বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭

জলমগ্ন

ছবিঃ সংগৃহীত

সরসর শব্দ তুলে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা। পেছন থেকে যে ছোকরাটা ভ্যানটাকে ঠেলছে, পানি তার কোমর ছুঁয়েছে। কোমরটা যে তার বেশ নিচুতে, তা মানতে অস্বস্তি নেই। হুঁ, আবদুল মিয়া যে খাটো, মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি, তা মানতে দোষ নেই। ভ্যান এক আজব বাহন এই শহরে। শীতের মরশুমে এরা লাগে বাড়ি পাল্টাতে, নতুন আসবাব ঘরে পৌঁছে দিতে। আর বর্ষার মরশুমে এরা জলের বাহন। জলের দু ধারে সারি সারি জেগে ওঠা ঘরবাড়িতে পৌঁছে দেয়া এই ভ্যানের কাজ। স্রোতহীন ঢেউ ওঠা শহরের রাস্তায় ছুটে বেড়ায় নানা কিসিমের বাহন। কোনটা যন্ত্রে চলে, কোনটা ঠেলে নিতে হয়। তবে সওয়ারির ভরসা যন্ত্রহীনগুলোতেই। সিএনজির গলুইয়ে পানি উঠে পরে, মাঝপথে সাপের মত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায়, তাতে কে বা উঠতে চায়? ভ্যান আর রিকশা, এই শহরের জলে-স্থলে ছুটে চলে অবিরাম। আর জল মাপার জন্য আজকাল কি আর সিন্দাবাদ আছে যে লগি ঠেলে চেঁচাবে, "এক বাও মেলেএএএ না, দেড় বাও মেলে না...!"

কেউ হোন্ডা, কেউ মাইক্রো নিয়ে নেমে পরে জলের একধার থেকে। কিন্তু এ সমুদ্রের ঠাই কোথায়, তার তো জানা নেই কারোই। একটু দূর যেতেই পানি উঠতে উঠতে যখন ইঞ্জিন ডোবে, তেলের ট্যাংক ছোঁয়, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে মেশিন নিশ্চুপ হয়, তখন চালকের দুঃসাহসী মন প্রথমবারের মত দমে যায়। মনে মনে ভাবে, মিসটেক হয়া গ্যালো। দূর স্বর্গলোক থেকে কবিগুরু ফিসফিস করে চালকের কানে কানে বলেন, জপো, এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা। কিন্তু চালকের মন বোঝে না। পরদিন সে অন্য রাস্তায় অন্য কোন খাদে পতিত হয়ে কবিগুরুর ফিসফিসানি শোনে। বছর ঘুরে আবার বর্ষা আসে, আবারও কবিগুরুর মন্ত্রধ্বনি কানে বাজে।

এ শহরের সবচেয়ে বিচক্ষণ সেই সব লোকজন, যারা বাসায় পৌঁছতে নেমে পড়েন গোড়ালিতক পানিতে, একটু পর সেটা বাড়ে। পথ এগিয়ে যায়, সেটা আরও বাড়ে। কারো বাড়ি পৌঁছতে সেটা হাঁটুজল হয়, কারো বাড়ির হদিস মেলে কোমরজলে। তাঁদেরকে যখন বাড়ির লোকজন উপহাস করে বলে, কয়টা টাকা বাঁচাতে এই এতখানি পানিতে নেমে পড়লি? মুখ গোমরা করে তারা উত্তর করে,
নামার সময় তো দেখেছিলাম গোড়ালি পানি। পরে যে সেটা কোমর ছোঁবে, তা কে জানত?
না, লোকটা নেমেছে, আর পানি সরসর করে বেড়ে গেছে তা নয়। দোষ ঐ লোকেরই, সে কেন হাঁটতে গেল? যত এগিয়ে যাবে, পানি তো তত বাড়বেই। তবে ধীর স্থির দুই বন্ধুর গল্প না বললেই নয়। লম্বা এক রাস্তার এক মাথায় মাঝারি বৃষ্টিতে তারা চলতে শুরু করেছিল। ভিজতে নিষেধ দুজনেরই। তাই মাথার ওপর দুজনই ধরেছে এটলাস ছাতা। বৃষ্টি তাদের ছোঁয় না, তবে বৃষ্টির জল ছোঁয়। আগে সেটা জলাধারে (তথাকথিত রাস্তা) পরে, এরপর পা ছোঁয়। রাস্তার কোন একখানে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগল আধঘণ্টা। কারণ মাঝপথে এক ডুবন্ত চায়ের দোকানে তারা চা খেয়েছে, জলের ধারের মুদি দোকান থেকে একজন তেজপাতা, অন্যজন বুটের ডাল কিনেছে। গন্তব্যে যখন পৌঁছল, তখন বৃষ্টি থেমেছে। তারা ছাতা বন্ধ করল, নীল দেয়া শাদা কলেজ শার্ট খটখটে শুকনো, ইস্ত্রি করায় সেগুলোতে চেকনাই ধরেছে, কিন্তু প্যান্টের হাল দেখবার উপায় নেই। সেটা তখন জলমগ্ন।

আরেক তরুণ-তরুণীর গল্প। দুজনে এল এক রাস্তার ধারে। তরুণের বাড়ি জলপথের ওপারে, আর তরুণীর বাড়ি মাঝপথে এক গলিতে, তখন জলমগ্ন। তরুণী স্মিত হেসে হাত নেড়ে বলল, টাটা! এরপর সপসপ শব্দ তুলে গোড়ালিজলে ভ্রমণরত হল। এক বৃদ্ধ দেখে হায় হায় করল। তরুণ ঢুকল সুপারশপে। বিশাল সাইজের একটা পাঙ্গাশ মাছ কিনে ডাকতে থাকা 'পানি পার... পানি পার...ভ্যানে চড়ে বসল হাঁটু গেড়ে। ভাবালু বৃদ্ধ এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। তরুণের হাতে বিশাল সাইজের মাছ দেখে তার হায় হায় অস্ফুট চিৎকারে রূপ নিল। তরুণ হাসল। হাসল আর ভাবল, ধরি জোড়া মাছ, না ছুঁই পানি।

কবিগুরু স্বর্গলোক থেকে আওড়ান, পার হয়ে যায় ভ্যানগাড়ি...

দক্ষিণের মানুষ হয়ে এই শহরে থেকে একটা খটকা আমার ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে হাঁটুজল নদীর বর্ণনা দিয়েছেন, সেই নদী তিনি কোথায় পেলেন? নদী থাকুক , দক্ষিণের ছোট ছোট খালগুলোও সর্বোচ্চ ভাটিতে মাসের অধিকাংশ সময়ে হাঁটুজলের চেয়ে অনেক বেশি পানি থাকে। নৌকা চলাচলের কোন বিরাম লাগে না সেখানে। মাসের ১ম আর তৃতীয় কোয়ার্টারের শেষে হয়তবা ছোট্ট কোন খাল এ হাঁটুজল হতে পারে। সেখান থেকেও নৌকা এগিয়ে চলে ঠিকঠাক। তবে হাঁটুজলে নদী আবার কী? আবার এই শহরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসেবে মাঝারি বৃষ্টির সময়েই জল কোমর ছাড়ায়। তবে হাঁটুজলের নদী? সে কি শুধুই কবিমনের কল্পনা? না, ওসব উত্তরে পাওয়া যায়। যদিও এই রাস্তাকে নদীর সাথে তুলনা করা ভুল। এ জলাধারে জোয়ার ভাটা হয় না। একে ভালো তুলনা চলে ঝর্ণার সাথে। পানির একমুখী চলন এখানে। এ যেন বৃদ্ধা নদীকে শহরদেবতার দেয়া বর। সারা মরশুম ধরে শহরকে  জল দেয় বৃষ্টি, আর রাস্তায় সেই জল সংগৃহীত হয়ে সুয়ারেজ ধরে পৌঁছে যায় নদীতে। তবে নদীর সাথেও তুলনা চলে। গোমতী নদী। কুমিল্লার দুঃখ বলে সবাই জানে একে। তেমনি এই জলও যে লম্বা একটা সময় ধরে স্থির থাকে, তাই এর নাম হতে পারে ঢাকার দুঃখ। বিজন গ্রামের মেঠোপথ হয় কবির দুঃখ, এঁকেবেঁকে যা চলে যায় বহুদূর, তেমনি এটি শহরের দুঃখ, নাগরিকের দুঃখ নিয়ে স্থির হয়ে থাকে আড়াই মাস।

এক শহরের রাস্তায় নৌকা সার্ভিস চালুর কালে সড়ক যোগাযোগ আপিস এর বড় কর্তা বলেছিল, "রাস্তার নিচে যে পানি, সেটা নিয়ে কারবার মেয়রের সিটি কর্পোরেশনের। ওসব সুয়ারেজের ব্যাপার। কিন্তু রাস্তার ওপর যে পানি, সেটা নিয়ে ভাবার জন্যই তো সড়ক ও যোগাযোগ কর্পোরেশন।" কিন্তু আমাদের এই শহরের লোকজন বড় অবুঝ। তারা রাস্তার নিচের ব্যাপারস্যাপার নিয়েও গালি দেয় সুয়ারেজ কর্তৃপক্ষকে, রাস্তার ওপরের কারবার নিয়েও গালি দেয়ায় সুয়ারেজ কর্তৃপক্ষকে। আরে বাবা! রাস্তাটাকে কি সুয়ারেজ পেয়েছ?

কবি আল মাহমুদের এক গল্প আছে, 'জলবেশ্যা' নামে। সেই দেহপসারিণী থাকত মেঘনার এক নৌকায়। এই শহরেও চালু হতে পারে শহুরে জলবেশ্যা। যার পরিচয় দিয়ে বলা যাবে শহুরে জলে কারবার যে বেশ্যার। কিন্তু কোন ভাবালু যদি প্রশ্ন করে, কোন জল? রাস্তার ওপরে যে জল, নাকি রাস্তার নিচে যে জল?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন