয়ে।
জীবনে নানারকম বোঝা তার ছিল। দারিদ্র্যের বোঝাটা
সবচে ভারি। সেটাকে হটাবার ক্ষমতা নেই, তবে এক অবলার বোঝা সইবার আত্মশক্তি
ফুরিয়ে যায় ঐ চোখের জলের সাথে সাথেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন