শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

নরক যাত্রী



আমি একটা খুনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুনটা এ সপ্তাহে করার খুব ইচ্ছে। যে মানুষটাকে খুন করব, সে আমার বন্ধু, নাম সজল। আমরা ছোটবেলা থেকে এক পাড়ায় বড় হয়েছি। ওর বাবা এখন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। আমরা এক ব্যাটে ক্রিকেট খেলে, মারামারি করে, পালিয়ে ঘুরতে গিয়ে এতটা বড় হয়েছি। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হবার পর সব কেমন উল্টেপাল্টে গেল। আমি ইকোনমিক্স, সজল সোশায়োলজি। নির্বাচনের হৈচৈ শুরু হবার পর ওর পড়ায় মন উঠে গেল, আর বাবা রিটায়ার্ড করে ফেলায় পেনশনের টাকায় আমাদের চলছিল না, তাই আমাকে পরিশ্রম শুরু করতে হল। মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম, আর এখন আমি থার্ড ইয়ারে। এরমধ্যে দুবার ড্রপ দিয়ে সজল ফার্স্ট ইয়ারেই রয়ে গেছে। প্রথম ওকে বদলে যেতে দেখেছি নির্বাচনের আগের সপ্তাহে। এলাকার যেসব ছোকড়া এক প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়ালে দু ঘন্টা মিছিল কিংবা দু'শ পোস্টার মেরে আসত, তাদের সাথে ও দাঁড়িয়ে পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফুঁকছিল। আমরা যে আগে লুকিয়ে সিগারেট খাইনি, তা নয়। কিন্তু বড়রা হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, সবাই পাড়ার মুরুব্বি, তাঁদের সামনে! এবং একটু পর পাশের পাড়ার একটা মেয়ে যখন সাইকেল নিয়ে গেলো, তখন ওর সাথের পাঁচ-ছয়জন ছোকরা চেঁচিয়ে বাজে কথার ফুলঝুরি ছোটাতেই ও হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, এবং আমাকে দেখেই সজল হাঁক ছেড়েছিল, 'কিরে সাধুবাবা! হবে নাকি দুই টান?'

সেই থেকে ওকে ঐ দলেই দেখা যায়। অথচ একটা সময় আমাদের খুব কম্পিটিশন ছিল পড়াশুনায়। ওর সাথে বহু সিনেমা দেখতে গেছি, ওর পয়সায়। কিন্তু ওর বাবা মেয়র হবার পরে ওর সাথে তেমন কথাই হয়নি আর কখনো আমার। প্রথম দিকটায় দেখা হলে কুশল বিনিময়টা হত, পরে সেটাও বন্ধ হয়। আমি সরে আসি, তেমন না। ওরও আগ্রহ ছিল না আমার মত 'সাধুবাবা'র সাথে মেশার।

হঠাৎ করে খুন করবার প্রয়োজনটা হয়ে পড়েছে। বাবা রিটায়ার করার পর আমাকে টিউশনি করাতে হয়। আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে, নাম পড়শি। শুকনো পাতলা দেহ, লম্বাটে মুখের কোনে একটা বাঁকা হাসি, কাজলটানা চোখ, লম্বা চুল- এই হল পড়শি, যাকে দেখলেই আমার বুকের কোনে চিনচিনে ব্যাথা হয় কয়েক বছর ধরে। কিন্তু কিছু বলবার সাহস আমার নেই। এবার ইন্টারমিডিয়েট-এ ভর্তি হল ও। ওকেই পড়াচ্ছি। বাসার বাজার থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল, কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া, সবকিছু আমারই করতে হয়। বোনটাকে পড়ানোও একটা কাজ। এর মধ্যে নিজের পড়াশুনার চাপ তো আছেই। পড়শিকে পড়ানো আমার দিনের একমাত্র ভালো সময়। সপ্তাহে তিনদিন ওকে পড়াতে হয়। সন্ধ্যার পর যখন যাই, প্রতিবারই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পড়াতে গিয়ে আমি চুপ হয়ে যাই, একমনে চেয়ে থাকি। প্রতিবারই পড়শি হেসে বলে, চোখ গেলে দেব কিন্তু! পরের দিকে কোত্থেকে যেন একটা খেজুর কাঁটা এনে রেখে দিয়েছিল পড়ার টেবিলে।

দুই.
ছয়টায় আমি পড়াতে যাই, পড়শির কলেজ থেকে আসবার কথা এর অনেক আগেই। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম ও আসেনি। উদ্বিগ্ন হয়ে ওর মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর বাবা তখনো ফেরেননি অফিস থেকে। ব্যাংকের ছোট চাকরি তাঁর। আমি ভেতরে বসলাম। আমারও কিছুটা দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কাজের মেয়েটা বিস্কুট আর রং চা দিয়ে গেল। আমি একটু চুমুক দিয়ে রাখতেই পড়শির মায়ের হুংকার শুনতে পেলাম। প্রচণ্ড এক চড় কষিয়েছেন তিনি এক ঘন্টা দেরি করে আসা মেয়েকে। আমি ছুটে গেলাম সামনের ঘরে চাচিকে থামাতে। কিন্তু তিনিই তখন আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। পড়শির মুখ পাথরের মত শক্ত, ঠাণ্ডা চাহনি, ঠোটের কোনে হাসির বদলে জমাট রক্ত, চুল অবিন্যাস্ত, এবং একটু খুড়িয়ে ও দরজার দিকেই আসছিল। আমার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসল, পড়শি! একবার আমার চোখের দিকে তাকাল, শ্লেষমাখা সেই চাহনিতে আমার বুক কেঁপে উঠল। ঠিক আমার পাশে পৌঁছবার পর খুব আস্তে করে বলল, 'সজল'। এবং আমাকে পাশ কাটাবার পর আবার পেছনে তাকাল, 'আপনার বন্ধু'। এবারে স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখতে পেলাম সেই চোখে। এবং সেই মূহুর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুন করতে হবে আমাকে একটা। 

ওর বাবা যখন বাসায় এলেন, ততক্ষণে ওর মায়ের কান্না বন্ধ হয়েছে। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে। পড়শি বাড়ির পেছন দিকটায় একটা চেয়ার পেতে বসে আছে একলা। আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম চুপ করে। চাচা এলেন, জানলেন, এবং আমার হাত চেপে ধরে বললেন, 'বাবা! কাউকে বোলো না।' ফেরার আগে প্রচণ্ড আশঙ্কা নিয়ে গেলাম পড়শির কাছে। মাথায় হাত রাখতে গিয়েও পারলাম না। পেছন থেকে বললাম, 'কথা দাও, বেঁচে থাকবে।' আলতো করে মাথা নাড়ল ও। আমি অবাক হলাম, এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলাম।

কিন্তু পরদিন জানলাম, পাড়ার ছোকরারা সবাই জানে এই গল্প। তিনজন ছিল ওরা। মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে অনেকগুলো দোকান। এরপর একটা বাড়ির পেছন দিককার দেয়াল, এবং সেটার ওপাশে একটা স্টুডিও। এটার মালিক মেয়রের পরিবার। সজলের আড্ডা দেবার একটা জায়গা এই স্টুডিও। তার সামনে দিয়ে আসতে হয় পড়শিকে। 

পুলিশ কোন মামলা নিল না। অদ্ভুত অশ্লীল সব প্রশ্ন ছুড়ছিল ওসি আমার এবং ওর বাবার সামনেই পড়শিকে। মুখ শক্ত করে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল পড়শি। একটা সময়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওসি শব্দ করে হেসে ফেলল। লম্বা সে হাসি থামিয়ে সে বলল, এসব কিছুই হয়নি। শুধু শুধু তোমরা গল্প ফাঁদতেছ ক্যান

বোরকা পরা পড়শিকে নিয়ে আমরা যখন থানা থেকে বের হয়েছি, তখন ওর বাবা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। একটা কুকুর শুয়ে ছিল সামনে, আমি শরীরের সব শক্তি জুগিয়ে একটা লাথি কষালাম। আৎকে উঠে কুকুরটা লাফিয়ে সরে গেল। একটু দূরে যেয়েই ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কাছে আসবার সাহস নেই যেন। লাথি মারার সাথে সাথে পড়শি শুধু বলল, 'আকাশ ভাই!

আমার খুনের ইচ্ছা আরও প্রবল হল।

তিন.
আমি ঠিক করেছি খুনটা ওই স্টুডিওতে করব। স্টুডিওর লোক চলে যায় সন্ধ্যার সাথে সাথে। প্রায় দিনই ওখানে সজল বসে, আটটা বাজতে অন্য বন্ধুরা আসে। আমার সময় ছয়টা থেকে আটটা। আমাকে আসতে হবে উল্টো দিক দিয়ে। ওখানকার রাস্তায় আলো নেই। এসে সোজা স্টুডিওতে ঢুকতে হবে। খুনটা করে বেরিয়ে আসব। আমার কাছে বাজারের ব্যাগ থাকবে। সেটাতে না, ছুরিটা থাকবে আমার কোমরে। কাগজ পেঁচিয়ে। কোরবানির সময়ে এই ছুরিটা ব্যবহার হয়। বাসায় কেউ না থাকা অবস্থায় আমি শীল ঘষে ছুরিটা ধার দিয়েছি। ওটা আছে আমার বিছানার নিচে। 

বাজারের ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যায় বের হলাম। প্রায়ই আমি বাজারটা বিকেলে করি। পটল, ঝিঙে, পাঙ্গাশ মাছ কিনে ফেরার পথে আমি দেখেশুনে ঢুকে পড়লাম দি নিউ সুচিত্রা স্টুডিওতে। কেউ আমাকে দেখেনি, এবং সজল একলা ছিল এখানে। আমি বললাম, চার কপি পাসপোর্ট, এক্ষুনি দিতে পারবি?
ওর আধখাওয়া সিগারেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'ইকোনমিক্স ছেড়ে কেরানিগিরি ধরবি?'
'না। একটা সোশ্যাল সোসাইটিতে এপ্লাই করব' উত্তেজনা চেপে বললাম। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে যোগ করলাম, 'ভেতরে আয় তো!'
আমি ভেতরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে কোমর থেকে ছুরিটা বের করে পেঁচানো কাগজ ছাড়ালাম। সজল সামনে থেকে বলল, 'তোর সাজ হল?'
'হয়েছে'। গলার স্বর কেপে উঠল যেন একটু।

প্রথমে যখন ছুরিটা ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, মূহুর্তে ওর চোখ বিস্ফোরিত হল। সজল এর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওকে মারা হচ্ছে। এবং দ্বিতীয়বার ছুরি চালাবার আগেই আকুতি করে উঠল, 'জানে মারিস না ভাই'। ভাই ডাকটা যেন আমাকে থমকে দিল। ছেলেবেলায় ভাই পাতিয়েছিলাম আমরা। আমি হিংস্র স্বরে বললাম, 'পুলিশে সব স্বীকার করবি আজকেই?' হুমড়ি খেয়ে পরল ও কার্পেট বিছানো মেঝেতে। কার্পেট লাল হয়ে যাচ্ছিল রক্তে। আবারো কাতর স্বরে বলল, 'জানে মারিস না। তোর পায়ে পরি।' এরপর হড়বড় করে বলল, 'স্বীকার করব আমি। আজকেই স্বীকার করব সব!' একই কথা বারবার বলতে লাগল সজল। বাঁচবার প্রচণ্ড আকুতি শুনতে পেলাম আমি ওর কণ্ঠে। কিন্তু ও একজনের বাঁচবার সাধ নিয়ে খুব সহজে ফুর্তি করেছে, গত সপ্তাহে, এখানেই। 

হঠাৎ করে আমার সব উত্তেজনা পানি হয়ে গেল। কোমল স্বরে আমি বললাম, 'আমি যদি তোর একটা চোখ উপড়ে নেই?' ওর তখন তেমন হিতাহিত জ্ঞান নেই। কাতরে বলে উঠল, 'জানে মারিস না। দুইটা চোখ নে। জানে মারিস না। জানে...' আমার তেমন কানে ঢুকল না। আমি সত্যি ছুরিটা ওর একটা চোখে ঢুকিয়ে দিলাম।  শেষবারের মত 'জানে মারিস না' বলে ও জ্ঞান হারাল। দুটো ক্ষত করেছি আমি। একটা চোখ নষ্ট করেছি, আর পেট। তেমন কিছুই না, আমার মনে হল। এক্ষুনি ওকে হাসপাতালে নেয়া দরকার, মনে মনে ভাবলাম আমি। 

বের হবার আগে হাতের রগগুলো কেটে দিলাম। ওর দেহের শেষ ঝাঁকুনিটা দেখে আমি বুঝলাম, আমি একটা খুনি। 

পাঁচ.
গ্রিলের ওপারে দাঁড়িয়ে পড়শি বলল, 'ফাঁসির পর কি আপনি নরকে যাবেন?'
আমি আলতো করে মাথা দোলালাম,'যাব'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন