শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭

আ জার্নি টু বোলপুর



এক.
আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রিন্ট করা একটা পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ছাদে। ওপাশে প্রীতি খেলছে আর দুটো ছোকরার সাথে। আমার সেদিকে মন নেই। আমি অপেক্ষা করছি মিমির জন্য। বলেছি সোজা ওপরে চলে আসতে, ক্লাস শেষেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের সহকারী অধ্যাপক সে। আমি এই মূহুর্তে অকর্মার মত ঘরে বসে আছি। ফুলার রোডে শিক্ষক ভবনে থাকছি আমরা প্রীতির জন্মের পর থেকেই। মিমি ছাদে ঢুকল, ধীর-স্থির ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, দারুণ খবরটা কি শুনি
আমি ভাবলাম, খানিকটা রহস্য না করে পারা যায় না। হাসলাম। ছেলেবেলা থেকে মিমির যে একটাই অভ্যাস, গুনগুন করে বলা, 'অসভ্য!' সেটা বলে ও আমার হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিল। একটুক্ষণ চোখ বুলিয়ে হাসল, 'আবেদন করবে?'
কাগজটা ছিল একটা চাকরির বিজ্ঞাপন। বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে। ওদের এগ্রো কেমিস্ট্রি বিভাগে দুজন অধ্যাপক নিচ্ছে, মূলত গবেষণার কাজে। 'বেশ তো, করো আবেদন!' এটুকু বলেই ও চেঁচাল, রাণী... রাণী... প্রীতি দৌড়ে এল। মায়ের কোলে ঝপিয়ে পড়ল। আমাদের একমাত্র মেয়ে এই প্রীতিলতা। বয়স চার এর একটু বেশি। বড় দুরন্ত হয়েছে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর নামে রাখা ওর নাম। এই নাম নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি বাড়িতে।
আমার-মিমির দুই পরিবার থেকেই আপত্তি ছিল, নামটা হিন্দুয়ানী। কিন্তু নামের ক্ষেত্রে আমরা সেসব মানতে পারিনি। আমার ব্যাখ্যা ছিল, আমরা যেসব আরবি নাম রাখি, সেসবের অনেকগুলোই কিন্তু মূর্তিপূজার যুগ থেকে এসেছে। সেগুলো এখন মুসলমান নাম হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছি দিব্যি। তবে আমার মেয়ের নাম নিয়ে কেন আদিখ্যেতা হবে? সেই মেয়েকে আমি প্রীতি বলে ডাকলেও ওর মা ডাকে রাণী বলে। কারণ প্রীতিলতার মা প্রতিভা দেবী তাঁকে এই নামে ডাকতেন। আমার ভালোই লাগে। 

'বেশ তো, করো আবেদন' মানেই যে সবকিছু মেনে নেয়া, ব্যাপারটা তেমন না। সেসব ঝড় শুরু হল রাতের বেলা। তা অবশ্য হবারই কথা। ওদেরকে এখানে ছেড়ে আমাকে যেতে হবে বোলপুর, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক বছরের ছুটি নিতে হবে মিমি কে। কোনটাই ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তবে আমি যে ঘরে বসে আছি দুটা বছর, তাও তো ভালো দেখায় না। এবং কিছু একটা করা দরকার ছিল। ছেলেবেলায় শখ ছিল, আমার প্রথম সন্তান পড়বে শান্তিনিকেতনের মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালায়। সেটা নিয়ে এই কিছুদিন আগেও ভেবেছি। ইউনিসেফের কোলকাতা অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি ওদিককার কোন প্রোজেক্টে কাজ, কিংবা কোন পদ খালির আশায়। কিন্তু কিছু হয়নি। প্রীতিকে বিশ্বভারতীতে পড়াবার শখ মিমিরও আছে। তবু সেটা বাস্তবে কেমন করে হবে, তার কোন হদিস আমরা পাইনি এদ্দিনে। আমার একটা অলীক পরিকল্পনা আছে, কিন্তু সেটা বলবার সাহস কুড়ানো যাচ্ছে না।

শুতে এসে মুখ খুলল মিমি, সত্যি যেতে চাও?
চাই বটে। অম্লান বদনে উত্তর করি।
আমাদের কী হবে?
তোমরাও চলো।
বিস্ময়ে ফেটে পড়বার উপক্রম হয় মিমির। বলে, আমরাও যাব?
রাণীর বোলপুরে পড়ার কথা, আমাদের ছোটবেলা থেকে। প্রীতি না বলে আমি রাণী বললাম, কারণ সেটা ওকে বেশি নাড়া দেবে।
কিন্তু আমার ক্যারিয়ার?
শুরুতেই মোক্ষম আঘাত হানে মিমি। শব্দচয়নে সে সবসময়ে পারদর্শিতা দেখিয়ে এসেছে, এখনও তাই। যদি ও বলত 'চাকুরী', আমি কিছু উত্তর দিতে পারতাম। কিন্তু 'ক্যারিয়ার', যেটা থেকে মুক্তি নেই, এবং যেটা ক্রম উন্নয়নের ব্যাপার। আমি মিনমিন করে বলি, পরে নাহয় আবার ঢাবিতেই এলে।
তা হয় না।
হতে হবেই। '' প্রত্যয় এবং গলার স্বরের উচ্চতায় মিমি অবাক হয়। এবং রেগে যায়।
হাউ ডেয়ার ইউ! ইউ কান্ট টক টু মী লাইক দিস!
উই শুড গো! গোয়ার্তুমি করেই বলি আমি। 
দেন গো এলোন! হালকা স্বরে বলেই পাশ ফেরে মিমি। ঝগড়াগুলো এখানেই শেষ হয়। এখানে এসে এটা একপাক্ষিক হয়ে যাবেই। বোঝা যায় আজ আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ও কথা বলবে না, সকালে না খেয়ে বেরিয়ে যাবে। আমি আস্তে করে মিমির পিঠে হাত রাখি, এবং হাতটাকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়া হয়। আমার হঠাৎ মন খারাপ হয়। ওর ক্যারিয়ার গড়ে উঠছে, সেটাকে ঠেলে দেয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু এখানকার পরিবেশে কার্টুন দেখে, ভিডিও গেম খেলে বড় হবে প্রীতি, সেটাও তো মানা যায় না। আমি উঠে ছাদে চলে যাই। পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে স্বাতী। পূর্বদিকে অভিজিৎ অনেকটা উঠে এসেছে। আমি একপাশে গিয়ে একলা বসে থাকি। তখন সমাজবিজ্ঞানের প্রোফেসর অরূপ ঘোষের ছেলেটা আসে ছাদে, সাথে আরেকটা ছেলে। একে আমি আজকাল দেখছি, কথা হয়নি। ওরা এসে চিৎকার করে গাইতে শুরু করে 'গড ব্লেস ইউ মিসেস রবিনসন'। আমি ফিক করে হেসে ফেলি। গানের মাঝখানে হঠাৎ ওরা আমাকে দেখে, এবং গান থামিয়ে দেয়। আমি বলি, থামালি কেন? বেশ তো শুনছিলাম। 

ঘোষমশাইয়ের ছেলেটা চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ বসে আছি, তখন আসে মিমি। ধীরপায়ে হেঁটে এসে বলে, ঘরে আসো। 
আমি অন্যদিকে চেয়ে থাকি। হাত ধরে টেনে নিতে যায়, আমি হাত সরিয়ে নেই। এবার ও হাসে। পাশে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর বলে, আকাশে শনি নেই কেন?
আমার কপালে! 
শব্দ করে হেসে ফেলে মিমি। ওর হাসিটা অদ্ভুত, দুই কিস্তির। প্রথমে জোরে হেসে উঠবে, এবং আস্তে আস্তে জোর কমবে। এবং ঠিক থেমে যাওয়ার আগ মূহুর্তে স্বরটা আবারো অনেকখানি বেড়ে যাবে। এই সময়ে আকাশে শনিগ্রহ থাকবার কথা, কিন্তু একটা মেঘের টুকরো তখন ঠিক শনিকেই ঢেকে রেখেছিল। আমি ওর হাত ধরি। ব্যাস্ত হয়ে হাত সরিয়ে নেয় মিমি। সাথে বলে, এই যা! করছটা কি! ছেলেপুলে দেখবে! 
আহা! এরচেয়ে যখন ছাত্র ছিলাম, সেটাই তো ভালো ছিল। তখন তো দু-চার ঘন্টা টিএসসিতে হাত ধরে বসে কাটানো যেত। আর এই গভীর রাতে ছাদে একলারা বসে বউয়ের হাত ধরতে দোষ? এটা কেমন কথা! কিন্তু ভাবতে হয়। কারণ এই বিল্ডিং-এ সায়েন্সের বেশ কয়টা ছেলেপুলে আছে। ওদের গল্পের একটা বড় অংশ জুড়ে নাকি থাকে মিমি ম্যাডামের প্রেম। 

মন খারাপে দুটা দিন কাটল। প্রীতি আনন্দে আছে, কিন্তু ঘরের পরিবেশ থমথমে। আমি সন্ধ্যায় তাই এই দুদিন বেরিয়ে গেছি, আড্ডা দিয়ছি সমকাল অফিসে। মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছি মিমির সাথে, কিন্তু সেটা ঝগড়ার দিকেই গেছে, কখনো কোন সমাধানের দিকে যায়নি। রাতে ঘরে ফেরার পর বুঝলাম, ঝড় আসন্ন। আমি কিছুই না বলে সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম কম্পিউটার অন করে। এ ঘরে প্রোজেক্টর আছে, শুয়ে শুয়ে কম্পিউটার চালানো যায়। দেখতে লাগলাম একটা হেলথ জার্নালের নতুন ইস্যু। তখন ঘরে ঢুকল মিমি। বলল, তোমার আবেদন করেছ? আমি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে এসেছি। 
এক মূহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যেন আবার সামলে নিলাম নিজেকে। চেঁচালাম, কেন
বিকেলে মিমি কিচ্ছু বলেনি। পুরোপুরি পদত্যাগের দরকার ছিল কি? ছুটি নিলেই হত। কত শখ ছিল ঢাবির শিক্ষক হবে। সেটা ছেড়ে এল? মেয়েরা হাজার বছর ধরে পরিবারের জন্য এসব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আসে। মিমি কখনো এমন করেনি। এই পরিবারে আয় করে মিমি, সিদ্ধান্ত নেই আমরা দুজনে। মিমির কোন স্বপ্ন আটকে থাকেনি কখনো। কিন্তু এখন? আমার মন খারাপ হতে শুরু করে বাজেভাবে। এরকম সমাধান আমি চাইনি। 
মিমি পাশে বসে। বলে, ডোন্ট বি আপসেট।
কেন এটা করলে?
প্রয়োজন ছিল।
আমি কিন্তু এমন চাইনি।
তোমার চাওয়াই এ বাড়িতে হয় নাকি? আমি চেয়েছি, তাই।
কেন?
মন টিকছিল না।
আমি ভাবলাম, এ কক্ষনো হতে পারে না। ওর কেন মন টিকবে না? বোলপুরে যাবার শখ ওরও আছে, তাই বলে ঢাবি ছেড়ে? একদম ছেড়ে? দেখলাম, মিমি কাঁদছে। আমি হাত দিয়ে আলতো করে ওর চোখ মুছে দিলাম। চোখ না মুছে চিবুকে লেপ্টে গেল চোখের পানি। মিমি বলল, আসলে টেকা যাচ্ছিল না।
কেন?
তোমার পাপের ফল।
'পাপ' বলতে একটা পূণ্যকেই বোঝানো হয়েছে। আমার মনে পড়ে সেসব কথা। মিমি যখন পিএইচডি করতে আমেরিকা যায়, তখন আমি রাজনীতিতে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত সব উপায়ে প্রচারণা চালিয়ে হঠাৎ করে জনপ্রিয়তা পেয়ে যাই। মজার ব্যাপার হল, ঢাকার একটা আসনে প্রথম ধাক্কায় সাংসদও হয়ে যাই। কিন্তু সেখানে কি টেকা যায়? স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদে গেছি। কিন্তু টেকার জন্য পার্লামেন্ট খুব শক্ত জায়গা। অপছন্দের সব সিদ্ধান্তে একের পর এক বিরোধিতা চালিয়ে যেয়েও কোন লাভ হয়নি। এখানে বিরোধী দল আসে না, সব সিদ্ধান্তেই আমরা দু-চারজন দলবিহীন মেম্বাররা আপত্তি তুলি, তা ধোপে টেকে না। শেষে একটা ফরেইন ইস্যুতে ছাত্ররা বড় আন্দোলন করে। সেখানে মারপিট-ধরপাকড় সবাই যখন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে বিলটা পাশ করে দেয়, তখন আমি পদত্যাগ করি। দেড় বছর টিকেছিলাম পার্লামেন্টে।

সেই থেকে মিমিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে রাজনৈতিক হেনস্থা সইতে হয়। এখনো প্রোফেসর হতে পারেনি ও ঠিক একই কারণে। এবং কয়েক দিন আগে ওর দুই-তিন বছরের জুনিয়র একটা শিক্ষক প্রোফেসর হল, ওর চেয়ে সবদিক থেকে পিছিয়ে থেকেও, তখন মিমি কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু এবারের ঘটনা আমি ঠিক বুঝতে পারিনা। আমি চুপ করে শুয়ে পড়ি।
সকালে উঠে যখন দেখি মিমি খাবার তৈরীতে লেগে গেছে, তখন অবাক হই। এবং মনে পড়ে, সে এখন আর শিক্ষক নয়। ভালোই লাগে একটুখানি। দুজনেই একদম নিশ্চিন্ত। কটা দিন কাছে পাওয়া যাবে ওকে। ক্লাস-সেমিনার করে করে যেভাবে ছুটে বেড়ায়, প্রিয় মানুষটাকে তেমন কাছে পাওয়া যায় না। সবসময় তো তার ক্যারিয়ার, এর মাঝখানে আমার জায়গা না দেখে মাঝে মাঝে অভিমান হত। এখন তো একসাথে কাটানো যাবে কিছুদিন। হেঁসেলে বাসিমুখে ঢুকতেই চেঁচিয়ে ওঠে মিমি, অসভ্যটা কি বদলাবেনা? একবার মুখ ধুয়ে আসতে পারে না? আমি আলতো করে চুল টেনে দিয়ে বেরিয়ে আসি। এবং খেতে বসে আসল ব্যাপার বলতে শুরু করে মিমি।
'এবছর যে মেয়েটা ফার্স্ট হয়েছে, ওর অনার্সের সিজিপিএ একশর চেয়েও বেশি বছরের মধ্যে ছিল সেকেন্ড রেকর্ড। আর মাস্টার্সের রেজাল্টও খুব ভালো। কিন্তু দেখা গেল এবছর কাউকে নেয়াই হচ্ছে না, পদ খালি নেই দোহাই দিয়ে। ওর পরিবারের বিরোধী দলের সাথে সম্পর্ক আছে, সমস্যা সেটা।' দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো কথার খেই ধরে মিমি, 'আর মেয়েটারও চাকরিটা খুব দরকার। আর্লি ম্যারিজ, আর্লি ডিভোর্স। বেশ সমস্যায় আছে মেয়েটা। এখন দিলাম চাকরি ছেড়ে। পদ তো খালি হল।'

আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। এই মহিলাটা! একটা সময় এতটুকু মেয়ে ছিল, কলেজে পড়ত, মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম। আমি বলতাম, তুমি অতি নিষ্ঠুর। কিন্তু সেই মেয়েটা আজ এভাবে ছেড়ে এল আরেকজনের জন্য? নিজেদেরও প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তবু সাধের বিশ্ববিদ্যালয়। আমি চোখের পানি লুকালাম।
মিমি তাগাদা দিয়ে বলল, ভ্যাবলার মত চেয়ে না থেকে খাওয়া শেষ করো, বাসা খুঁজতে যাও। নোটিশ আসবার আগে আমি এই শিক্ষক নিবাস ছাড়ব।
আমি মাথা নাড়লাম, খাওয়া শেষে, প্রীতিকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলাম। কেমন মুক্ত লাগল নিজেকে। এবং বের হতেই মনে পড়ল, সাকিবের কথা। গত মাসে ওদের বাড়ি ভাগ হয়েছে। ওর ভাগের অংশটা থেকে কিছুটা ভাড়া দেবে। ফোন করলাম।
আছিস কেমন?
মন্ত্রণালয়ের চাকুরি করে মানুষ কেমন থাকে, সংসদে গিয়েও বুঝিসনি?
বুঝেছিলাম, বিস্মরণ হয়েছি। একটা কাজে...
তা তো বোঝাই যায়। বল!
বাসা ভাড়া দিয়েছিস?
পাইনি এখনো কাউ...
কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, আজ আমি উঠছি। উনি তো ঢাবির চাকুরি ছেড়েছেন! রাখছি।

সোজা ঘরে এলাম, ইন্টারনেট ঘেটে 'প্যাক এন্ড পাস' নামে একটা কোম্পানিকে ফোন করলাম। ছেড়ে যাচ্ছি এই মহল।

 দুই.
ঝক্কি ঝামেলা ওখানে শেষ হবে, তা আশা করিনি। বেঁকে বসলেন মিমির মা। নাতনি ঐ সংস্কৃতিতে থাকবে, তা তিনি মানতে রাজী নন। ওটা আমাদের 'কালচার'-এর সাথে যায় না নাকি। ওনার বংশে কোন ছেলেমেয়ে বিদেশে বসে দেশের আদব কায়দা সব ভুলে যাবে, তা তিনি মানতে রাজী নন। আর আমরাও নাকি একটিবার ওদিকে গেলে আসার নাম করব না। ওনাকে বোঝাবার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গেলাম শ্বশুরবাড়ি। মধুর হাড়ি ঠিকই জুটল কপালে, কিন্তু সেই এক আপত্তি।
দুদিন থাকবার পর বোঝা গেল, হয়তবা তাঁদের মতের বিরুদ্ধে যেতে হবে আমাদেরকে। কিন্তু সেটাতে আমি রাজী নই। চতুর্থবারে মত মুখোমুখি হতে হল তৃতীয় বিকেলে।
তোমরা থেকে যাও। দেশে কিছু করার চেষ্টা করো। ব্যাটা মানুষ ঘরে বসে থাকো...
আমরা তো যাচ্ছি প্রীতির জন্য।
ক্যান এই দেশ কি জলে ভাইসা গেছে?
আহা! বলছেন কি! আমাদের একটা শখ ছিল ঐখানের বাতাসে মেয়েটা বড় হোক।
নষ্ট হয়ে যাবে দেইখো। বিদেশে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না।
না আম্মা! ঐটাতো আমাদেরই কালচার। আমরা বাঙ্গালি, ওরাও বাঙ্গালি। উল্টা, এইখানে পশ্চিমা প্রভাব অনেক বেশি।
ওইখানে গিয়ে পূজা শিখাতে চাও বাচ্চাটারে?
উহুম। ওখানে বাঙ্গালি কালচার শিখবে।
সেইটা এইখানেও পাওয়া যায়।

এরপরে আর কথা এগুনো গেল না।
কিন্তু সন্ধ্যায় বড্ড চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এলাম। পাশের বাড়ির ছোকরা টাইপ ছেলেটা চ্যাঁচাচ্ছে, আর ওর মা ফোঁসফোঁস করে কাঁদছেন। একটু দাড়িয়ে বুঝলাম, মায়ের বংশ উদ্ধার করে ছাড়ছে ছেলেটা, একটা নতুন অপারেটিং সিস্টেমের ফোন এসেছে বাজারে, সেটা কিনে দিচ্ছে না বলে। এবং আমার শাশুড়িকে দেখা গেল, সোজা গিয়ে ছেলেটার গালে দুটো চড় কষালেন। আমরা হতভম্ব! আমার অবশ্য বেয়াড়াগিরির ভালো একটা সমাধান শেখা হয়ে গেল। মুচকি হাসলাম। এবং তখন দেখলাম, শাশুড়ি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে ঘরে ঢুকছেন। আজকালকার ছেলেগুলো টিভি-সিনেমা দেখে নষ্ট হয়ে গেছে, দ্যাশটাই গ্যালো- এরকম কিছু স্বগতোক্তি। আমার হাসি প্রসারিত হল। মিমির দিকে তাকালাম। চোখে চোখে আমাদের কথা হয় প্রথম পরিচয় থেকে। কথা সম্পূর্ণ হল, আর মিমি ওর মায়ের আঁচল ধরে ঘরে ঢুকে গেল।

কিছুক্ষণ পর এসে আমার কানে চিমটি কেটে বলল, ডান!

তিন.
 ইন্টারভিউ দিতে বোলপুর যেতে হল। এবং বোর্ডে প্রায় সব প্রশ্নই গেল পার্লামেন্টকে ঘিরে। WHO, UNICEF থেকে ওঁরা চিঠি পেয়েছেন। এগুলোকে লবিং বলা যায় না, রেফারেন্স। আর যারা আবেদন করেছেন, তাঁদেরও নিশ্চয়ই ভুঁড়ি ভুঁড়ি ডিগ্রী আছে। কিন্তু প্রয়োজন রেফারেন্সের। আমাকে আর কিছুই যেন জিজ্ঞেস করার নেই তাঁদের। ইন্টারভিউ দিয়ে ঘুরলাম দুইদিন। উঠেছি রথীন্দ্র অতিথি গৃহ নামে রেস্ট হাউসে। এখানের অনেককিছু রথী করে গিয়েছেন। শেষকালে যখন ব্রহ্মপাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হল, এডমিন্সট্রেশন এর সাথে মন কষাকষিতে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলেন।

দেশে ফিরে গোছগাছ শুরু করলাম। মিমি সারাদিন প্রীতিকে আদর করে, আর বসে বসে বিদেশি এক কোম্পানিকে ফিজিক্সের নানারকম ম্যাটেরিয়াল তৈরী করে দেয়। স্লাইড, ভিডিও, এনিমেশন এসব। মজার ব্যাপার, ওদের পেমেন্ট আমাদের ভার্সিটির বেতনের কাছাকাছিই টাকা-পয়সা দিচ্ছে। দিব্যি চলছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম, কবে মেইল পাব বোলপুর থেকে।

আমরা যখন দেশে সবটা গুছিয়ে এনেছি, তখন জানা গেল, তারা সপ্তাহখানেক আগেই দুজনকে নিয়ে নিয়েছেন। আমার চাকুরি হয়নি। স্বপ্ন ভাঙ্গে কত সহজে!

চার.
আমার কষ্ট হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। কিন্তু মিমি ভেঙ্গে পড়ল। আর ওর ভেঙ্গে পড়া মানে পকেটে টান পরা। পত্রিকা থেকে আমি কতইবা টাকা পাই? টেনেটুনে চলতে লাগল। আমি গিয়ে এক প্রাইভেট ভার্সিটিতে চাকরির আবেদন দিয়ে এলাম। চলতে তো হবে। আমি কিংবা মিমি কখনোই কোন প্রাইভেট ভার্সিটিতে কাজ করিনিএবার সেই নৈতিকতাকে ছাড়তে হল। পেট বাঁচানো চাই। আগামী বছর প্রীতি স্কুলে যাবে, সেটাও ভাবতে হবে। এখন আর চালচুলোহীন থাকা যাবে না।

চলছিল বেশ। ধানমন্ডির ঐ ভার্সিটিতে যেদিন জয়েন করব, তার আগের রাতে শুয়েছি মাত্র, মিমি ডাকল। ওর চোখমুখে আনন্দের আভা দেখলাম যেন। কিন্তু বুঝবার উপায় কই? মুখ না খুললে আমার বোঝার যোগ্যতা নেই। হাতে তুলে দিল ওর ফোনটা। শান্তিনিকেতনের পাঠভবন থেকে মেইল। এটা বলছে, জনাবা হুমায়রা হক মিমিকে পাঠভবনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন গুরু হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
আমার মাথায় মূহুর্তে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল, জগতের সবচেয়ে সুন্দর নারী একটা আম গাছের তলায় বানানো বেদীতে বসে আছে, গায়ে এক প্যাচে পরা বাঙালি পদ্ধতিতে, লাল পাড় সাদা শাড়ি। আর চারপাশে বইখাতা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে। ছেলেদের পরনে বাসন্তী রঙের জামা, সাদা পাজামা। মেয়েদের বাসন্তী শাড়ী!
আমি চেঁচালাম, সিরিয়াসলি!
মিমি হাসিটাকে প্রসারিত করে লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল, আবেদন করেছিলাম তোমায় না জানিয়ে।
আনন্দে আমি মিমিকে জড়িয়ে ধরলাম। সহজাত অভ্যাসের বশেই যেন মিমি আমাকে ঠেলে দিয়ে বলল, এই যাহ!
আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, আমার কপট রাগ আর খানিকটা অভিমান মেশানো দৃষ্টিতে। এই দৃষ্টিটায় কী যেন আছে। মিমি মিষ্টি করে হাসল ঠোট টিপে। আলতো ডিমলাইটের আলোতে আমি আবারো এগিয়ে যাচ্ছিলাম আরেকটু বেশি ভালোবাসা দেখাতে, ঠিক তখনই প্রীতি ঘুম ছেড়ে উঠে বসল। 'মামনি, পানি!' ওর তীব্র স্বর আমাদের দুজনকে ছিটকে দূরে ঠেলে দিল।