এক
সজীব মিয়ার জীবনে আজ দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছে। সে বেশ উত্তেজিত।
রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গল, এবং সে দেখল একটা মোটরসাইকেল তার পাশে
গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা লোক কাতরাচ্ছে তার পাশেই। সজীব মিয়ার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল,
এবং ক্ষুধাটা উবে গেল, যখন মোটরসাইকেল থেকে
ছিটকে পরা লোকটার ব্যাগ খুলে দেখতে পেল ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। সে ব্যাগটা
ধীরেসুস্থে চেইন আটকে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে যে জামা-প্যান্ট, একটা পুটুলিতে কিছু জিনিস, একটা ছেড়া তেল চিটিচিটে
কাঁথা আর একটা পিভিসি ব্যানার- সেসব গুটিয়ে হেঁটে হেঁটে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের
দিকে চলে গেল। একসিডেন্ট হয়েছে জহির রায়হান রোডে যেখানটায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার
উঠে গেছে তার পাশে। সে তখন ঘুমিয়েছিল বার্ন ইউনিটের ধার ঘেষে ফুটপাতে। এখানে এমনি
প্রতিদিন বেশ কিছু মানুষ ঘুমায়। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় সবাই উঠে
মাথার ওপরের ঠাইয়ের খোঁজে চলে গেছে কোথাও। সজীব মিয়ার ঘুম পেয়েছে বৃষ্টি থামবার পরে।
তাই এই জায়গাটা একদম খালি পেয়ে গেছে।
সজীব মিয়ার বয়স হবে সাতাশ কিংবা আটাশ। এককালে তার চামড়া তামাটে
রঙয়ের হয়তবা ছিল,
কিন্তু এখন একদম নেই। রোদে পুড়ে চেহারা হয়েছে কুচকুচে কালো। খোঁচা খোঁচা
দাড়ি আছে, গোঁফ আছে। নানারকম নেশার ভারে তার শরীর দাঁড়িয়েছে
কাঠির মতন, লম্বাটে মুখ, চিবুকের হাড়
স্পষ্ট। হাড় জিরজিরে শরীরে জটাধরা উষ্কোখুষ্কো চুলের
সাথে কপালের শিরাগুলোকে মনে হয় বলিরেখার মত। শরীর তার সামনের দিকে একটু বেঁকে
গেছে। এখানকার আরো অনেক নেশাখোরের মত তারও জীবনে নির্দিষ্ট কোন ভাবনা কিংবা
উদ্দ্যেশ্য নেই। কিন্তু হঠাৎ করে এতগুলো টাকা তার হাতে চলে আসায় সে কিছুটা বিচলিত।
তার যে প্রয়োজন ছিল না টাকার, তা নয়। কিন্তু প্রতিদিন এটা
সেটা কুড়িয়ে, এদিক সেদিকে ছুটকো চুরি করে যা হত, তা দিয়ে আধপেট ভাত আর নেশা হলেই হল।
কিন্তু এতগুলো টাকা সে কেমন করে সামলাবে, তা নিয়েই ভাবছিল উদ্যানের একটা ছাতিম গাছের তলায় শুয়ে। দুর্ভাবনার সাথে কিছু আনন্দও জুটেছে। বেশ কিছু নেশার তার অনেকদিনের শখ। সেগুলোর খরচ বেশি বলে কখনো সে সুযোগ পায়নি। এবার সে আশা পূরণ হবেই।
কিন্তু এতগুলো টাকা সে কেমন করে সামলাবে, তা নিয়েই ভাবছিল উদ্যানের একটা ছাতিম গাছের তলায় শুয়ে। দুর্ভাবনার সাথে কিছু আনন্দও জুটেছে। বেশ কিছু নেশার তার অনেকদিনের শখ। সেগুলোর খরচ বেশি বলে কখনো সে সুযোগ পায়নি। এবার সে আশা পূরণ হবেই।
স্ট্রিট লাইট, উদ্যানের লাইটসহ শহুরে নানা আলো সবটা জায়গাই একটু
একটু আলোকিত করে রেখেছে। এরমধ্যে সজীব মিয়া উঠে বসে ব্যাগটা খুলল। আগে নিশ্চিত হয়ে
নিল ধারেকাছে কেউ নেই, কেউ তাকে দেখছে না। মোট এগারোটা
বান্ডিল আছে ব্যাগে। এত টাকা নিয়ে এই গভীর রাতে যে লোক বাইক চালাচ্ছিল, সে নিশ্চয়ই খুব ভালোমানুষ নয়, এই ভাবনাই এলো সজীব
মিয়ার মাথায়। তারপর সে তার পুটলি থেকে একটা শার্ট বের করে টাকাগুলো তাতে বেঁধে
নিল। এরপর সেটা পুটুলিতে ঢুকিয়ে ব্যাগটা সেখানে ফেলে রেখেই আবার হাঁটতে লাগল অন্য
পথে।
এবার শুয়ে পড়ল দোয়েল চত্বরের ভেতরে। এখানেই ঘুম ভাঙল অনেক বেলা হবার
পর। ঘুম ভাঙার পর তার মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। কিছুক্ষণ পর তার মনে পরে তার মাথার নিচে
অনেক টাকা। কত টাকা সে নিজেও জানে না, তবে এটা নিশ্চিত যে এখন বড়লোক হয়ে
গেছে। ধীরে সুস্থে উঠে হাঁটতে শুরু করতেই তার ক্ষুধা বোধ হয়। কাল বিকেলে অনেক
কষ্টে পঞ্চাশ টাকা জোগাড় হয়েছিল, কিন্তু সেটা 'ওষুধ' কিনতেই বেরিয়ে গেছে। এই ওষুধ জিনিসটা থাকে
ছোট্ট একটা সবুজ কাচের টিউবে, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্তে ঢুকিয়ে
দিলেই শরীর হালকা হয়ে আসে। পুরো শরীরে অদ্ভুত চাঞ্চল্য আসে। তার একটা সিরিঞ্জ আছে।
প্রতিবার ব্যবহার করার আগে সে সিরিঞ্জের সুঁইটাকে লাইটার দিয়ে পুড়িয়ে নেয়। এখানকার
সব নেশাখোরই এই কাজটা করে থাকে। তিন-চারবেলা না খেয়ে থাকতে তার কখনোই কষ্ট হয়না,
কিন্তু তার পিঠে ঝোলানো অতগুলো টাকা ক্ষুধাকে প্রবল রূপ দিতে থাকে।
কিন্তু সজীব মিয়ার সাহস হয় না আস্ত একটা পাঁচশ টাকার চকচকে নোট নিয়ে খাবার কিনতে
যাবে কোথাও। নিশ্চয়ই সেই টাকার ব্যাপক খোঁজ চলছে, ফাঁস
হয়ে যেতে পারে তার পুটলির খোঁজ, এই দুশ্চিন্তায়
সে ঘামতে থাকে। মুসা খাঁ মসজিদের পাশ থেকে সে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে নেয়।
এরপর ক্ষুধা পেটে সোজা হাঁটতে শুরু করে হাইকোর্ট ধরে কমলাপুরের দিকে। শাপলা
চত্বরের ওখানে একটা লোক অর্ধেকটা সিগারেট ফেলে দিয়ে মাড়িয়ে দিতেই তার সজীব মিয়ার
চোখ চকচক করে ওঠে। সে ঐ চ্যাপ্টা বিড়িটা উঠিয়ে তার পুটুলির লাইটার দিয়ে ধরিয়ে নেয়।
লম্বা একটা টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তেই মন হাল্কা লাগতে শুরু করে। তার সব শখ পূরণ হবে
শীঘ্রই। কারণ যত টাকা প্রয়োজন শখ মেটাতে, তার প্রয়োজনীয় টাকা
তার এখন আছে।
দুই
কমলাপুরে পৌঁছে বস্তিতে ঢুকবার আগে রেলস্টেশনের বাথরুমে ঢুকে সে
চারটে পাঁচশ টাকার নোট বের করে রাখে পুটলির মধ্যেই। হিরোইন নামে একটা জিনিসের সাধ
তার কখনোই মেটেনি। রেললাইনের পাশে পান বেচে এক বুড়ি, তার কাছে মিলবে সাধের পাউডার। বুড়ি
বলে দেড় হাজার টাকার পাউডারে এমন শান্তি আসবে, যেন আর
ডাইল-ইয়াবা ভাল্লাগবে না। সে বিশ্বাস করে। বুড়িই একটা কয়েন, একটা
চকচকে পাঁচ টাকার নোট দেয়। রেললাইনের পাশেই বসে বসে বুড়ির শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে সে
টানতে থাকে জিনিসটা। সজীব মিয়া আগে দেখেছে অনেককে এটা সেবন করতে, তাই তার কাছে কঠিন হয়না পুরো আনন্দটুকু পাওয়া। আশেপাশে হেঁটে যাওয়া
মানুষেরা কেউ কেউ আগ্রহ ভরে দেখে, দুয়েকটা নেশাখোর লোভাতুর
দৃষ্টিতে তাকায়, আর সজীব মিয়ার শরীরটা যেন আস্তে আস্তে হালকা
হয়ে আসে। সব ক্লান্তি একে একে দূর হয়ে যেতে থাকে। এবং চোখ থেকে ঘুম পুরো উবে যায়।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর কখনো তাকে ছুঁতে পারবেনা- এমন বোধ হতে শুরু করে সজীব মিয়ার।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই সুখের আবহে মটকা মেরে পরে থাকবার পরে তার শরীর আবার ভর পেতে
শুরু করে। এবং ক্ষুধাটা আবার ফিরে আসে।
ডাস্টবিনের ধারে প্রচুর কাক ভিড় করেছে। সজীব মিয়া সেদিকে এগিয়ে
বুঝতে পারে, অনেক বিরিয়ানির আধখাওয়া প্যাকেট ফেলে গেছে। সে দুয়েকটা প্যাকেট তুলে টকটক
গন্ধ পায়। মাংস খেতে খেতে তার সুখ বাড়তে থাকে। একটা কাক যখন তার হাতের প্যাকেট থেকেও
খেতে আসে, তখনও সে একদমই বুঝতে পারে না, এই পৃথিবীতে তার প্রতিযোগি অনেক।
হিরোইন তার আসল শখ ছিল না। শখের জিনিসটা সে পাবে শহিদুল্লাহ হলের
সামনে। মাত্র পাঁচশ টাকার অভাবে সেটা কখনো হয়ে ওঠেনি। তার পায়ে একটা ক্ষত আছে।
অনেকখানি জায়গা জুড়ে সে ক্ষত। চামড়া অনেকটা পঁচেই গেছে। সেখানটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
সে সবসময় তাজা রাখে। ওখানে সিরিঞ্জ ঢুকালে সে অন্যরকম আনন্দ পায়। ক্ষতটায় যখন মাছি
এসে বসে, তার শরীর শিরশির করে ওঠে। উৎপল নামে এক ছোকরা এসেছে চানখারপুলে, ও একটা নতুন নেশা আবিষ্কার করেছে। তবে সেজন্য ওকে আগেই পাঁচশ টাকা দিতে
হয়। ঐ নেশাটা অন্যরা যখন করে, সজীব মিয়া অনেকদিন পাশে বসে দেখেছে।
সাধ্য-সাধনাও করেছে উৎপল কে। কোন লাভ হয়নি। ছিনতাই-টিনতাই এখানে করা যায় না,
তাই পাঁচশ টাকাও হয়না তার।
তিন
অন্ধকারে শহীদুল্লাহ হলের সামনের রাস্তায় সজীব মিয়া শুয়ে আছে। তার
মুখ একটা ছেড়া কাপড়ে ঢাকা। মুখেও উৎপল একটা কাপড় গুজে দিয়েছে। সে কিচ্ছু দেখতে
পাচ্ছে না, রাস্তার আওয়াজ তার কাছে নিঃশব্দের মতই, কারণ সে
সবসময় রাস্তার ধারে থাকে। তার পায়ের ক্ষততে চার সিরিঞ্জ 'ওষুধ'
দিল উৎপল। এমনি সে এক সিরিঞ্জ দেয়, কিন্তু
বেশি টাকা পাওয়ায় সে চার সিরিঞ্জের ব্যপারে আগ্রহী হয়েছে। সজীব মিয়ার শরীর কেঁপে
ওঠে। এরপর উৎপল আসল জিনিস বের করে। একটা বোতল থেকে খানিকটা তরল ঢেলে দেয় পায়ের
ক্ষততে। ঠাণ্ডা হয়ে আসে শরীর। এরপর একটা পলিথিন থেকে বের করে একধরনের পোকা। ঢেলে
দেয় পায়ের ক্ষততে। কেচোর মত দেখতে পঁচা ভাত-তরকারিতে চাষ করা সে সাদা পোকাগুলো
ক্ষতটায় কিলবিল করে ওঠে। চমৎকার একটা অনুভূতি পা থেকে আস্তে আস্তে পুরো শরীরে
ছড়িয়ে পরে সজীব মিয়ার। আবারো বোতল থেকে সেই তরল ঢালা হয় খানিকটা। শরীর শিরশির করতে
থাকে। আস্তে আস্তে কাঁপুনি আসে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ কৌতূহল ভরে তাকায়।
ছাত্ররা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সে দৃশ্য। আর প্রচণ্ড সুখানুভূতিতে মূর্ছা যায় সজীব
মিয়া। উৎপলের কাজ শেষ। সে এখন যাবে আরেকজনের কাছে।
চার
ধীরে ধীরে চোখ খোলে সজীব মিয়া। মুখ থেকে কাপড় সরায়। অন্ধকার, মানুষের চলাচল
নেই। এটা কি সেদিনেরই রাত, নাকি দুয়েকটা দিন কেটে গেছে সে
জানে না। জানলেও কিছু হত না। তার ভাবনা নেই এতে। তার কোন জীবন নেই যেখানে দিনের
হিসেব লাগে। তার মনে পড়ে পোকা দিয়ে কি খেলটাই না দেখাল উৎপল। এই তো তার চাওয়া ছিল।
হেরোইন চাওয়া ছিল। একসাথে কয়েক সিরিঞ্জ ওষুধ চাওয়া ছিল। সবই মিলেছে। তখন সে বুঝতে
পারে তার মাথার নিচে পুটলিটা নেই। দুইপাশে তাকায়, তার মোড়ানো
কাঁথা আর পিভিসি ব্যানার আছে। নিশ্চিত হয় পুটলিটা খুইয়েছে সে। তারপর আলস্যে শরীরটা
আরেকটু ছড়িয়ে দেয়। এবং তখন প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার পেট চোঁ চোঁ করে ওঠে।
উঠে এদিক-সেদিক চেয়ে সে বুঝতে পারে, কোথাও কোন খাবার নেই। ময়লার
ঢিবিটাও নেই। আবার শোয় সে। ভাবে, একটা ওষুধের টিউব, পঞ্চাশ টাকা। সকালে তার পঞ্চাশ টাকা লাগবেই। এর বেশি কিছুই তার প্রয়োজন
নেই। এই এটুকুই তার সব চাওয়া। পঞ্চাশ টাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন