আমার
ভাবির যেদিন মেয়ে হয়, সেদিনকার কথা। আমি শুনলাম কথাটা, অনেক দূরে বসে, এবং ধ্বক করে উঠল বুক। মেয়ে! আবারো সেই
ভোগান্তি!
আমাদের জন্য ভোগান্তি নয়, কিন্তু আমি যতই অস্বীকার করি, আমার প্রিয়তমা ভাতিজীর জন্য
সেটা ভোগান্তির হবেই। ওর জীবনের নানারকম কষ্টের একমাত্র কারণ হবে ও নারী। এবং সেই কষ্টগুলোর প্রতিটির পেছনে কাজ করবে অন্য কারো
অন্যায়। আমরা সেটা সহ্য করব। প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে সয়ে
আসছি।
বাণী গল্প রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন যেভাবে-
ফোঁটা
ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে, মাটির কাছে ধরা দেবে ব'লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে
পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।
তাদের
জন্য অল্প জায়গার জগৎ, অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই-- আপনার সব
কথা, সব
ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন,
আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা
হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।
আচ্ছা, একটা বখাটের দল যখন রাস্তায় হেঁটে যাওয়া একটা মেয়ের দিকে
একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, তখন
মেয়েটার কেমন লাগে? আমি সাইকোলজির ছাত্র নই, আমার ওসব বোঝার
সত্যিকারের ক্ষমতাটা
নেই। আসলে, পুরুষ হয়ে জন্মানোয় আর কখনো ওটা জানার সুযোগ হবে না। এবং এই বিশ্রী স্বাদটা নেবার ইচ্ছে কারো শখে
জাগবেও না কখনো। কিন্তু সেই পুরুষগুলো? যাদের চোখ জ্বলজ্বল করে,
কিংবা ঠোট ভিজে ওঠে? ওদের কখনো মনে হয়েছে কথাগুলো?
ভারতীয়
একটা সাইটে দেখলাম ওঁরা লিখেছে,
মেয়েদের এটা করা উচিৎ না,
মেয়েদের ওটা করা উচিৎ না...
আসলে
মেয়েদের এসব চুতিয়াদেরকে জন্ম দেয়াই উচিৎ না যারা এসব বলে।
এটা তাঁরা ছেপেছে কৌতুকের মত করে ইলাস্ট্রেশন করে। আসলে মেয়েরা মা
হন বলে তাঁরা এত মহৎ হয়ে পড়েন। যে ছেলেটা ঐসব
অশ্লীল কথা সাবলীল ভঙ্গিতে বলে যেতে
পারে সামনে দিয়ে
হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে, তার কখনো মনে পড়ে না, তার মা একসময় তরুণী ছিলেন, এবং তার মত অনেক ছেলেরা ঠিক ঐভাবে ঐ মন্তব্যগুলো করেছে তাঁকে নিয়ে। সেই মা কখনো জানতে পারেন না, তরুণী থাকতে যে শব্দগুলো তাঁকে সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে জীবনে,
সেই শব্দগুলো তাঁর
ছেলে বাইরে অবলীলায় উচ্চারণ করে কোন মেয়েকে কুঁকড়ে দিয়ে অট্টহাসিতে
মেতে উঠেছে, এবং ঘরে এসে অবলীলায় ভাত গিলছে। মায়ের কথাটা ভাবলে হয়ত ভাতগুলো গলায় আটকে যেত।
সাম্যতা বা স্বাধীনতার অর্থ কিন্তু আমরা আজকাল প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি।
কিন্তু সেই গুলিয়ে ফেলবার অনেক আগে, একদম শুরুতেও কিন্তু আমরা বৈষম্য টেনে আনি। ধরুন আমার বাবা যদি আমাকে আজ ফোন করে বলেন, 'তুমি লিখেটিখে কিছু টাকা পাও না? আগামী
মাসে আমাকে দেড় কোটির মত টাকা দিও তো, জমি কিনব একটা।' আমি কি তখন হাসব? আমাকে
যদি বলা হত ভাতিজার জন্য চিপস কিনে এনো, কিংবা মায়ের জন্য এক কেজি আপেল এনো, সেটা স্বাভাবিক ছিল। সেটা হয়। কিন্তু
কেমন করে আমি দেড় কোটি জোগাড় করব? সামর্থের প্রশ্ন আসে এতে। কিন্তু সেই সামর্থ্য কি আমার আছে? এক মাসে সেই টাকা জোগাড় করার মত সামর্থ্যও
কি আমার আছে? নেই। আমরা সাম্যতার বিচার করব শারিরীক-মানসিক সামর্থ্য দিয়ে।
আমি মানুষ হিসেবে ভালো, সেটা দাবী করার মত জায়গাটায় আমি কখনো
পৌঁছতে পারব না। কিংবা আমি তেলবাজ, সেটাও কিন্তু কেউ কখনো বলেনি। তবু, যখন কারো সাথে কথা
হয়, সেটা খুব শীঘ্রই সখ্যতায় পৌঁছে। মিশে যাওয়ার ব্যাপারটায় কখনো
আমাকে ভাবতে হয়না পাশের মানুষটা ছেলে, কিংবা মেয়ে। কারণ আমি দুই মহলেই ঠিক একই কথাগুলো, একইভাবে বলি। যা আমি আমার পরিবারের
মানুষগুলোর সামনে বলতে পারি, যেগুলো আমি মেয়েদের সামনে বলতে পারি, সেগুলো আমি ছেলেদের সামনে বলতে পারি। নিজেকে লুকোবার চেষ্টা তেমন করতে হয় না কোথাও, কখনো। ঠিক সে কারণেই অতি ধার্মিক মেয়েটা, কিংবা অতি অহং এ ভরা মেয়েটা, কারো সমস্যা হয় না আমার সাথে সাবলীল ভঙ্গীতে কথা বলে যেতে। কমফোর্টের জায়গাটায় সবসময় পাওয়া
যায় আমাকে। দ্রুত মিশে যাওয়ার চর্চাকে কখনোবা মনে
হয় মেয়ে পটানো স্বভাব। কিন্তু সেসবের
ভিত্তি যদি থাকত, তবে এতদিনে আমার কঙ্কালটাও আস্ত রাখত না মেয়েরা।
নারীবাদের ব্যাপারে নানাজনের নানারকম ভাবনা আছে। কারো কাছে এটা অশুচি, কারো কাছে এটা অসভ্যতা, কারো
কাছে এটা অধর্ম। এদেশে, কিংবা পৃথিবীতে অল্প কজন মানুষের কাছে এটা সমাজের সুখমন্ত্র। পুরুষসমাজ আসলে এমন একটা জায়গায়
পৌঁছে গেছে আজকাল, যেখানে
কিছু মেয়ের আসলে উদ্ধত হবার প্রয়োজন আছে। কারণ সাম্য-সৌহার্দ্যের প্রশ্নে আমরা অধিকাংশ পুরুষ উদ্ধত। এই
উদ্ধতাকে ধুলোয় মাটিচাপা দিয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ পেতে
হলে কখনো উদ্ধত, কখনো হিংস্র হওয়াতে দোষ নেই। মানুষজন যখন তসলিমা নাসরিনকে গাল ভরে গালি দেয়, তারা তসলিমার কথাগুলো না শুনেই গালি দেয়। এ পর্যন্ত
তারা জীবনে যা দেখেছে তা হল অন্ধ ঘৃণাকারীর গালিপূর্ণ সমালোচনা, কিংবা তসলিমার লেখার কোন পরিচ্ছদ এর মাঝখান থেকে তুলে আনা একটা বাক্য,
একটা গল্প। যেটা
অশ্লীলতার কথা বলে। কিন্তু সেই বাক্যের কাছেপিঠের কথাগুলো সহ সেটা কেউ
পড়লে তখন কারো মনে হত না ওটা অশ্লীলতা। যুক্তিপূর্ণ কথাই লাগত।
আমি একজন নারীবাদী। এবং একজন উগ্র-অন্ধ নারীবাদী। পরিস্থিতি আসলে হাজার
বছর ধরে এতটা নিচে নামছে একটা মহলে, যেটাকে রোধ করতে উগ্রতার প্রয়োজন আছে। আমি আমার বন্ধুদেরকে (বন্ধু শব্দটায় ছেলে আর মেয়ে আলাদা করার চর্চা আমার নেই) উৎসাহিত করি মার্শাল আর্ট শিখতে, এবং বলি, রাস্তায় কোন এক বখাটেকে পিটাতে পারলে ভালো কোথাও খাওয়াব। এবং এটার পূনরাবৃত্তি চলতে
থাকবে।
এই সময়ে, আমাদের আসলে নারীদেরকে কী দেয়ার আছে? একটা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ।
এরচেয়ে বেশি কিছু চাই না। সাম্যতা মানে মিছিলের পিকেটিঙয়ে মেয়েদেরকে চাই না। সকল পেশায় মেয়েদেরকে চাই না। শুধু চাই, আমরা পুরুষেরা আমাদের মন্তব্যগুলো এমনভাবে করব, আমাদের দৃষ্টিগুলো এমন রাখব, যেন
মেয়েরা আমাদের পাশ দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে
যেতে পারে। যেন সন্ধ্যার পর বাইরে থাকার জন্য তাঁদের একটা পুরুষসঙ্গীর
প্রয়োজনবোধ না হয়, কিংবা বাসে সিট খালি থাকা সত্ত্বেও একটা পুরুষের পাশে বসা এড়াতে দাঁড়িয়ে থাকতে না
হয়।
যদি আমরা এই পরিবেশটা দিতে পারি, তবে
তাঁদের ইশকুলে যেতে, পছন্দের পড়াটা পড়তে বাধা থাকবে না। আর সেটা হলে দেখব, সব বদলাতে শুরু করেছে। একটা শিক্ষিত মেয়েকে যদি প্রশ্ন করো,
'মেয়ে হয়ে তোমাকে ঠিক
কোন জায়গাটায় ভুগতে হয়?' একটা উত্তরই আসবে, আশেপাশের মানুষগুলোর আচরণ। বাইরে একলা
বেরুবার, নিজের মত করে নিজের কাজটা করার প্রচেষ্টায় যে বিশ্রী বাধাটা সবসময় থাকে, সেটা সরে গেলেই
সাথে সাথে আমরা দেখতে
পাব, সাম্য আর সৌহার্দ্যের একটা চিত্র দেখা
যাচ্ছে সবদিকে। নারী-পুরুষ সমতার মানে যার যার
নিজের শারিরিক-মানসিক যোগ্যতা দিয়ে
সমাজের প্রতিটা মানুষ
নিজের কাজটুকু করতে পারছে। আর সেই কাজটার বিকাশে পাচ্ছে প্রাপ্ত সুযোগ আর অধিকারটা।
একটা দেশের সবচেয়ে উঁচু চেয়ারটায় নারীরা বসলেই বলে বসা যায় না, এটা নারীর ক্ষমতায়নের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর আমরা
নারীর ক্ষমতায়নও চাই না। আমরা চাই যোগ্যতম মানুষটার ক্ষমতায়ন। নারী কোটায়
যে ক্ষমতাটা দেয়া হয়, সেগুলোর অস্তিত্ব আমাদের দরকার নেই একদম। আমাদের দরকার সেই ক্ষমতার
জায়গাটা অধিকার করে নিতে সমাজের প্রতিটা মানুষের যে
সুযোগ আর পরিবেশ দরকার, সেটা তৈরী করে দেয়া।
আমরা যে নারীর কথা আলাদাভাবে বলছি, একটা
দিবস পালন করছি, সেটা নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। সেই আপত্তিটা আমার কাছে অযৌক্তিক ঠেকে। সমাজের
অবস্থাগুলো আমাদেরকে ঠেলে দিয়েছে অপছন্দের একটা
জায়গায়। সে জায়গাটায় নারীরা সত্যিই
নিগৃহীত। আমাদের সেটা
নিয়ে কথা বলতে তো অবশ্যই হবে। আমরা তো অন্ধের মত বলতে পারি না, নারী-পুরুষ সমান, তাই নারী দিবস আলাদা করে করা অপমানের।
নারীরা বিবর্তনের ধারায় নির্দিষ্ট কিছু কাজে পটু। ঠিক তেমনি কিছু কাজে
পটু পুরুষেরা। তার প্রায় সবকিছুই হাজার বছর
ধরে গড়ে ওঠা সিস্টেম। আম গাছে আম হবে, জাম গাছে জাম- এর মতই প্রাকৃতিক সিস্টেম এসব। কিন্তু
তার মাঝখানে মাঝখানে কিছু ব্যাপার ঢুকে গেছে, চাপিয়ে দেয়া। এর পেছনে কাজ করেছে নারীদের শারীরিক এবং মানসিক দূর্বলতা। যেখানে সেসব দূর্বলতার কারণে পুরুষের উচিৎ ছিল সেসব
কাজে সহায়তা করা,
সেখানে সুযোগ নিয়ে
চাপিয়ে দিয়েই গা ঝাড়া দিয়ে বসেছে পুরুষেরা।
আমার ভাগ্নি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মামা তুমি কাপড় ধুতে পারো?
আব্বু তো পারে না। আমি আসলে কাপড় ধুতে পারি। ভাবি অসুস্থ থাকাকালে
ভাতিজার মল-মূত্র মাখা কাপড়ও ধুতে পারা মানুষ আমি। আমি
কাপড় ধুতে পারি, আমি রাঁধতে পারি, আমি ঘর ঝাঁট দিতে পারি, বাড়ীর বাচ্চাদেরকে ইশকুলে নিয়ে যেতে পারি। এসব করতে পারি বলে কিন্তু আমি বাজার করা, ক্যালকুলাস
করা, কোষের গঠন আত্মস্থ করা ভুলে যাইনি।
যখন আমি এক মেয়ের সাথে গভীর গভীর সুখস্বপ্নের কথা বলতাম, তখন আমি বলতাম, আমি বড় হয়ে তেমন কাজ করব না। ঘরের কাজগুলোই দেখব। আবার অনেক অনেক
পড়াশুনা, দুটো অনার্স, দুটো-তিনটে মাস্টার্স, পিএইচডি করার স্বপ্নের কথা শোনাতাম। সেই মেয়েটা একদিন বলেছিল, আমার যখন চাকুরী হবে, তখন তুমি তোমার ইচ্ছেমত পড়াশুনা করো। এই কথাটা শুনে আমার আনন্দ হচ্ছিল খুব। আমি তো চেয়েছি অমন
একটা সুযোগ। সেটা সিস্টেমের মাঝে মাঝে ঢুকে পড়া
অসংগতিগুলোর প্রতিবাদের মত হতে পারে।
কিন্তু হায়!
শেষপর্যন্ত ওসব শুধু সুখস্বপ্ন।
যারা বলে, আমাদের সমাজের সিস্টেমের আগাগোড়া
অসঙ্গতিতে ভরা, তারা ভুল বলে। আমাদের সিস্টেমের মাঝে মাঝে কিছু নিষ্ঠুর সমস্যা। সেসবকে
আমাদের দূর করতে হবে। নারীদের জন্য তৈরী করে দিতে হবে
তাদের স্বস্তির জায়গাটা। তবে আমরা সৌহার্দ্য পাব, আমরা ভালোবাসা পাব। আর সেটা পেয়ে গেলেই মায়ের প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হবে।
অসাধারণ লিখেছেন।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন