শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭

সিরিঞ্জ


'হ্যালো রুদ্র!', ফোনের ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর।
রুদ্রের মনে পড়ে যায় অনেক পুরনো একটা বাক্য। 'তুমিইতো রুদ্র, যে দৌড়াতে পারে'। একজনের পরিচয় হিসেবে দৌড়াতে পারা বেশ অস্বস্তিকর। রুদ্রের একটা পদক আছে জাতীয় স্প্রিন্টে। তাই বলে দৌড়াতে পারে- এমন করে অপরিচিত একটা মেয়ে বলে বসলে বিরক্ত হবার কথা তার। কিন্তু রুদ্র বিরক্ত হতে পারেনি সেদিন। তবে আজ সন্ধ্যার একটু পরে ব্যাচেলর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়া সেই পুরনো কণ্ঠস্বর কিছুটা বিরক্তি জাগায়। রুদ্র ছোট্ট করে উত্তর করে, 'বলছি'। ওপাশ থেকে টেনে টেনে কণ্ঠস্বর বলে, 'আমি মিলি'। মিলির পরিচয় ঠিক এখানে শুরু নয়। ফিরতে হবে সেই দিনে। সেদিনও একটা কণ্ঠস্বর ছিল এই মিলি। পেছন থেকে বলেছিল, 'তুমিইতো রুদ্র, যে...'। সেটা ছিল বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র উৎসব, পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান মিলনায়তনে। চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্র, আর পেছন থেকে ডাক শুনেছিল মিলির। আজ যেমন 'চিনেছি' বলার আগে বিরক্তি কাটাতে রুদ্র একটু সময় নেয়, সেদিনও এরকম সময় নিয়েছিল। কৌতূহল কাটাতে। এরপর ধীরে ধীরে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, 'হ্যাঁ। এবং আমি হামাগুড়ি দিতেও জানি'

'মার্কস লোকটা কেমন?' ফোনের ওপাশ থেকে কথা শুরু হয়।
একটা রাষ্টবেত্তাকে বিচার করার জন্য রুদ্রের হাতে খুব সময় থাকে না। শীঘ্রই তাকে বলতে হয় যে লোকটা জ্ঞানী ছিলেন। এবং তার জানা ছিল, ওপাশ থেকে মিলি বলবে, 'তাকে নিয়ে একদল মানুষের বিস্তর আপত্তি আছে'। রুদ্র এও বুঝতে পারে, ঠিক তেমন কোন প্রয়োজন মিলির নেই, এই এতদিন পর ফোন দেয়ার। তাই ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কাঠখোট্টা আলাপ দিয়ে কথোপকথন শুরু করা হয়েছে ওপাশ থেকে। মিলি বেশ জানে মার্কস এর ব্যাপারে। এই এটা হয়ত মিলির স্বভাবের মধ্যে পরে। নইলে প্রথম পরিচয়ের দিনটায়, ঐ অমূলক প্রশ্নের উত্তরে রসিক জবাব পেয়ে না হেসে বলত না, 'আজ বেজায় গরম পড়েছে!' অথচ সেদিনের তাপমাত্রা ছাব্বিশ ডিগ্রীর বেশি ছিল না, রুদ্রের মনে পড়ে। এরপর মিলি বলতে থাকে আজ হরতালে কেমন করে সে ইটের টুকরাগুলো ছুড়ে দেয়ার পর একটা সময় পুলিশেরা কাঁদানে গ্যাসের ওপরে ভরসা ছেড়ে লম্বা ধাওয়া করে। মিলিকে যখন তিনটে পুলিশ টেনে ধরে গাড়িতে তুলতে চেষ্টা করে, তখন মিলি থুথু ছোড়ে সেই পুলিশটার ওপর, যার হাতে ওয়াকি-টকি ছিল, এবং সেই পুলিশ কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ছেড়ে দেয় মিলিকে। অন্য দুজন, যারা টানাহেঁচড়া করছিল, তারাও ছাড়ে মিলির হাত। পুলিশের হেলমেটের কাঁচে লেগে থাকা সে থুথু মুছে না ফেলেই সেই পুলিশ মনযোগী হয় অন্য একজনকে গ্রেফতার করতে। এসব অর্থহীন কথা নয়, তবু রুদ্রের কাছে তাই মনে হতে থাকে।

মিলি বলে, 'তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না আমি হরতালে ছিলাম!' রুদ্র মাথা ঝাঁকায়, বিরক্তিভরে। মিলি সেই মাথা ঝাঁকানো দেখতে পায় না। তবু বলতে থাকে, 'এরশাদের কথা মনে পড়ছে'। রুদ্রর কিন্তু এরশাদের কথা মনে পড়ে না। তার কাছে সবসময় লাগত এরশাদ লোকটা নির্লজ্জ, সেই লোকটার মত, যে লোকটা ফার্মগেট থেকে আসাদগেট হেঁটে আসার পথে প্রতিদিন রুদ্রের সামনে পড়ত সংসদ ভবনের কোণে, রেট ছিল দেড়শ টাকা। ঐ দালালের মত ভাবতে শুরু করেছিল একসময় রুদ্র এরশাদকে। কিন্তু সেই নির্লজ্জতা রুদ্র দেখতে পায় না আজকাল। আর রুদ্রের ওসব কিছু এই মূহুর্তে মনেও পড়ে না, যেসব মনে পড়ছিল মিলির। রুদ্রের মনে পড়ে একটা নীল ভ্যানের কথা, যেটাতে করে তাকে প্রথমবার কারাগারে নেয়া হয়। সেসময় জ্যৈষ্ঠ মাস চলছিল, আর বেজায় গরম ছিল। সেই যাত্রায় সে জোগাড় করে এনেছিলো কিছু ম্যালেরিয়া ভাইরাস।

'আজ দৌড়াতে গিয়ে একটা ইটে লেগে নখ ভেঙ্গেছে।' মিলি বলে আলতো স্বরে। 'ডান পায়ের অনামিকা', যোগ করে মিলি। চুপ থাকে দুজনে। বসে বসে নিস্তদ্ধতা শোনে দুজনে। মিলির মনে পড়ে যায় তার জন্মের দিনটার কথা। ডাক্তার প্রচুর চেষ্টা করেও রক্তের স্রোত থামাতে পারেনি। সবকিছু ভেসে গিয়েছিলো। মিলির বাবা, সেই রক্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলেছিলো, 'মেয়ে আমার অপয়া'। আলতো চিৎকার করে কাঁদছিল মিলি। মা হারানোর দুঃখ কয়েক মিনিট বয়সের শিশু বোঝে কিনা কে জানে! সদ্যজাতের কান্না দেখতে পৃথিবী ভালোবাসে, তাই হয়তবা মিলির কান্না থামতে অনেক বেশি সময় লাগছিল। সেসব ভেবে বুঝি মিলি বলে, 'রক্ত ঝরছিল'। ব্যান্ডেজের কথা জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন, মনে হয় রুদ্রের। আর মনে পড়ে অপয়া মেয়েটার বাবার কথা। পায়ের ধমনি ছিঁড়ে গিয়েছিলো যার, সাইকেলের ছোট্ট দূর্ঘটনায়, আর প্রচুর রক্ত ঝরছিল। ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে একটা টেবিলে শুয়ে রক্ত দিয়েছিলো রুদ্র। মনে পড়তে থাকে, পরের কয়দিন প্রচুর আঙ্গুর, বেদানা, মাংস খেতে হয়েছিল রুদ্রকে। সেসব প্রচণ্ড বিস্বাদ লাগতে শুরু করেছিলো সপ্তাহ দেড়েক পরে।

রুদ্রের মনে পড়ে সেদিন নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা তোপখানা রোডের বাসায় গিয়েছিলো সে। দাঁড়ি ছেটে লম্বা গোসল দিয়ে ঘুমিয়েছিলো, কয়েক সপ্তাহের ক্লান্তি দূর করতে। দরজার করাঘাত ঘুম ভাঙ্গানোর পর সেই বন্ধুটিকে দেখতে পেয়েছিলো রুদ্র, যার কাছ থেকে মিলি রুদ্রকে জেনেছিলো, এবং প্রথম দেখাতে জিজ্ঞেস করেছিল, সে সেই দৌড়ানো মানুষটি কিনা। রিকশা নিয়ে মেডিকেলের পুরনো ভবনে পৌঁছানো আর রক্ত দেবার কথা ভাবতে ভাবতে রুদ্র সেই কঠিন প্রশ্নটি শুনতে পায়, যেটি শুনতে শুনতে রুদ্র ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, এবং মুক্তি চেয়েছিল মিলির কাছ থেকে। অনেকদিন পর সেই প্রশ্নটি শুনতে শুনতে রুদ্র নাক টানে। মিলি আবারো জিজ্ঞেস করে, 'আজও ড্রাগ নিয়েছ?'

রুদ্রের চুপ থাকাটা নিস্তদ্ধতা নয়। সে ভাবতে থাকে এর পরের মাসটার কথা। রুদ্র শিঘ্রী ম্যালেরিয়া থেকে সুস্থ হয়েছিলো, এবং সেই লোকটা, যে নিজের একমাত্র মেয়ের জন্মলগ্নে তাকে অপয়া বলেছিলো, সেই লোকটা রুদ্রের রক্তে পাওয়া জীবনে বেঁচে উঠেছিল, আর অল্প কয়টা জীবাণুকে পুঁজি করে এর কয়দিন পরে তার মৃত্যু হয়েছিলো। মেডিকেলের ডাক্তার সেদিন সন্ধ্যায় কেন খুঁজে পাননি রুদ্রের রক্তে ম্যালেরিয়া, আর অম্লান বদনে সে রক্ত কেমন করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন লোকটার গায়ে, তা ভাবে রুদ্র।

লম্বা করে নাক টেনে রুদ্রের মনে পড়ে আরো একটি কথা, যখন মিলি বলে, 'আমি এখনো অপেক্ষা করি'। কুচকুচে কালো ছিল গায়ের রং সেই লোকটার। পায়ে, গোড়ালির একটু ওপরে ছিল বড় একটা ক্ষত। সেই লোকটাও মারা গিয়েছিল পরের মাসটায়, ম্যালেরিয়ায়। কারাগারে বসে প্রথম কয়টা দিন বাইরের আন্দোলন, পাঠক সমাবেশ, ডাকসুর আড্ডা, মিলি- সবকিছুকে ভুলতে চেষ্টা করত রুদ্র। আর তখনই মাথা জট পাকাতে শুরু করেছিলো রুদ্রের। আর সেই জট খুলতে এগিয়ে এসেছিলো লোকটা, যে একসময় রিকশা চালাত। একটা সিরিঞ্জ দেখিয়ে বলেছিলো, 'ভাইজান নিবেন নাকি? চোখ খুলতে আফনাগো ভার্সিটি পড়ন লাগে না। এই একটা সুঁইয়ের গুতা দিবেন...' আরো অনেক কিছু বলেছিলো সম্ভবত পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা লোকটা। সেসব কানে ঢুকেছিল কিনা তাও মনে পড়েনা রুদ্রের। মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন জানতে পারে, মিলির বাবার ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর কথা।

আবারো লম্বা করে নাক টানে রুদ্র। ফোন কানে চেপে। মনে পড়ে, ম্যালেরিয়ায় রুদ্রের মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু হয়েছে আরও আগে, যেদিন ও সেই সিরিঞ্জটা নিয়েছিলো, সেদিন ও ভুলেছিল লাইব্রেরী, নীলক্ষেত, আর্ট ফেস্ট, সমাজতন্ত্র সব। নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে থাকে রুদ্র। আর সেই সিরিঞ্জটার কথা, যেটি তিনটে খুন করেছিলো।
'রাখছি', আস্তে করে বলে ওপাশের কণ্ঠস্বর।