রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আনন্দভ্রমণে

 দূর-দূরান্তে ঘুরবার আগ্রহ আমার বহুকালের। কখনো একলা ঘুরতে ভালো লাগে, কখনোবা অনেকের সাথে। শুধু দূরে নয়, দিনভর আশেপাশে কাজে-অকাজে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটাও আমার খুব বেশি। কম খাওয়া, না খাওয়া আমার প্রায় শূন্য ওজনের একটা কারন হতে পারে, তবে অন্য কারণটা হল দিনভর ছুটে বেড়ানো। যা খাই, তার অনেকটা দখল করে নেয় আমার ভ্রমণপিয়াসু কর্মকান্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যায়ন এর শুরু ২০১৭ সালের শুরুতে। আর জানুয়ারিতেই একটা পিকনিক পেয়ে যাওয়া রীতিমত অভাবনীয়। অল্প কয়জনের দেখলাম আগ্রহ নেই এটা নিয়ে তেমন। বাকিরা সবাই মুখিয়ে থাকলাম পিকনিকের তারিখের জন্য। উপরি পাওনা দুদিনের ছুটির ব্যপারটাও মাথায় ছিল সবার। এবং এজন্য যে অতি অপ্রিয় দুটি ক্লাস মিস হবে, সে আনন্দও সচেতনভাবে পাচ্ছিলাম।

আমরা প্রায়ই টিএসসিতে বসি আড্ডা দিতে। সে আড্ডা কখনো বারান্দায় পা বিছিয়ে, কখনো ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে গোল হয়ে, কখনো বাইরের পার্কিং লটে, কিংবা ভেতরের লনে বসে। সে আড্ডায় সব বিষয়কে ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আসে বন্ধুকে রসাত্মক আক্রমণ। সে আক্রমণের বিষয়বস্তুগুলো সবসময়েই হয় নির্মম, এবং কখনোবা ছাপার অযোগ্য। এছাড়া পড়াশুনার কথা, বইয়ের কথাও কখনো ঘুরেফিরে উঁকি দেয় আমাদের আড্ডায়। সে আড্ডার প্রতিটা মূহুর্ত সবার জন্য আনন্দ উদ্দীপক। আমরা পিকনিকের জন্য মুখিয়ে ছিলাম, হয়তবা পিকনিকে এই আড্ডার আনন্দের বিস্ফোরিত রূপ কপালে জুটবে বলে।

দিনটি ছিল ২৩ জানুয়ারি, প্রথম বর্ষের ছেলেপুলেকে আসতে বলা হয়েছে ভোরবেলাতেই। আমাদের সেসবের বুঝি তেমন তোয়াক্কা ছিল না। হেলেদুলে দুজন, চারজন করে এসে জড়ো হতে লাগল অনেকটা সময়। এসেছেন শিক্ষকেরা, বড়রাও। সবাই মিলে বাসে ওঠার আগে বাধ্যতামূলক ফটোসেশন। অবশ্য সেটাকে সেলফি সেশন বললে তেমন অপরাধ হবে না। এর ফাঁকে পিলো পাসিং খেলার জন্য আনা বালিশটা ধার করে আমি আমাদের ভবনের নিচতলার ওয়েটিং বেঞ্চিতে ঘুমাবার আয়োজন খুঁজি। কিন্তু শোয়ার একটু পরেই এক বেরসিক ছেলে এসে জানায়, বালিশটা এক বড় আপুর বাসা থেকে আনা। কোথায় কী! আমি বালিশ নিয়ে ভো দৌঁড়। রিংকিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলি, আমি ভেবেছি বালিশটা তোর। এরপরে সবাই মিলে সেলফি তুলতে শুরু। মেয়েদের কেউ শাড়ি না পরায় আমিও পাঞ্জাবি পরিনি। তবে আয়াত সেসবের তোয়াক্কা না করে ঝলমলে পাঞ্জাবি গায়ে হাজির। তখন মনে হল, আমি কী দোষ করেছিলামরে বাবা!

সেলফিতে মেয়েরা দেখা দেয় শহরের সকল আটা-ময়দার সংগ্রহ নিয়ে। আর আমরা প্রায় সবাইই এলোমেলো সেই ভঙ্গিতে। মিলনের ব্যাগ থেকে বেরোয় সেলফি-স্টিক নামের অতি অদ্ভুত এক উদ্ভাবন।


হ্যারি পটারের জাদুর লাঠি, স্পেলটা হল ক্লিক!
দরোজার সামনে, বাসের সামনে নানা ভঙ্গিতে তোলা হয় আরো অনেক ছবি।
যার মুখ নেই, তার আছে হাত

যে সিটিং সার্ভিসে হাফ পাশ আছে।

মীমের ঘাড় কাত কেন, প্রধানমন্ত্রী জবাব চাই!
পুষ্টি ভবনের সামনে থেকে বাস ছাড়তে বাজে সকাল আটটা। আমরা ততক্ষণে শত শত সেলোফই তুলে ফেলেছি। বাসে উঠে প্রথমে চলে সিট দখলের লড়াই। সবার সামনে শিক্ষকেরা বসেন। আমরা পারলে রিয়ারভিউ মিররটা খুলে ফেলতাম, পেছনের অসভ্যতা তাদের চোখ এড়াতে। সেটা সম্ভব নয়। আর সতেরতম ব্যাচের ভাই আপুরা উঠে পেছনটা দখল নেয়ার পরে আমরা হয়ে যাই স্যান্ডউইচ। মেয়েরা বাসের পশ্চিমপাশ দখল নিলে ছেলেরা যাই পূব পাশে। আমি আর আয়াত, দুই ভদ্র ছেলে বসি দুপাশে। তখন কে জানত লোকাল বাসে সিটে বসা অপরাধ? একটু পরে উঠতে হয় সব ভদ্র-অভদ্রকেই। লাফাতে লাফাতে চলে গাজীপুরের শ্যামলী পিকনিক স্পটের উদ্দেশ্যে যাত্রা।

পুষ্টির বাসে সকালের নাশতা যেমন হওয়া উচিৎ তেমনই ছিল। কলা, সিদ্ধ ডিম, বার্গার (ধরে নেয়া যায় ওটা বার্গারই ছিল)। খেয়েদেয়ে শুরু হয় গানবাজনা। তার আগে সবার পরিচিতি। দেখা গেল বাসভর্তি বরিশাইল্যা আর বগুড়ার ছেলেপুলে। আমি খাওয়াদাওয়ায় তেমন পটু নই, সেটার প্রমাণ আমার শরীর। কিন্তু সেদিন কী যেন ভেবে এক হালি ডিম একলা খেলাম। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে সবচে মজার অভিজ্ঞতা হয়তবা মীমের মাথায় ডিম ভেঙ্গে খাওয়া। সারাদিন জুড়ে আমার বিখ্যাত দুটি ডায়লগ ছিল। একটি হল "মীমের মাথায় ডিম ভেঙ্গে খাইছি"। আর অন্যটা হল, "যে ছবিতে মুই নাই, হেই ছবি ডিলেট"
বাসেও চলে নাচ-গান আর সেলফির হুড়োহুড়ি।
কী হে! বোতাম ঠিক করো?

বেশি করে ভিটামিন এ খাবা অন্ধের দল!


থ্রী স্টুজেস!

দাঁতে পোকা!

ডিম আমি খামুনা ভাইজান!
সিট খালি নাই

তানজির তোমার চুল(!) বেয়াদবের মত কেন?

রিন্তু, ক্যামেরা তো ঐদিকে না!

স্টেডিয়ামের টিকেট আমি পেয়ে গেছি বেলা, শুনছ?

"বল দাও, মোরে বল দাও"-কবিগুরু

গরুর চারণভূমিতে আমরা

প্লেটের তলা দিয়েও বুঝি খাবার বের করবি, শ্রাবণ?

খাটোরা বসে, লম্বারা দাঁড়িয়ে

মিলন, ইহা পলান্টুক খেলা নয়

বাসের সময়টা ছিল অন্যতম আনন্দের কাল। লাউডস্পিকারে বাজছিল সব গনগনে শব্দের মিউজিক, হিন্দি গান। আমি নাচে অপটু, কোনদিন পায়ের ওয়ান-টু ওয়ান-টু স্টেপও দিয়ে দেখিনি। অথচ এখানে আমাকেও নাচতে বাধ্য করা হয়। সে নাচের সেকাল একাল নেই। সেটা খানিকটা বক্সিং এর সাথেও সাদৃশ্যপূর্ণ। যেসব গান আমি কোনদিনও শুনিনি, কিংবা রাস্তায় হাটতে চলতে নানা অনুষ্ঠানের লাউডস্পিকারে শুনেছি, সেসবই বেজেছে সারাদিন। তাতে কী? আমি আমার মত করেই উৎসাহ নিয়ে লাফিয়েছি।

নাচের কথা আসলে কয়েকটা নাম ভোলা যাবেনা। সুদীপ্ত শ্লা একটা জাত নাচুনে। সে কি নাচ! আর ছিল মিলি, অন্তরা, যূথীর নাচ। শ্রাবণ, মিলন, যায়েদের নাচও ভোলার না। একটা সময় নাচ এতটা উদ্দীপ্ত পর্যায়ে পৌঁছল যে আশেপাশের সব বাস থেকে যাত্রীরা পরম উৎসাহে উঁকি দিতে শুরু করল। আমরা পর্দাগুলো টেনে দিলাম। কেউ একজন নইলে হয়ত ভিডিও করে অনলাইনে দিত, দেখুন ঢাবি ছাত্র-ছাত্রীরা বাসে কী করে (ভিডিওসহ)

চলতে চলতে মাঝে মাঝে আমাদের অন্য বাস এসে থামত পাশে। আর আমরা সেখানে উঁকি দিতাম, হাত নাড়তাম। তবে কখনো কখনো ঝামেলা হত খুব রাগী একটা স্যার যখন জানালার ওপাশে এসে থামতেন। আমরা পর্দা টেনে মুখ লুকতাম তখনো।

এই জ্যামের শহর ছেড়ে বের হতে সময় লেগেছিল অনেক বেশি। যখন সেখানে পৌঁছলাম, দেখলাম একটা ছোট্ট পিকনিক স্পট আমাদের গন্তব্য ছিল। সেখানে আছে কিছু গাছ, একটা বাঁধানো চৌবাচ্চার মত পুকুর। সারাদিন সেখানে ছিল নানা আনন্দের উপকরণ। খেলাধুলা ছিল কিছু। ছেলেদের জন্য সুতায় সুঁই লাগানোর মত অদ্ভুত খেলাও ছিল।
হাতি ওড়ে পাখি ওড়ে খেলা দিয়ে আমরা অন্তরার কাছ থেকে জানলাম, বরিশাইল্যা মশা ওড়ে না! 
আফা দেইখ্যা লন, একদম কিলিয়ার। কোন ছেড়াফাটা নাই।

 
একদাম তিনশ'!

মাথার চুল কাকে খেয়েছে!
নাম তার শাহনেওয়াজ!

দুপুরের খাবারটা খাবার অনুযায়ী আহামরি ছিল না। তবে ইভেন্টের কাচ্চি হিসেবে ঠিক ছিল। যে কোনরকম ইভেন্টে খাবার নিয়ে হতাশ হতেই হয় সবসময়। এখানে অতটা খারাপ হয়নি। আর আমি যেহেতু চেয়েছি মোটা (!) হব, তাই আর কী করার, খেলাম পেট পুরে। জানুয়ারি মাসে আমার ওজন বেড়েছে এক কেজি। পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে অনার্স করতে যদি আমার লাগে ৪৮ মাস, তবে আমার এতে ওজন বাড়বে আটচল্লিশ কেজি। তখন আমায় পাবে কে!


কী ব্যাপার! শুধু ছেলেরা কেন?


ফেরার যাত্রাটা বড় দীর্ঘ ছিল। ভেবেছিলাম আসার পথে সবাই থাকবে ক্লান্ত, চলবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু ক্লান্তির তোয়াক্কা না করে সেই একই উদ্যমে চলে নাচানাচি। আমি ফিরতি পথে কিছুক্ষণ লাফিয়ে প্রায় চুপই হয়ে যাই। কোত্থেকে যেন মীমের সাথে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে গল্প শুরু হয়। সেই গল্প চলতে থাকে যাত্রার শেষতক। মাঝে মাঝে আমি উঠে গিয়ে সবাইকে জ্বালিয়ে আসি শখমত।
সুঁইয়ে সুতা ঢোকানোর খেলায় একটা পুরষ্কার ছিল নেলপালিশ। ছেলেদের নখে মাখা হয় সেটা। আমাকেও বলা হয় মাখবার কথা। আমি দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে বসে থাকি। আর আল-আমিন, যে দুটো পুরষ্কার পেয়েছিল, একটা ফেসিয়াল টিস্যু, অন্যটা টয়লেট টিস্যু, সে যাত্রার ধকলে জানালার পাশে বসে থাকে চুপচাপ।
মীমের ঢাবি থেকে পাশ করার পর একটাই শখ, বিয়ে করা। আর কিছু নিয়েই তার মাথাব্যাথা নেই। বিয়ে বিয়ে বিয়ে! আমরা আশীর্বাদ জানাই, ওর যেন এক গণ্ডা বিয়ে করার ভাগ্য হয়।

বাসটা যখন পুষ্টি ভবনের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন রাত দশটা প্রায়। মেয়েদের মধ্যে এক মীমের বাসায় যাওয়া হয়নি। ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন সব শিক্ষকেরা। আমরাও দাঁড়াই দু-তিনজন। শেষে ওর খালাম্মা এসে ওকে নিয়ে যান, আর আমরা ধরি বাসার পথ। কার্জনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আবার কবে সবে মিলে ঘুরতে যাব?

1 টি মন্তব্য:

  1. আহা! আহা!
    বেশ লিখেছো।
    বর্ণনার সাবলীলতা আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছে।
    :')

    উত্তরমুছুন