বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাকরি যাওয়ার পর


ছবিঃ pinterest থেকে সংগৃহীত মুক্ত ছবি

এক.
লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ এর মতন। ঠিকঠাক বোঝার উপায় নেই। মুখভর্তি ছেটে রাখা দাঁড়ি, পোড়া তামাটে রংয়ের চামড়ায় ঠিক থুতনির কাছে একটা গভীর দাগ। শুকনো মুখের সাথে ছোট ছোট চুলগুলো মলিনতা প্রকাশ করছে। তার নাম আবুল কালাম।

আজ তার পরনে আছে একটা কালো ফুলপ্যান্ট, লাল-কালো একটা শার্ট। বহু পুরনো শার্টটায় কিছু দাগ আছে, আর দুয়েক জায়গায় ছেঁড়াও আছে। তবে ছেড়া জায়গাগুলো তার স্ত্রী এমনভাবে কায়দা করে সেলাই করে দিয়েছে যে বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে শার্টটা শেষ কবে ইস্ত্রি করা হয়েছে, আদৌ কখনো করা হয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছেনা।

আজ তার চাকরি গেছে। সে ছিল 'দি নিউ বাইন্ডিং এজেন্সি' এর সেলস ম্যানেজার। এই প্রতিষ্ঠানে দুটিমাত্র পদ। ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সেলস ম্যানেজার। এর সঙ্গে একজন কুলি হল এখানকার সর্বমোট মানবসম্পদ। অফিসটা আরামবাগের একটা ঘুপচি গলির শেষমাথায়, ছোট্ট এক রুমের। দুই কোনে দুটি টেবিল, আর স্তুপ করে রাখা প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, ওষুধের বাক্স, মেমো। এই অফিসটাই একইসাথে এজেন্সির স্টোররুম। এজেন্সির ম্যানেজিং ডিরেক্টর শামসুদ্দিন মোল্লা একজন ভুঁড়িওয়ালা বেঁটে লোক। মাথায় টাক থাকলে তাকে ঠিক মানিয়ে যেত সিনেমার এমন চরিত্রের সঙ্গে। কিন্তু
তার মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। এই এজেন্সির সেলস ম্যানেজার কালাম রোজ ঘুরে ঘুরে কাজ সংগ্রহ করে আনে, তারপর অফিসের পাশের প্রেসদুটোয় কাজটার অর্ডার দিয়ে দেয়। শুধু স্টিকারটা করতে হয় পাশের রোডের এক প্রেসে। এখানে ওটা একটু বেশি রেট বলে।

চাকরি যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত, বোঝা গিয়েছিল দিন তিনেক আগেই। একটা চালান ফেরত এসেছে, এবং দোষটা আবুল কালামেরই। এলাকার সাবেক সাংসদ একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল করেছে, যার প্রচারণা তার বড় প্রয়োজন। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দুই হাজার পোস্টার ছাপানোর কথা ছিল। সেই অর্ডারটা নিয়ে এসেছিল আবুল কালাম। কিন্তু সে বড় একটা ভুল করে ছাপিয়েছে পোস্টারটা। বড় করে সেই নেতার ছবি, আর ছোট করে নেতার জামাই, কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষকের ছবি থাকার কথা। কিন্তু উলটো করে ছাপা হয়ে গেছে। সময় অল্প থাকায় সেটা প্রুফ দেখতে স্কুলেও পাঠানো যায়নি। এখন সাল্পাই স্কুল থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে দুইদিনের মধ্যে অগ্রিম পেমেন্ট করা টাকাটা ফেরত দিতে। এজেন্সির মালিক কাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর শামসুদ্দিন তাকে ডেকে নিজের ভুঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলেছেন, "গাঞ্জা খাইয়া কাম করলে কুত্তায়ও হাগব না তোমার ঘরে। আইজ থেইকা আহনের দরকার নাই। বেতন যা পাওনা ছিল, সেইটা তোমার জরিমানা।"

গাঁজা কালাম একদমই খায় না। তবে শামসুদ্দিন প্রতিদিন রাতে অফিসে এক পুরিয়া টানেন। নেভি সিগারেট থেকে তামাক বের করে গাঁজা ভরে দেয়ার কাজটা করে অফিসের কুলি জয়নাল। অফিস থেকে বেরিয়ে কালাম এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে, রেলস্টেশনে গিয়ে একটা রুটি, এককাপ চা খেয়েছে। পায়ের স্যান্ডেল অনেকখানিই খয়ে গেছে তার। সেটা আরেকবার কেনার উপায়ও নেই। অফিসে এক সেট প্যান্ট-শার্ট, স্যুট, টাই আছে। কাজ সংগ্রহে তাকে সেটা পরে যেতে হত। সেখানে পলিশ করা জুতাও আছে। কিন্তু সেগুলো পাবার উপায় নেই। এরপর যে লোক চাকরিটা পাবে, সে পরবে এটা। তবে তার একটা লুঙ্গি রয়ে গেছে ওখানে, নিয়ে আসতে হবে পরে কখনো যেয়ে। সন্ধ্যা হবার আগে আগে প্রেসগুলোতে একটা ঝিমভাব থাকে। সে সময়টায় সে গেল অনেকগুলো পরিচিত ছাপাখানার মহাজনের কাছে, একটা কাজের ধান্দায়। কাজ অত সহজে মেলে না, মিললও না।

রাত খানিকটা হবার পরে সে বাসায় এল। বাসা তার মগবাজারে। রেললাইনের ধারে একটা জীর্ণ বাড়ির দোতলায়। তার চেহারায় আজ যে ঝড়ের ছাপ, সেটা প্রায়ই থাকে কাজের চাপের কারণে। সে যখন ঘরে ঢোকে, কাতরানোর শব্দ শুনতে পায় একটা। তার একমাত্র মেয়ে, তহুরার জ্বর। আজ সকালেও স্কুলে গেছে মেয়েটা, বিকালে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জ্বর নিয়ে ফিরেছে। রোদে দৌড়াদৌড়ি করে খেলার পরে ঝুম বৃষ্টি এল, সে বৃষ্টিও মেয়েটার আনন্দ বাড়িয়ে দিল। এবং বাসায় যখন ফিরল, চোখ লাল। মায়েদের চোখ বেশ তীক্ষ্ণ হয় বলে এ দফা পিটুনির হাত থেকে বেঁচে যায় মেয়েটা। কাপড় বদলে গা মুছে দিতে গিয়েই মা বোঝেন ব্যাপার সুবিধার না। প্রচণ্ড কাঁপুনি, আর শরীরের তাপ বহুগুন বাড়িয়ে দেয়ার জন্য শাপ-শাপান্ত করতে থাকেন তিনি আবহাওয়াকে, স্কুলকে, পড়াশুনাকে, গরীবের কপালকে, বংশকে। আবুল কালামেরও মাথা খারাপের জোগাড় হয়। ঘরে টাকা পয়সা তেমন নেই। জহুরা মেয়ের জন্য পাশের ঘরের সবজিওয়ালা লোকটাকে দিয়ে নাপা আনিয়েছেন। কিন্তু সেই ওষুধ খাওয়ানো যায়নি, কারণ কিছুই খেতে পারেনি মেয়েটা। আবুল কালাম মেয়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগে, এই ফাঁকে রান্না করতে যান। রান্নাঘরটা তিন পরিবার ব্যবহার করে। এরমধ্যে তরুণ বয়সের এক রিকশাওয়ালা থাকে। তার বউ সেসময় তরকারি গরম করতে গেছে। সে জহুরাকে জোর করে ঠেলে পাঠায় ঘরে। চাল-তরকারি যা আছে দিয়ে যান জহুরা, রাঁধতে বসে মেয়েটা। ঘরে গিয়ে মাঝখানে তার স্বামীকে পাঠায় একটু সাগু কিনে আনতে। জ্বরে পড়া মেয়েটাকে এই একটা জিনিস হয়ত খাওয়ানো যেতে পারে। ভাত নামাবার আগেই সাগু গরম হয়, সেটা একটা বাটিতে ঢেলে জহুরার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসে। জহুরা অবাক হয়না। তিন ঘরের জীর্ণ বাসাটায় এই তিন পরিবারই একসাথে আছে তিন বছর হল।

কালামের সাহস হয়না এই ঝামেলার মধ্যে জহুরাকে চাকরি যাবার খবরটা দেয়ার। রিকশাওয়ালার বউকে গিয়ে চুপিচুপি জানিয়ে রাখে। একটু রাত হবার পর তহুরা সাগু খেয়ে, ওষুধ খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। রিকশাওয়ালা এসে কিছুক্ষণ পর তাদের দরজায় দাঁড়ায়। ইতস্তত করে ঘরে ঢোকে, তহুরার কপালে হাত রাখে, এরপর বলে, "কালাম ভাই, তুমি কাইল কাম খুঁজতে যাইয়ো। আমার গাড়িতে কইরা ভাবীরে আর আমার পরিবাররে ক্লিনিকে দিয়া আমুনে। আল্লা আল্লা করো।" এটুকু বলে বেরিয়ে যায়। জহুরা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন, এবং করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকান স্বামীর দিকে। জিজ্ঞেস করেন, "কবে গেল?"
"আজকে।"
"আমারে কন নাই ক্যান?"
"মাইয়াডার অসুখ।"
"সারাদিন কিছু খাইছেন?"
"রুটি।"

তাড়াহুড়া করে ভাত বাড়েন জহুরা। খাওয়া শেষ হয় নিঃশব্দে। মেয়েটাকে মাঝখানে রেখে শুয়ে পড়ে দুজনে। কথা হয়না কোন।

দুই.
বস্তির মত এলাকাটায় সকাল হয় নানারকম চেঁচামেচি দিয়ে। কিন্তু কালাম-জহুরার আজকের সকাল হয় মেয়ের ফোঁপানির শব্দে। জহুরা মেয়ের মাথায় পানি ঢালেন, গল্প শোনান। ভাত রাঁধা হয়, খেয়ে বেরিয়ে যায় কালাম। যাবার আগে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে যায় রিকশাওয়ালাকে। কাজ খুঁজে পেতেই হবে তাকে। কোরবানি ঈদের আছে চারদিন। শুধু কাজ জুটলেই হবেনা, কিছু অগ্রীম টাকাও পেতে হবে।

মেয়েটাকে কোলে করে জহুরা আর রিকশাওয়ালার বউ ক্লিনিকে যান। ঈদের আগে, ভীড়টা একটু কম লাগে। আর আজকাল বস্তি এলাকার মানুষগুলোও হাসপাতালে, নইলে বেসরকারি ক্লিনিকে যায়। ওদেরকে ক্লিনিকে নামিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালা দুয়েকটা খ্যাপ মারতে চলে যায়। বলে যায় সব শেষ হলে যেন ফোন দেয়। ডাক্তার মহিলা অনেকক্ষণ বসে মেয়েটাকে দেখে, কিছু ওষুধ লিখে দেয়। ঈদের পর আবার দেখাতে বলে কিছু টেস্ট করার জন্য। ঈদের মধ্যে দেখাতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সবকিছু তখন বন্ধ থাকবে যে! তবে এখানে না এসে ঢাকা মেডিকেলে গেলে ভালো হয়, সেটাও বলে দেয়। ওরা যখন বেরিয়ে আসছে, তখন আবার ডাক দিয়ে ফোন নম্বরটা দিয়ে দেয়। বলে আমি ঈদে এখানেই থাকব। ওষুধ কয়েকটা ক্লিনিকে পাওয়া যায়, কয়েকটা পাওয়া যায় না, কিনতে হবে। বাড়ির সামনে রাস্তার ওপারে একটা মুদি দোকান আর একটা ফার্মেসি আছে একসাথে। ঐ বাড়ির মালিকেরই দুটো দোকান। সেখান থেকে জহুরা ওষুধ কেনেন। মেয়ের জন্য সাগু আর সুজি কেনেন। পুরো সময়টা মেয়েটা কাঁদতেই থাকে অল্প শব্দে।

কালামের দিন যায় খুব ধীরে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিচিত-অপরিচিত নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। অনেকে স্রেফ জানিয়ে দেয় কাজ হবেনা, কোথাও ভদ্রতার খাতিরে বলা হয়, ঈদের পর দেখি কী করা যায়। তবে সেই সুরে বিদায় করার প্রচেষ্টা এমন প্রকট থাকে যে ঈদের পর খোঁজ নেয়ার ভরসা পায়না সে। 

তিন.
'ভাই ভাই ফার্মেসি'র মালিক আফজাল সাহেব বেঁটে লোক। তিনি যে বড় ভালো লোক, সে ব্যাপারে অনেকের কাছেই শোনা যেত এককালে। কিন্তু তিনি ঠেকে শিখেছেন। বস্তি রকমের এলাকায় তার যে দুটো বাড়ি আছে, তার মধ্যে একটার নিচতলায় তিনি প্রথমে করেছিলেন মুদি দোকান। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গরীব হওয়ায় তাকে খুব বেশিই বাকি দিতে হয়েছে। এবং সেই টাকা উসুল না হওয়ায় তার দোকানটাকে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এরপর তিনি আবার ব্যাবসা শুরু করেন। মুদি এবং ফার্মেসি একইসাথে। এবার দর্শন একটাই, গরীব মানুষের সাথে বাকির লেনদেন নেই। শীঘ্রই ফুলে ফেপে ওঠে ব্যবসা। 

ঈদের দুদিন আছে। আবুল কালামের এখনো কিছু জোটেনি। মেয়েটার অসুখও ঠিক আগের মতই আছে। সে এসেছে বাকিতে কিছু ওষুধের জন্য। সে নিশ্চিত ছিল ওষুধটা পাওয়া যাবে। এই ফার্মেসির অনেকগুলো কাজ সে একটা প্রেস থেকে করে দেয় তার এজেন্সির মাধ্যম ছাড়াই। সে নিজে অল্প কিছু কমিশন নিলেও মোট খরচ খুচরা কাজের তুলনায় কম পড়ে। কিন্তু বাকির কথা শুনে মিষ্টি করে হাসলেন আফজাল সাহেব। টুথপিকের কৌটা থেকে অনেকক্ষণ বসে বেছে বেছে একটা টুথপিক বের করে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, "দেখো মিয়াঁ, আমার আয় কি বেশি? আমি বেশি ঘরে নিতে পারি? আমি ক্যামনে দেই? তুমি খুইজা দেখো আমার কত লোন। কিছু টাকা ম্যানেজ কইরা আনো। আমি বুঝি তোমার ঝামেলা। কিন্তু টাকা ছাড়া পারিনা। বোঝোই তো, বোঝো না?" আবুল কালাম খুব ভালোই বোঝে এবং ফিরে আসে। সবজীওয়ালা বাড়ি চলে গেছে। রিকশাওয়ালার আয় অমন কিছু না, যাতে দিনের খরচ আর বাড়িভাড়া দেবার পর ওষুধের অতগুলো টাকা ধার দিতে পারে। ক্লিনিক থেকে দেয়া একগাদা প্যারাসিটামলের ওপর ভরসা রেখে তাকে আবার কাজ খুঁজতে হয়। এত বড় শহরের আনাচে-কানাচে এত মানুষ, কোথাও একটা কাজ এক মূহুর্ত খালি থাকার উপায় নেই। তবু শহর চলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

পরের দিনটা কাটে আরও বেশি দুশ্চিন্তায়। তহুরার জ্বর বাড়ে। কাজ দেয়া নেয়ার দেয়া-নেয়ার ব্যাপারগুলো ঈদের আগের দিনটায় তেমন ঘটে না। সবার মধ্যে থাকে গোছানোর তাড়া। নতুন কিছু জড়ানোর জন্য ঈদের পরের সময়টা খুব মানানসই। কিন্তু আবুল কালামের প্রয়োজনটা ঠিক এখন। সারাদিন কাজের ধান্দায় তাকে ঘুরতে হয় মগবাজার, আরামবাগ এবং গুলিস্তান। কিচ্ছু না, একদম কিছুই জোটে না।

চার.
 ঈদের নামাজ পড়ার জন্য বের হয় আবুল কালাম। তহুরা তখন অনবরত কাঁতরে যাচ্ছে। সেটা বাবার স্বরে শূলের মত বেঁধে বলেই ঈদের দিনটা অন্য দিনের চেয়ে বেশি তেঁতো লাগে।  নামাজ পড়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার। সেজন্যই বুঝি কাজের খোঁজের প্রতি তাড়নাটা বেড়ে যায় আরও অনেকটা। একটা লোক রাস্তার পাশে খেলনা বেচছিল, তার কাছে গিয়ে বলে, "ভাই, কাজে সাহায্য লাগব? মাইয়াডা অসুস্থ।"
লোকটা মাথা নাড়ে।

গরু কাটাকাটি হচ্ছিল, এমন কয়েকটা জায়গায় গিয়ে সে বলে, "ভাই আমি একটু সাহায্য করি?"
অদ্ভুতভাবে প্রত্যেক জায়গার লোকগুলো ঠিক একইভাবে মাথা নাড়ে। শহরের সবগুলো মানুষকে আজ আবুল কালামের একইরকম লাগতে শুরু করে। একইরকম বিচ্ছিরি, একইরকম নিষ্ঠুর।

একটা মুদি দোকানে একটামাত্র লোক নতুন পাঞ্জাবি পরে ভিড় সামলাচ্ছে। তার মনও গলে না মায়াবী কণ্ঠস্বরে। এবং তখনই বৃষ্টি আসে। ভারী বৃষ্টি। আকাশ মনে হতে থাকে ভেঙ্গে পড়বে এক্ষুনি। বৃষ্টি আরও অস্থির করে তোলে আবুল কালামকে। সে দৌড়ে যেতে থাকে প্রতিটা দোকানে, পসরা সাজিয়ে বসা প্রতিটা হকারের কাছে। কতক্ষণ কাটে সে বোঝে না। ঠিক দুপুরের আগে তাকে দেখা যায় বাড়ির সিঁড়িতে বসে আছে। চোখ লাল, কাউকে চিনছে না। ধরাধরি করে তাকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়।

বিকেলের লাল আলোতে জ্ঞান ফেরে তার। সূর্যের আলো সম্ভবত ঠিক সেই মুহুর্তে তার মুখে পড়েছিল জানালা গলে। সে দেখতে পায় অনেক মানুষ। ঘরভর্তি অনেক মানুষ। ঘরটাকে তার রিকশাওয়ালার ঘর বলে মনে হয়। পাশের ঘরে উচ্চস্বরে কোরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ শোনা যায়। তার মনে হয় এটা ঈদের দিন। অনেক মানুষ বেড়াতে এসেছে তার বাসায়। দুশ্চিন্তা হয় এতগুলো মানুষকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে সেটা ভেবে। সেমাই তো কেনা হয়নি। নিশ্চয়ই রিকশাওয়ালা সেমাই কিনেছে। নিশ্চয় বড় হাড়িতে করে সেমাই রান্না হচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ কেউ মাংস দিয়ে গেছে ছোট ছোট পোটলায়। জহুরা কি রান্নাঘরে? কিন্তু পাশের ঘরে এত জোরে কোরআন শরীফ কে পড়ছে? নাকি অনেকজন মিলে পড়ছে? এখন কেন? কেউ একজন ডুকরে কেঁদে ওঠে সেসময়।

পাঁচ.
সন্ধ্যের আগে আগে আফজাল সাহেবের দোকানের কর্মচারি ফোন দিয়ে জানায় সে আর আসবে না বাড়ি থেকে। গ্রামেই দোকান দিবে একটা। ভালোই লাগে আফজাল সাহেবের। আবুল কালাম লোকটা বড়ই অভাবী, এবং ভালো। সে নিজে গিয়ে খবরটা দিতে চায় কালামকে। তার শালা্‌কে, যে তার বাড়িতে আশ্রিত, বলেন একটা পোটলায় কিছু মাংস দিতে। একটু বেশিই দিতে। এরপর নতুন পাঞ্জাবীটা গায়ে চাপান। আয়নার সামনে বসে চোখে সুরমা দিতে দিতে তিনি শুনতে পান, মাগরিবের আজানের সময় হবার আগেই মসজিদের মাইক্রোফোন চালু হয়েছে।