এক.
মধুর ক্যান্টিনে চা ফুঁকছি। একলা বসে, অসময়ে।
ব্যাপারটা সিগারেটের মত, ক্যাফেইন নেবার পদ্ধতি, তবে এতে ফুসফুসের জোরে কিছু বাতাস বের করে দেয়া হয়, চা
কে ঠাণ্ডা করতে। বসেছি কাউন্টারের সামনের টেবিলটায়, ভিড়ভাট্টা
নেই একদম। আমার চোখ বারবার যাচ্ছে ঐ ওপাশের টেবিলটাতে, যেখানটায়
একটা মেয়ে বসে আছে। কিছু খাচ্ছিল হয়তবা, কিংবা কারো জন্য
অপক্ষা করছে। হয়তবা বেকার সময়ই কাটাচ্ছে। আমার শেষটা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে। কারন
ফুটফুটে চেহারার মেয়েটাও বেশ কবার চেয়েছে এদিকটায়। আমি চা শেষ করলাম, এবং আর এক কাপ চা নিলাম। ফ্রয়েড ভক্তরা এর একরকম ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
কিন্তু আমার চায়ের নেশা, তাই তৃতীয় কাপ।
চা শেষ করে আমি বিল মিটিয়ে সোজা হেঁটে গেলাম সেই
টেবিলটায়। বললাম, তুমি কি জানো, বিল ক্লিনটন ঠিক
এ পরিস্থিতিতে কী বলেছিলেন?
মিষ্টি করে মেয়েটা হাসল, আলতো
করে মাথা নাড়ল। বলল, লিভিং হিস্ট্রি-র গপ্পো।
আবারো বলল, আমি অরুণা।
আমি কশ্যপ।
এবারে শব্দ করে হাসল অরুণা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকালো সত্যিকারের নামটা জানতে। বললাম, আমি রাহি।
-ফাইন আর্টস, ফার্স্ট ইয়ার।
-ফিজিক্স, ফার্স্ট
ইয়ার।
আমি ফিজিক্সের ছাত্র হয়ে কক্ষনো অধিকার রাখি না
মায়াবতি এক ফাইন আর্টসের ছাত্রীর দিকে তাকাতে। পুরো ক্যাম্পাসের বহু সিনিয়রের চোখ
সবসময় চোরা দৃষ্টি ফেলে এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি। তবু আমি হেসে বলি, আমরা
বের হতে পারি। কল্পনার মত সুন্দর করে মাথা নাড়ে অরুণা। আমরা বের হই মধু থেকে।
-একলা চুপচাপ বসে ছিলে যে? অপেক্ষা?
-তাই বুঝি হয় সবার ক্ষেত্রে?
আমি সত্যি একলা মানুষ। এখনতক বন্ধুও হয়নি ডিপার্টমেন্টে, হলে। ক্লাস হবেনা শুনলাম, এলাম তাই।
-হলে থাকো?
-রোকেয়া হল।
হেঁটে ডাকসুর পেছন দিয়ে পাশের সুন্দর গ্যালারির
মত সিঁড়িটায় এলাম। তাকাচ্ছিলাম বারবার অরুণার দিকে। সেটা হয়তবা বেশিই হয়ে যাচ্ছিল।
কারন অরুণা বলল, তাকাচ্ছ যে বারবার?
-বেশ লাগছে তোমাকে।
-সেটা আমি জানি, বুদ্ধু কোথাকার!
হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সেই সিঁড়িতে বসে অরুণা। আমার
চোখে চোখ রাখে। সরল আহ্বান। আমিও বসি ঠিক পাশে।
নতুন ক্যাম্পাসে ঢোকা ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি কথা
বলে কোর্স নিয়ে। আমরাও সেই কোর্স আর ক্রেডিটের গল্পে মেতে উঠি। তখন ছোট্ট একটা
ছেলে আসে, মলিন
এক প্যান্ট আর খালি গা। হাতে মলিন একটা ছোট গোলাপ। বলে, ফুল
ন্যান।
-তোর এই আপুটাকে চিনলাম মিনিট দশেক
আগে। কী করে নেই ফুল?
-ফুল ন্যান।
-জ্বালাসনে ভাই, যা তো!
-ফুল ন্যান।
এবার বুঝি, মুরগি ধরেছে বুঝেশুনেই। অরুণা
মুচকি হাসি দিয়ে যেতে থাকে। বলি, কয় টাকা?
-দশ টাকা।
আমি একটা পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলি, পাঁচ
টাকা।
-দশ টাকা।
-পাঁচ!
-পা ধরুম কিন্তু। দশ টাকা।
-তোর এই ছোট্ট ময়লা ফুল কে নেবে?
সুন্দর ফুল এনে দিতে পারবি? তবে দশ টাকা দিব।
বাচ্চাটা বিশ্বাস করে না। পা জড়িয়ে ধরে সত্যিই।
আমি আর একটা পাঁচ টাকা বের করি। ফুলটা, আর পাঁচ টাকার দুটো নোট হাতে
ধরিয়ে দিয়ে বলি, যা শীঘ্রই তোর বালতি থেকে তাজা একটা ফুল
নিয়ে আয়। ও নাচতে নাচতে হেলেদুলে যায়। লেকচার থিয়েটারের সিঁড়িটায় রাখা বালতি থেকে
কম মলিন একটা ফুল নিয়ে আসে। আমি নেই ফুলটা, আর ভাবি, দশ টাকার ফুল হয় আরো তাজা।
অরুণা হাত বাড়িয়ে দেয় ঠিক তখনই। আমি মিষ্টি করে
হাসি, চোখের
দিকে তাকিয়ে। ফুলটা চলে যায় ওর হাতে।
অরুণা এতক্ষণে আবারো মুখ খোলে। রাহি নামের অর্থ
জানো?
-বসন্ত।
-কাল কিন্তু বসন্ত শুরু।
-সেটা সবে জানে।
-কিন্তু আমি জানতে চাইছি, কাল তুমি কী করছ?
-দুপুর দেড়টায় টিএসএসির ভেতরের লনে
তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
-পাঞ্জাবি পরে?
-আচ্ছা।
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলি, তুমি
বুঝি শাড়ি পরছ?
-উহু! যে জামা পরে দৌড়ানো যায় না।
গাউন।
দুই.
টিএসসির লনে, ঠিক দেড়টায় দাঁড়িয়ে থাকি।
ফিজিক্সের বড়দের কারো বিয়ে কিংবা জন্মদিন, কিংবা রেজাল্ট
উপলক্ষ্যে আমরা ছোটরা পেটপুরে মিষ্টিমুখ করে এসেছি। আমার ভাষার চলচ্চিত্র চলছে
দুইদিন ধরে। সেখানে খুব ধীরে ধীরে হেঁটে আসে একটা মেয়ে। দুহাতে গাউনের দুপাশ ধরে।
আমার মনে পড়ে প্যাট্রিয়ট ছবির সেই দৃশ্যটা।
-কেমন আছ?
-বেঁচে আছি।
-গল্পটা বলবে বলে?
-গল্পটা তৈরী হোক আগে।
-কেমন গল্প চাও?
-একদিনের প্রেম।
এসব সস্তা কথা মেয়েদের খুব জানা। তবু কী যেন ভেবে
অরুণা বলে, হোক
তবে গল্পটা তৈরী।
তিন.
সবদিকটা মানুষে আর হলুদে ছেয়ে আছে। আমি আর অরুণা
হাঁটতে থাকি। মাঝপথে দেখা হতে শুরু করে গাদা গাদা মানুষের সাথে। সাদমান বলে, আমরাই
শুধু অভাগা!
এরপরে লাবিবা। সে অনেকদিন পরের দেখা। অরুণা এগিয়ে
যায়। আমি হাশি একটুখানি। লাবিবার শাড়ির রঙটা বোঝার চেষ্টা করি। রঙ চেনার দূর্বলতা
ছেলেদের আদ্যিকাল থেকে। অল্প কথা বলে পা বাড়াই আমি সে পথে, যে
পথে গেলে আমাদের কোন তাড়া নেই। কার্জনের লনে বসে থাকা,
এক প্লেট থেকে দুজনে ফুচকা খাওয়ার অংশটা মিষ্টি স্মৃতি হয়ে রবে,
বুঝতে পারি। হাত ধরে হাঁটি কার্জন জুড়ে। এর মধ্যে দেখা হয় আমাদের
পুরো দলের সঙ্গে। ওরা হাসে। অন্তরা বলে, আজ ওমরকে মনে হচ্ছে
ভূতে পেয়েছে? জায়েদের সবসময়ের ফিচলে হাসি প্রাণ উড়িয়ে দেয়।
মিলন, আমেনা, তানিনেরাও হাসে।
বইমেলার মধ্যে ঘুরতে থাকি, হাত
ধরে, এলোমেলো পথে। ঠিক কোন গন্তব্য নেই, বই দেখার তাড়াও নেই। তবু বই দেখি। প্রতিটা স্টলে গিয়ে লাইন লাইন হাত
বুলিয়ে দেখিয়ে বলি, এসব আমার পড়া। অরুণা বলে, অনেক পড়েছ। যেসব স্টলে কিশোর উপন্যাস
কিংবা শরৎ-রবীন্দ্র-মানিক আছে, সেখানে অরুণাও আমার মত সারি
সারি হাত বুলিয়ে বলে, সব পড়েছি। আমরা গল্প করি চরিত্র নিয়ে।
দেবদাসের বুলবুল আহমেদের করা ছবিটায়, দেবদাস কেমন করে ছিপের
লাঠি পার্বতির কপালে মেরে কালশিরে ফেলে দিয়ে বলে, তাকে ভুলতে
চাইলেও চিহ্নের কারনে ভুলতে পারবে না- জাতীয় বাক্যের
গল্প শোনাই অরুণাকে। আর প্রতি স্টলে দু-চারটা করে বই দেখিয়ে অরুণাকে বলি, আমাকে কিনে দিবে? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে দুজনেই
আত্মহারা হই। এ বই রেখে ও বই ছুঁয়ে দেখার প্রবল আকুতি। দেখা হয় অনি ভাইয়ের সাথে।
সে হাসে।
দেখা হয় আবারো সাদমানের সাথে। এবারে ও একলা নয়।
সাথে একটা মেয়ে। বলি, তুই দাবি করেছিলি তুই অভাগা! সাদমান প্রতিবাদ করে বলে,
তুই কি ভেবেছিস ও আমার প্রেমিকা?
মেয়েটার দিকে চেয়ে বলে, এই
তুই কি আমার প্রেমিকা?
মেয়েটা চেঁচিয়ে বলে, নাহ!
আমি তাকাই অরুণার দিকে। বলি, তুমি
কি আমার প্রেমিকা?
অরুণা মিষ্টি হেসে বলে, হু
আমি তোমার প্রেমিকা।
আমি তাকাই সাদমানের দিকে, আবারো।
বলি, দেখেছিস, ও আমার প্রেমিকা। তুই
শালা সত্যি অভাগা!
অরুণা একটু আগে বলছিল সৈয়দ মুজতবা আলির কথা।
কেন্দ্রে তাঁর সমগ্র রিবন দিয়ে বাঁধা। ছুঁয়ে দেখি আমরা। এগারো খণ্ড। গায়ের দাম
জেনে হিসেব কষি, এখানে কিনলে কত পরবে। তারপর হিসেব কষি, কেন্দ্রের বার্ষিক বিক্রি প্রোগ্রামে চল্লিশ শতাংশ ছাড়ে কিনলে কেনা যাবে
পঁচিশ শো টাকায়। বলি অরুণাকে, টাকাটা আমি জোগাড় করব টিউশনি
দিয়ে। রেখে দিব আবারো চল্লিশ শতাংশ ছাড় পর্যন্ত।
অরুণা বলে, বইগুলো যেন পড়তে পাই।
আরো অনেক হেঁটে শেষে বসি মুক্তমঞ্চের পাশে।
অরুণার ব্যাগ থেকে বের করে নেই কাগজ, কলম। লিখতে বসি প্রথম প্রেমপত্র,
বসন্তের প্রথম দিনে। আশেপাশে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলো প্রত্যেকে ঝুঁকে
তাকাবার চেষ্টা করে কাগজের দিকে। সবার আগ্রহ এ যুগে এসেও প্রেমিকাকে পাশে বসিয়ে
লিখে যাওয়া মানুষটাকে দেখবার, কিংবা লেখাটা দেখবার।
আমার ভীষণ লজ্জা হতে থাকে। তবু লিখি সংক্ষিপ্ত
একটা চিঠি। প্রতি বসন্তে, আগের বসন্তের চেয়েও গভীর ভালোবাসার কথা বলি আমি
চিঠিতে। অরুণা তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। শেষ হলে আমি ছিঁড়ে নেই খাতা থেকে। ভাঁজ করি।
এরপরে অরুণার হাত ধরে নিয়ে যাই একটা লিচু গাছের তলায়। যার পাশে আছে এক প্রকাশনীর
সৌজন্যে দেয়া ময়লার ঝুড়ি। অরুণার হাতে দিতে দিতে বলি, ইউ আর
ফ্রী টু থ্রো ইট হেয়ার! মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দেই ঝুড়িটা। অরুণা পড়ে
পুরোটা দাঁড়িয়ে। এরপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলে, এত্ত সুন্দর!
এত্ত সুন্দর!
চার.
দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে যাই মিতালি হোটেলে। এরপরে
শহীদ মিনারে। অরুণা বলে, আমি প্রথম এলাম এখানটায়। পলাশ গাছটা যেন কোন পাশে?
-পলাশ গাছ আছে নাকি এখানে?
-আছেই তো।
-তুমি না প্রথম এলে?
-টিভিতে দেখতাম গাছটাকে।
আমরা দুজনে বেদিকে পাশ কাটিয়ে যাই পলাশ গাছটার
কাছে। ঝাড়ু দেয়া গাছতলায় নেই একটি ফুলও। মন খারাপ হয়। এরপর ভাবি, কখনো
কি তাজা পলাশ ছুঁয়েছি? লাফিয়ে ধরি একটা ডাল।
অরুণা চেঁচায়, শুধু ফুল! কলি যেন না ছেঁড়ে! আরো
ফুল হবে...
বসে থাকি কাগজ বিছিয়ে, পা
ঝুলিয়ে, পূবদিকে ফিরে। সে অনেকক্ষণ। চুপচাপ দুজনে নিঃশব্দতা
শুনি। কিংবা রাস্তার কোলাহলে কান পাতি। কুলফিওয়ালা আসে। অরুণা বলে, ম্যালাদিন কুলফি খাই না। তুমি খাবে?
আমি মাথা নাড়ি। ইচ্ছে করেনা খেতে। ও বলে, তবে
আমি একলাই খাচ্ছি। সত্যি একা একা কুলফিটা শেষ করে বলে, প্যাকেটটা
ফেলে আসবে?
স্বগতোক্তির মত করে অরুণা বলে, কেন
খেলাম?
আমি বলি, সর্দি হবে? ব্যাঙের সর্দি?
একলা একলা বলি সেই হাইকুটা,
পুরনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ,
জলের শব্দ।
মাথার ওপরে কড়ই গাছটায় এসে বসে শত শত চিল। মনে পড়ে, রোকেয়া
হলের দরজা বন্ধ হয় রাত ন'টায়।
হাঁটা ধরি রোকেয়া হলের দিকে। প্রতিটা পদক্ষেপই
যেন ফুরিয়ে যেতে থাকে দ্রুত। পায়ে যেন প্রতিটা পদক্ষেপেরই স্বাদ লেগে থাকে। আমরা
হাঁটি।
হা-পিত্যেশ এর মত করে অরুণা বলে, রাস্তা
এত শীঘ্রই ফুরোচ্ছে কেন?
বলি, পথ তো বেশ একটু।
মিষ্টি করে হাসে অরুণা। মৃদু স্বরে বলে, আপেক্ষিকতা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন