শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

স্বস্তি



অয়ন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, কেমন করে হল এসব? হরতালে সামনে এগিয়ে বড় একটা ইটের টুকরো ছুড়ে মেরেছিল পুলিশের দিকে, এবং কি সৌভাগ্য! এক পুলিশের হেলমেট ছিল না মুখে, ইটটা গিয়ে তার মুখেই লেগেছিল। ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে এলো, নাকটাও গেল বোধহয় বেচারার। ও হঠাৎ বিচলিত বোধ করছিল। সাধারণত বাম দলগুলো হরতালে নিরাপদ দুরুত্বে থেকে ইট-পাটকেল ছোড়ে, কিন্তু কেউ কারো ধরাছোঁয়ার ভেতরে যায় না। কাউকে আঘাত করার মনোবাঞ্ছা পুলিশের নেই, বিপ্লবিদেরও নেই। এর মাঝখানে একদম পাশে এক কাঁদানে গ্যাসের শেল পরায় কিছুক্ষণ মুখ থুবড়ে পরে ওকে খক খক করে কাশতে হয়েছিলো। অন্য একজন মুখের সামনে লাইটার জ্বেলে খানিকটা সুস্থ করে দেয়। সেটা সামলে ওঠার পরই অনেক বেশি রাগ নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল অয়ন। গুলি খাওয়ার আগে ফিরেও আসতে পেরেছিল আড়ালে। কিন্তু জলপাই রঙের পাঞ্জাবিটা। সেটা পুলিশদের চোখে আটকে ছিল। দুপুরের আগে আগে হঠাৎ ধাওয়া করে এসে ধরে ফেলেছিল। রাস্তার ওপরে রাইফেলের বাটের আঘাতে জ্ঞান হারিয়েছিল অয়ন শীঘ্রই। তবে কাল ইউটিউবে সেটার ভিডিও দেখে থমকে গিয়েছিল ও। জ্ঞান হারানোর পরে আট-দশজন পুলিশ ওকে বেধড়ক পিটিয়েছে। কোন এক পথচারীর মোবাইলে সে দৃশ্য ধারণ না হলেও হয়ত হত। অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ ওকে হাসপাতালে দিতে চায়নি, চেয়েছিল চৌদ্দ শিকে ভরতে। কিন্তু পথচারীদের বাধায় ওকে আনা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। পরদিন খোঁজ-টোজ নিয়ে পুলিশ যখন বুঝতে পেরেছে, কোন দলেই নেই ও, তখন অবাক হয়েছে, এবং মামলা না করেই চলে গেছে। এসব ইস্যুতে দলের লোক ছাড়া ধরে লাভ নেই। ছাত্রদের দু-তিনটে বাম সংগঠনও ঘুরঘুর করে চলে গেছে। দলের ফায়দা নেই, নিউজ ভ্যালু নেই এখন আর, তো হবে কী পাশে থেকে

এসব তিনদিন আগেকার কথা। এখন সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা, কিন্তু হাড়গুলো সব অক্ষত। পুলিশ কি আজকাল এনাটমি পড়ে? নিখুঁতভাবে কেমন করে পেটায় ঐ হুড়োহুড়ির মধ্যে? মাথায় আর উরুতে ছাড়া কোথাও ব্যান্ডেজ নেই। ফুরফুরে মেজাজে সোভিয়েতভ কৌতুকভ পড়ছিল। এসময় মিমি এল। মুখ থমথমে, ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বসল নিজে। এই তিনদিনে মিমি আসতে পারত, কিন্তু কেন যেন আসেনি। হয়তবা এই অবস্থা দেখতে চাচ্ছিল না। ফুরফুরে মেজাজ উবে গেল ওর মুখে ঝড় দেখে। নিঃশব্দতা ভাঙল একটু পর।
-না গেলে কী হত?
-গ্যাসের দাম বেড়ে যেত।
হেসে ফেলল মিমি। এমন সরল উত্তর আশা করেনি। মিমির মুখে মেঘ জমলেই আয়নের মুখে খই ফোটে। নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে সে। কিন্তু আজ এমন সোজাসাপ্টা কৌতুক! ব্যাগ থেকে একটা কাগজের ঠোঙ্গা বের করে দেয় মিমি। রোগী দেখতে এলে ফল-হরলিক্স নিয়ে আসতে হয়,
সেরকম কিছু এনেছে বোধহয়য়। কিন্তু একি! কাঁচামরিচ! এ কেমন কৌতুক! এবার ঠা ঠা করে হেসে ওঠে অয়ন। বুঝতে পারে, মিমি ওর এসব আন্দোলন-রাজনীতি নিয়ে যতই মুখ ঝামটা দিক, একটু একটু পছন্দও করে ব্যাপারটা। নইলে বন্ধুদের সাথে এটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা-বাণ ছোটাত না।

'কষ্ট হচ্ছে?' খানিকটা চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করে মিমি।
'নাহ! আনন্দ হচ্ছে। তুমি আছ যে পাশে!' মুখ বাঁকা করে বলে ওঠে অয়ন। 
ওর মাথায় হাত রাখে মিমি। আলতো করে বুলাতে থাকে। ঝাঁকড়া বড় বড় চুলগুলো ডাক্তার কেটে ফেলেছে। ন্যাড়া মাথায় ব্যান্ডেজ। সেই ব্যান্ডেজেই হাত বোলাতে বোলাতে মিমি বলে, 'কষ্টকে সইতে শেখো। কেউ ফেয়ার আচরণ করবে না তোমার সাথে। সেটা থেকেই শেখো।'
নীতিকথা অয়নের একদম ভালো লাগে না এই মূহুর্তে। মিমির একটা হাত ধরে বলে, 'আচ্ছা তোমার হাতে সেই রেখাটা কি আছে এখনো? স্বামীভাগ্য যে চমৎকার।'
আবারো হাসে মিমি। এই একটা রেখা দেখতে কত কতবার যে ওর হাত ধরেছে অয়ন, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ ও জ্যোতিষশাস্ত্রের খানিকটা জানলেও আসলে জানে না এই রেখাটা কীভাবে দেখতে হয়। মিমি হেসে ফেলে বলে, 'পরকীয়ার ব্যাপারটা দেখো তো! কেমন পারব সেটা?' 
অয়ন কপট গম্ভীরতা দেখিয়ে বলে, 'তোমাকে দিয়ে ওসব হবে না। ওটা আমার গুণ।'
'অসভ্য!' মিমি বলে ঝটপট।

ওয়ার্ডজুড়ে কোলাহল, কারণ এটা ভিজিটিং আওয়ার। কিন্তু সেসবের কিছুই ছুঁয়ে যায় না ওদেরকে। আপন মনে গল্প জুড়ে দেয় ওরা। মনে হতে থাকে ওরা বসে আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে, কিংবা টিএসসির বারান্দায়। গল্পে চলে আসে আবারো সেই দেশের কথা, লেখার কথা। হাসপাতালে বসে ব্যাথা হাতে একটা ছোটগল্প লিখেছে অয়ন রাতে। শুয়োর কা বাচ্চা নামে। এই মূহুর্তে কেমন একটা রক্ত গরম সময় যাচ্ছে, তাই লেখায়ও সেটার প্রভাব পড়েছে। গল্পটা মিমি পড়ে, কিছু বলে না। অয়ন এবার মুখ খোলে, পড়াশুনার কথা জিজ্ঞেস করে। ফিজিক্সে পড়ছে মিমি, এবং রেজাল্ট অতিরিক্ত ভালো। হয়তবা শিক্ষক হয়ে যাবে এখানেই। নিজের গুরুদেরকে একসময় ডাকবে কলিগ। এবারে কৌতুক করে বলে মিমি, 'টিউশনিতে গেলে না আজ?' 
-যাব ভাবছি একটু পরে। নার্সকে কিছু ঘুষ দিয়ে।
মিমি হাসে, আবার একটু দুশ্চিন্তাও করে। কারণ প্রত্যেকটা দিন ল্যাব করে সেই সন্ধ্যাবেলা পড়াতে যায় অয়ন। প্রচণ্ড পরিশ্রমই করছে এই সময়টায়। দুটো টিউশনি করিয়ে রাতে ঘরে ফেরে, রান্না করে, তারপর দু-মুঠ খায়। জেদ করে নিজের টাকায় চলবে, কারণ ও নাকি বড় হয়েছে। এটুকু হলেও কথা ছিল। কিন্তু পঁচিশ শো ডলার জমানোর চেষ্টায় আছে সে। একটা বিশাল টেলিস্কোপ কিনবে। টিউশনির প্রথম মাসে বলেছিলো, মুজতবা আলী সমগ্র কিনতে চায়। মাত্র আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু এরপরে টেলিস্কোপের ভূত, জীবনটাই মাটি করল। এসবের পরেও পড়াশুনা ঠিকই টিকে গেছে। বই পড়া, মিটিং মিছিলে দৌড়ানো, সাহিত্য-সংস্কৃতি আড্ডা, লেখালেখি, চিত্ত-উজাড়ি প্রেম, সবকিছুর পরেও পড়াশুনা ঠিকই চলছে বেশ গতিতে। শুধু স্বাস্থ্যটা টিকছে না।

'সুস্থ হলে একবার আমার সাথে যাবে বিএসকে-তে?' মিমি কথা পাড়ে।
-শুধু একবার?
-আহা! আজীবনই তো যাব। হাতে কিছু টাকা আছে। তোমার সাধের মুজতবা আলী সমগ্র। টেলিস্কোপের সাধ তো আর পুরানো আমার সাধ্য না, বইগুলো নিও। 
-আজ্ঞে হ্যাঁ। আলবৎ যাব তবে, মহারাণী!
-রাণীর দৌড় অতখানিই কিন্তু, মনে রেখো। 
-আমার কি পুরো জগৎ চাই নাকি?
-বামনের দৌড় যতটা।
-বেটার অপশন ফ্যাক্ট। 
এবার দুজনেই হেসে ওঠে জোরে। আশেপাশে কিছু মানুষ বিরক্ত হয়ে তাকায়। আজকালকার ছোকরাদের অসভ্যতা হিসেবেই নেয় তারা। 

অনেকক্ষণ ধরে অস্বস্তি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেও পারেনা মিমি। অনেক গুছিয়ে, ভেবে এসেছে কীভাবে বলবে। এই অবস্থায় কখনোই অয়নকে দেখতে চায়নি ও। দেশের রাজনীতির হালচাল সবাই জানে। নিরীহ মনে এখানে গেলে শুধু ভোগান্তি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে ওকে গল্প করতে হচ্ছে। এসব থেকে মুক্ত হয়ে ও সুন্দর সাবলীল জীবন চায়। 

একমনে ওর দিকে চেয়ে ছিল অয়ন। হঠাৎ ও অয়নের হাত চেপে ধরে আকুল স্বরে বলে ওঠে, 'আমাকে কথা দাও এসব ছেড়ে দেবে!'
তাকিয়ে থাকে অয়ন। ওর মনে রাতের ভাবনাগুলো আবারো হানা দেয়। এখানে উগ্রতা ছাড়া আসতে যাওয়া বোকামি। আর সংস্কার? সে তো রাজনীতি ছাড়াও হয়। কোন দলে যাবে, সেটা নিয়ে অনেকদিন ধরে যে অন্তর্দন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তার একটা সমাধান ভাবছিল ও। আসলে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেদিন দলগুলো দেখিয়ে গিয়েছে স্বার্থপরতা। যে গভীর প্রজ্ঞা লাগে সংস্কারে, সেটা কি ওর আছে? তারচে সেবা ভালো না? এসব চিন্তা জেঁকে বসতে বসতে মিমি আবার বলে বসে, 'কথা দাও'। এবারে হাতের চাপ বাড়ে। মিমি যেসব কথা ভেবে এসেছিল, তার কিচ্ছু বলা হয় না। শুধু মনে হয় ওর, হাত চেপে ধরেই সব আকুলতা বোঝাতে পারবে ও। 
আকুলতা অয়নকে সত্যি ছুঁয়ে বসে। বলে, 'যাব না আমি রাজনীতিতে। অন্যভাবেও তো মানুষ হওয়া যায়।' মানুষ শব্দটায় যেন একটু বেশিই জোর দেয় অয়ন। মিমি কেঁদে ফেলে। কাঁধে মাথা রাখে।

নিঃশব্দতার মাঝখানে ভেসে আসে পাশের কোন এক বেড থেকে রোগীর এটেন্ডেন্ট এর কণ্ঠস্বর। '...ফেসবুক থেকে আমাকে দেখিয়েছে আমার ছেলেটা। সবগুলো একেকটা জানোয়ার! কেমন করে মারছিল ভাবী, কল্পনা করতে পারবেন না। আল্লা কি দেখে না এইসব?...'
অয়ন ভাবে, ছেড়ে আসব সব? আল্লাহই শুধু দেখবেন? আমরা পুতুল? খেলবে ওরা যেমন খুশি! কিন্তু মিমির চোখে তো তখন স্বস্তির আনাগোনা। জীবনকে নিশ্চিত করা জরুরি। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। পাশের মানুষজন আড্ডায় মেতে গেছে। বলে যাচ্ছে সরকারের সব নিষ্ঠুরতার কথা। আর সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। কিন্তু ওদের সেদিকে তাকানোর ইচ্ছে নেই যেন। নিঃশব্দতা যেন হঠাৎ কথা বলতে শুরু করেছে চোখে।

একটু পর বিষাদময় কণ্ঠে মুখ খোলে মিমি।
-বলতো, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে?
-এটাকে নিষ্ঠুরতা বলছ? তুমি একসময় আমার সাথে এরচে বেশি নিষ্ঠুরতা করনি?
চেয়ে থাকে মিমি, অবাক চোখে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন