শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক


Copyright © 2015 Tony Fed


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। এটা শুধু যে সময় নষ্ট করে তা না। অভ্যাস, দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সক্রিয়তা অনেকটা কমিয়ে দেয়। সেজন্য আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই। সামাজিক যোগাযোগের অন্য অনেক সাইটেই একাউন্ট আছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের বাংলাদেশে তেমন কেউ চালায় না বলে তাতে এডিক্টেড হতে পারিনি। যখন সবাই সেগুলো (টুইটার, গুগল প্লাস এসব) চালাবে, তখন ছেড়ে দেব। 

একটা বন্ধু আমাকে বলত, তুই বড় নার্সিসিস্ট! সবসময় নিজের কথা শোনাতে চাস। সত্যি বটে। কিন্তু কেন এটা আমার কাছে কোন সমস্যা লাগে না, এবং নার্সিসিস্টই রয়ে গেছি, তার ব্যাখ্যা আমার আছে। তার আগে বলি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর কথা।

মানুষ নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে ভালোবাসে। সমাজবিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, মোটামুটি দিনের চল্লিশ শতাংশ কথা আমরা নিজেদের সম্বন্ধে বলি। এর কারণটাও মজার। ডোপামিন! আমরা জানি, সেক্স করবার সময়, চকলেট খাবার সময় এই হরমোনটা নিঃসরণ হয় বলে আমাদের তখন অত ভালো লাগে। নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলবার সময়ও মস্তিষ্কের ভালোলাগার কেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক সেক্সের মত! তাই এত আনন্দ!
[Harvard University Social Cognitive and Affective Neuroscience Lab এর গবেষণা] 

কারো ডোপামিন এর খুব অভাব থাকলে সে পার্কিনসন রোগ নিয়ে জন্মাবে। আর অল্প ডোপামিন থাকলে অনেকেই নেশা শুরু করে। ডোপামিনের নিঃসরণ খুব আনন্দদায়ক, তাই সবাই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঝুঁকে পড়ছে খুব।

ফেসবুকের ব্যাপারটা ভাবুন তো! সেখানে কী হয়? যখন ঢুকলাম, তখন নোটিফিকেশন বারে যদি দেখা যায় ৭ টা (যদিও সংখ্যাটা আজকাল বিশ-ত্রিশের কম কখনো থাকেনা) নোটিফিকেশন আছে, তখন মনটা একটু নেচে ওঠে। এর কারণ হল, আমি না থাকতে সাতটা ব্যাপার ফেসবুকে ঘটে গেছে, যাতে আমি সম্বন্ধিত- এমন একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে যায় মনে। যখন দেখবেন, অমুক অমুক এবং আরও সাতজন আপনার ফটোতে কমেন্ট করেছে, সাথে সাথেই সেখানে ক্লিক করতে ইচ্ছে করে। স্বাভাবিক। মস্তিষ্ক তো নেচে উঠবেই, সাতজন আপনার সম্বন্ধে কথা বলেছে! একবার কল্পনা করুন, আপনাকে কেউ ফোন করে বলল, 'জানিস আজ আমাদের আড্ডায় তোর কথা উঠেছিল। তুই কত ভালো ছবি আঁকিস, সেটা নিয়ে সবাই অনেক কিছু বলল!' আপনার জন্য সেটা প্রচণ্ড ভালোলাগার ব্যাপার হবে না? সেই আড্ডায় বড়জোর আট-দশজন মানুষ ছিল। কিন্তু ফেসবুক আপনার জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। 'হেঃ হেঃ... ক্লাসে বসে ফেসবুক চালাই' - লিখতেও যে আট-দশজনের আলোচনা পাওয়া যায় আপনার সম্বন্ধে, সেটা তো বেশ আশারই বটে। আর আপনি যে ক্লাসে বসে ফেসবুক চালিয়েছেন, তাতে লাইক দিয়েছে দেড়শ মানুষ, তারমানে আপনি দুই-তিনশ মানুষকে বলে ফেলেছেন আপনি যে ক্লাসে বসে আজ ফেসবুক চালিয়েছেন! ভাবুন তো, একটা মেয়ে স্কুলে গিয়ে তার ক্লাস, অন্য সেকশন, জুনিয়র, সিনিয়র, পিয়ন, আয়া এরকম দুইশ মানুষকে ধরে ধরে আলাদা আলাদা করে বলছে, 'জানো, আজ ক্লাসে ফেসবুক চালিয়েছি'। আপনি কী বলবেন? মেয়েটা অসুস্থ?

ধরুন আমার প্রেমিকার সাথে আমি দেখা করছি। সে নিশ্চয়ই চাইবে দেখা হবার মূহুর্তে সুন্দর কোন একটা 'লুক'-এ থাকতে। সেটা তার জন্য, আমার জন্য ভালোলাগার হবে। কিন্তু সে যদি ঠোটদুটো গোল করে, ঘাড় কাত করে আমার সামনে আসে? এবং মুখে প্রচুর প্রসাধনী মাখা থাকে? আমার কেমন রাগ হবে? সেও কখনোই সেটা পারবে না। কিন্তু সেই দৃশ্যটা সেলফি তুলে সে অন্তত পাঁচশ মানুষকে দেখাতে পারবে অনায়াসে। আর সেই কাজটা যদি সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় করে? সামনে পরা পাঁচশ জন মানুষকে ঘাড় কাত করা, ঠোট গোল করা চেহারা দেখিয়ে যায়?

ধরুন, আমি একটা শহরে গিয়েছি একটা অনুষ্ঠানে। ভেন্যু একটা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দুপুরের খাবারে আমাদেরকে আপ্যায়ন করা হল একটা অনুষদের ডীন অফিসে। ডীন স্বয়ং লজ্জিত হাসি হেসে বললেন, ব্যবস্থা তেমন কিছু করতে পারিনি। সেই গল্প আমি আমার শহরে ফিরে এসে আমার বন্ধুকে বললাম, ক্লাসে গিয়ে দু-চারজনকে বললাম। আমার প্রিয়জনকে বললাম। এটুকুই সারা! কিন্তু আমি যদি ক্লাসের সবাইকে বলতে শুরু করি? পেছনে হেসে সবাই গড়াগড়ি খাবে, হচ্ছেটা কি এসব! ছেলেটা আত্মম্ভরিতায় একদম গেল! কিন্তু আমার সাথে যে ছিল, সে? একটা ছবি তুলল সে ডীন অফিসে, ছড়িয়ে গেল হাজার মানুষের কাছে। প্রত্যেকেই বলল, আহা তোমার কি ভাগ্য! 

আমি একজনকে দুষ্টুমি করেই একটা ফুল দিলাম। সেটা নিয়ে জোক করবার জন্যই নিজেরা মিষ্টি মিষ্টি দুটো কথা বললাম। সেই গল্পটা যদি আমি অন্য কাউকে বলি, তাহলে হয়েছে! সে বলবে, ভাবে উড়ছ বুঝি এক মেয়েকে ফুল দিয়ে? কিন্তু মেয়েটা নিঃসংকোচে শত শত মানুষকে সেটা জানিয়ে দেবে। দুয়েকজন বড়জোর বলবে, 'পেয়েছ তো কি হয়েছে?' তবে তার শেষে একটা হাসির ছবি দিয়ে সেটাও জানিয়ে দেবে, বলাটা দুষ্টুমি, সার্কাজম।

এই উদাহরণগুলোতে দ্বিতীয় ভাগে যা বলেছি, সব যে হাস্যকর তা কিন্তু না। সেলফ-ডিস্ক্লোসিং ডিসকাশনের সুযোগ পেয়ে কে ছাড়তে চাইবে? মানুষ ভালোলাগা চায়। কিন্তু সাধারণ জীবনে সেটা করতে গেলে নার্সিসিজম, আত্মম্ভরিতা, আর কত কিছু! 

আমি যদি কোথাও ঘুরতে যাই, আমি জানাতে পারব বড়জোর দশ-বারোজন মানুষকে। আমার বাবা-মাও ভালো করে জানবেন না। কিন্তু আমার সাথে যে গিয়েছে, সে জানাতে পারবে কয়েকশ মানুষকে। বন্ধু, সিনিয়র, আধ-পরিচিত, স্যার, খুড়তুতো-পিসতুতো ভাই-বোন আর কত মানুষ যে জানবে! কতজন বলবে, ওদিকটায় তো ঘুরতে গেলে, শুধু আমাদের এখানে আসোবার সময়টুকুই হয় না।

মাথায় চুল না থাকলে কেউ মনে রাখে না! 

নিউরোসায়েন্স আর সোশ্যাল সায়েন্স মিশ খেয়ে একটা জিনিস বলে দিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমগুলো সেক্সের মতই আকর্ষণিয় কিছু। তাই বলে যার ঘরে বউ আছে, সে নিশ্চয়ই একটু পরপর আচল ধরে টানাটানি করতে থাকবেনা সারাটা দিন, সারাটা বছর!