শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮

প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধের নবীনবরণ

অবশেষে সেই অনুষ্ঠানটা শেষ হল। সেই অনুষ্ঠান, যার জন্য আমাদের সবার রাতের দৈর্ঘ্যটা কমে গিয়েছিল। কত হাসি-কান্না রাগ-অভিমানের জন্ম দিয়ে হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেল, ঠিক আন্দাজও করা গেলনা। মনে পড়ছে মিলনের রুমের আগ্রাসী ছারপোকাদের কথা। মহুয়ার সেই তাড়া, "ওমর কিউআর কোড এখনো দিলি না?" মিলির সেই আব্দার, ওয়েলকাম ডান্সের জন্য একটা জামা, অন্য নাচের জন্য আরেকটা। সবার চাওয়ার কমতি নেই। সবকিছুর শেষ চাওয়া, অনুষ্ঠানটা অসাধারণ হওয়া চাই।

সেই নবীন ব্যাচকে কিছুই ভাবতে হয়না সাজগোজের বাইরে, যাদের নিয়ে এত এত আয়োজন। ভাবতে হয় আমাদেরকে, ২০তম ব্যাচকে। শুরুটা ক'বে, কারও মনে থাকবার কথা না। দিন কাছে আসে, আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাতের ঘুম কমে যায়। একসময় আমার রাতে বাসায় ফেরাও থেমে যায়। রিহার্সালে মূল একটা চরিত্রকে পাওয়া যায়না, রাগে ফেটে পড়ে আর সকলে। প্রক্সি দিয়ে চলে রিহার্সাল। বাজেটের অভাবে কাজ করতে থাকা মানুষগুলোর জন্য যে লাঞ্চ আসে, সেটা দেখে কারও কণ্ঠে বাজে, "কইতরের খাবার মাইনষেরে দিছে"।



রিহার্সালে আশার চেয়ে দুশ্চিন্তা আর হতাশাই আসে ঘুরেফিরে। কাজের জন্য যখন একজনকে পাওয়া যায়না, মুখ দিয়ে অশ্লীল সব গালি আপনা চলে আসে আমার আর মিলনের মুখে। সায়মার মত শান্তশিষ্ট মেয়েটাও হিংস্র ভঙ্গীতে বকাবকি করে কাউকে। কখনও উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। রাগ করে একজন করে ঘোষণা দেয় অনুষ্ঠান বর্জনের। একজন বর্জন করলে বিপদ বাড়ে। তার বিপরিত চরিত্রে নাচবার-গাইবার মানুষটা হঠাৎ করে অসহায় হয়ে পড়ে। অভিমানে ঘোষণা দেয় সেও অনুষ্ঠানের কাছাকাছি নেই আর। এসব চলতে থাকে দিনভর।

এর বাইরে আছে স্যারদের সঙ্গে কাজ। এক একটা ডিজাইন এপ্রুভ করতে চার-পাঁচবার করে দৌড়াতে হয় স্যারদের রুম, নীলক্ষেত কার্জন, শিক্ষক কোয়ার্টার আর কতখানে! তবু শেষে ব্যানারে রয়ে যায় একটা ভুল। দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠতে হয় সকলকে।

ছোট্ট ছোট্ট অভিমানের গল্পগুলো বেদনার। এবং সময়টা এমন, কিছু বলবারও থাকেনা, মনে রাখবারও সময় হয়না। কারও সঙ্গে হয়ত বাজে রকমের দূর্ব্যবহার করলাম, একটু পর অন্য কাজের মাঝখানে জানলাম সে কাঁদছে। আরও পরে শুনলাম মানুষটা অসুস্থ হয়ে গেছে। একবার কাছে গিয়ে দুঃখিত বলবার সুযোগটুকুও হয়না। আরও কতজন অভিমানে, রাগে কোথায় গিয়ে বসে থাকে, টেরও পাইনা। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকবার পরে দেখতে পাই জোরে গান চলছে, সাথে নাচের রিহার্সাল। জনৈক রমণীর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নাচের নিমন্ত্রণ জানাই। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যাত হই। পরমুহূর্তে সুন্দরীর মায়া হয় আমার অভিমানে ভরা মুখ দেখে। হাত ধরে উঠে আসে নাচবার জন্যে। আর তখনই মিলন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, তাড়াতাড়ি আয় ব্যাটা, স্যার ফোন দিচ্ছে বারবার। আমার আর নাচা হয়না।

এইসব গল্প কক্ষণো শেষ হবেনা। বিকালের প্রচণ্ড ভীরে পাইকারি মার্কেটে মহুয়া আর রিন্তুর রঙ নিয়ে গবেষণা আমাদেরকে ক্লান্ত করে তোলে। কাগজের রঙটা আরেকটু হালকা হলে ভালো হয়, সেই আবদারে আমাদের ঘুরতে হয় আরও সাতটি দোকান। আশ না মেটায় যেতে হয় রিক্সা করে অনেক দূরের কোথাও। রিকশায় যেতে যেতে আমি আর মিলন শপথ করি, বিয়ে কখনো করবনা। মেয়েদের সব আবদার মেটাতে নেই, এই নীতিতে রিন্তুর সঙ্গে ঝগড়া করি তিন প্যাকেটের বদলে দুই প্যাকেট বেলুন কিনতে। ১২ টাকা দামের চার্ট পেপারের বদলে ৩ টাকার রঙ্গীন কাগজ কেনার জন্য ঝগড়া চলে অবিরাম।

আমার নাচ, আমার গান, আমার অভিনয় আগে কেন দিচ্ছিসনা সেই অভিযোগ শুনতে শুনতে আমাদের কানের পোকা নড়ে যায়। শিডিউল তৈরী হয় বারবার। দশবার বিশবার চলে কাটাকাটি। শেষে একটা শিডিউল তৈরী হয়, যারমধ্যে মিশে আছে কত্ত চিৎকার, গালি আর অভিমান! তবু অর্ধেক অনুষ্ঠান যাবার পর আবারও চলে অনুরোধ-হুমকি মান-অভিমানের খেলা। ভেঙ্গে পড়ে সব পরিকল্পনা।

শেষ দুটো দিন আমি আর মিলনের সাথে ছুটতে পারিনা। দুই-তিনটা কম্পিউটার নিয়ে অডি কিংবা রুমের এককোণে বসে থাকি। চলে একটার পর একটা কাজ। আর সেইসাথে চলে দূর্ব্যাবহার।

যাদেরকে কক্ষণো ভাবিনি পড়াশুনার বাইরে কোন কাজে পাওয়া যাবে, তাদেরকে দেখি মনযোগ ভরে বসে বসে সারাটা দিন কাজে ব্যাস্ত। ধর্মীয় কারণে যারা ক্যামেরার সামনে যেতে যায়না, তাদের পরিশ্রম দেখি অভিনেতাদের ছাড়িয়ে যায়। এবং অনুষ্ঠানের আগের রাতে হলে ফিরবার আগে পুষ্টি ভবনকে লাগে অসম্ভব সুন্দর!

খামের ডিজাইনে ভুল হওয়ায় তানভীরকে কতইনা খাটতে হয়। নয়নকে বারবার গান ট্রিম করার বা জোড়া লাগানোর আবদার মেটাতে হয়। সানজিদা, নাইমা, তাহসীন শুধু সামনের সারিতে বসে শুধু নোট তোলার মেয়ে যে নয়, তা তাদের হাতের কাঁচি-কাগজ-আঠা বলে দেয়। আশিকের দিনভর প্র‍্যাক্টিস (কাউকে মুগ্ধ করার জন্য কিনা সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি) চলে অবিরাম। স্ক্রিপ্ট নিয়ে সায়মা-শ্রাবণ-সোহাগকে বসে থাকতে হয় মেলা সময়। যে রিংকিকে ভাবতাম মহিলা লেনিনজার, সেও এমন সব ফুড জোকস বের করে দেয় 'কে হতে চায় আলুপতি'র জন্য যে আমরা সক্কলে টাস্কি খেয়ে যাই। আল আমিন, আয়াত, খবির, জায়েদ যারা ক্লাস শেষ হবার আগেই পারলে দৌঁড়ে পালায়, তাদের অনুশীলনে পরিশ্রম দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। আমেনা, মিলি, অন্তরা, যূথীকে দেখি এক নাচ এত এতবার করে নাচে, আমারই চোখ বিরক্তিতে ভরে যায়। মণ্ডলকে দেখি গান চালু করে বন্ধ করে দিতে দিতে হয়রান। ইমরান, যে হাত পা নড়াতে পারতনা, তার নাচ একসময় হয়ে ওঠে রিহার্সালের অন্যতম আকর্ষণ। সেঁজুতি-ঈশিতাকেও দেখি আলাদা হয়ে গুজুর গুজুর না করে কত আমোদে মেতে কাজ করে যাচ্ছে। নবনী আপু, সুরভী আপুও সাজ আর অলঙ্করণ নিয়ে পড়ে থাকে। মীমের বাবা দাঁড়িয়ে থাকে, আর ও যখন আমাদের সঙ্গে সজ্জা নিয়ে বকবক করে যায়, তখনই সবাইকে লাগে অন্তঃপ্রাণ। হাছিন ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকেন ভিডিও তৈরী নিয়ে। তানিন যখন বেলুন ফুলায় তখন হেসে খুন হয় সবাই। এরকম সবার অবদান থাকে অনুষ্ঠানের প্রতিটি পরিবেশনায়।

এই সবকিছুর পরে অনুষ্ঠানের দিন সায়মা যখন আমাকে যন্ত্রণা করতে থাকে আরেকটু প্র‍্যাক্টিসের জন্য, আমার সে সময় হয়না। রেগে যায় ও। মিলনকে আমার প্রয়োজন হয়, কিন্তু বেচারাকে ছুটে বেড়াতে হয় এখানে সেখানে। সানজিদা ফোড়ন কাটে, দেখে মনে হচ্ছে ওমর আর মিলনের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে। আমি উত্তর করি, আমার মেয়েকে কেটে বুড়িগিঙ্গায় ভাসাতে কি পারি? আমার ছেলে, আর মিলনের মেয়ের বিয়ে।

সাউন্ড-লাইট চেক করবার সময় মেয়েদের এত অভিযোগ, আবদারে ক্লান্ত হয়ে যায় সাউন্ডের লোকজন। অভিযোগ যা আছে তা যেন তাদেরকে না বলে আমাকে বলে, সেই হয় তাদের চাওয়া।

কিন্তু এত দুঃখ হঠাৎ করে উবে যেতে থাকে অনুষ্ঠান শুরু হবার পরে। প্রত্যেকের পারফরমেন্স এত অসাধারণ। এসকরবিক এসিড, যে কিনা ক্লাসে স্যারদের সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পেত, সে যখন চার মিনিট টানা হাসিয়ে যায় পুরো দর্শক, তখন বুক ভরে যায়। রিহার্সাল ছাড়া যে কন্টেন্ট স্টেজে উঠিয়েছি, তা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ব্যাকস্টেজে আমরা একটা শব্দই বারবার বলি, অস্থির! প্রত্যেকের প্রতিটা মুভমেন্ট, প্রতিটা বাক্য আমার কাছে মনে হতে থাকে মধুর মত! খুশিতে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়। সেই মুহূর্ত কখনো ভুলবনা, যখন আয়াত বলে, "ভাইয়া আমি আপনাকে আমার সব দিয়ে দেব।" সোহাগের এক্সপ্রেশন যেন সত্যিকারে অভিনেতার মত। মীম-আমেনার মুখভঙ্গি দেখে আমি হেসে গড়াই। ইমরানের নাচ দেখি মুগ্ধ হয়ে। সবার পারফরমেন্স এত এত অসাধারণ!

একসময় সব শেষ হয়। শেষ নাচটায় অডিটোরিয়াম কাঁপে। তারচেয়ে দ্রুত কাঁপে আমার হার্ট। অডিটোরিয়াম স্থির হবার সাথে সাথে আমি মিলনের পাশে গিয়ে বসি। দুজনে দুজনের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি কয়েক সেকেন্ড। একহাত তুলে একটা হাই ফাইভ। সেই শব্দহীন কথোপকথন আমাদের সফলতার উচ্ছ্বাসটুকু প্রকাশ করে দেয় মুহূর্তে। আমাদে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়।

এই প্যারাটুকু শুধুমাত্র সহপাঠীদের জন্য। তোরা জানিস আমরা নিজেরা আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্ট। সেটাই দরকার ছিল। প্রত্যেকে এই অনুষ্ঠানে নিজেদেরকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিস, আমার প্রশংসা করবার ভাষা নেই। কেউ স্টেজে, কেউবা স্টেজের পেছনে। নিজেদেরকে নিয়ে আমাদের যত সংশয় ছিল, সব তো দূর হল। এর মাঝখানে কেউ হয়ত ইচ্ছা থাকবার পরও স্টেজে উঠতে পারিসনি। কেউ হয়ত ইচ্ছে থাকবার পরও একটা পার্ট পাসনি। সেটা নিয়ে কষ্ট পাওয়া সাজেনা। আমরা বিশতম ব্যাচ, সফলতা বিশতম ব্যাচের। ব্যাক্তিগত সফলতার কথা ভেবে আমরা নিজেদেরকে ছোট করবনা। আমার খুব সাধ ছিল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত হবে, কবিতা হবে, হয়নি। শিডিউলে যখন কাটছাট করতে হয়েছে, আমার কবিতাই সবার আগে ফেলে দিয়েছি। এটাকে ত্যাগ বলবনা। এটা আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য করতে হয়েছে। এই সফলতার জন্য কিছুদিন মিলন, আমি যে ভয়ঙ্কর সব গালি মুখে উচ্চারণ করেছি, সবটুকুর জন্য আমরা দুজনে ক্ষমা চাই। যাদের কথা রাখতে পারিনি তাদের কাছে ক্ষমা চাই। যাদেরকে রিহার্সালের জন্য চাপ দিয়েছি, বকেছি, তাদের কাছে ক্ষমা চাই। আর সায়মা, যে মেয়েটা কথা বলবার সময় কণ্ঠে মধু ঝড়াত, তার কণ্ঠেও বিষ ঝড়েছে শিডিউল নিয়ে। এই মেয়েটাও তোদের সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে, আমরা সবাই, সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এই মান-অভিমান আমাদের বন্ধুত্বকে আরও গাঢ় করবে সেই আমার প্রত্যাশা।

আর ১৫ তম ব্যাচের ভাইয়া-আপুরা, যাদের জন্য আয়োজনের অর্ধেকটা, তাদেরকে ব্যাক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানাতে আমরা ভুলে গিয়েছি, সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। শুধু গ্রুপের পোস্টে আপনাদেরকে নিমন্ত্রণ জানানো আমাদের ধৃষ্টতা। ক্ষমা চাই। আপনারা অগ্রজ, ছোটদের ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, সে আশা আমাদের আছে। আপনাদের উপস্থিতি আরও বেশি হলে আমাদের প্রাণ ভরে যেত। আপনাদের জন্য রইল ভালোবাসা। সামনের পথের জন্য রইল শুভকামনা।

নবীন ছেলে-মেয়েরা, তোদের জন্য রইল ভালোবাসা, আর একটুখানি হলেও পড়াশুনা করবার উপদেশ।

সবশেষে, ইনস্টিটিউটের সকলকে জানাই ধন্যবাদ। বিশেষ করে ডিরেক্টর ম্যাডাম, ছাত্র উপদেষ্টা স্যার, কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যার, এবং কিছু তরুণ শিক্ষক, যাদের সহায়তা পেয়েছি প্রতিটি পদে।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের আইএনএফএস। প্রাণে ভরপুর। এখানে আমাদের বন্ধুত্বটা হবে আরও গাঢ়, আরও মধুর, সেই আশায় আশায় আবারও কোন একটা অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায় রইলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন