শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

নরক যাত্রী



আমি একটা খুনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুনটা এ সপ্তাহে করার খুব ইচ্ছে। যে মানুষটাকে খুন করব, সে আমার বন্ধু, নাম সজল। আমরা ছোটবেলা থেকে এক পাড়ায় বড় হয়েছি। ওর বাবা এখন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। আমরা এক ব্যাটে ক্রিকেট খেলে, মারামারি করে, পালিয়ে ঘুরতে গিয়ে এতটা বড় হয়েছি। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হবার পর সব কেমন উল্টেপাল্টে গেল। আমি ইকোনমিক্স, সজল সোশায়োলজি। নির্বাচনের হৈচৈ শুরু হবার পর ওর পড়ায় মন উঠে গেল, আর বাবা রিটায়ার্ড করে ফেলায় পেনশনের টাকায় আমাদের চলছিল না, তাই আমাকে পরিশ্রম শুরু করতে হল। মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম, আর এখন আমি থার্ড ইয়ারে। এরমধ্যে দুবার ড্রপ দিয়ে সজল ফার্স্ট ইয়ারেই রয়ে গেছে। প্রথম ওকে বদলে যেতে দেখেছি নির্বাচনের আগের সপ্তাহে। এলাকার যেসব ছোকড়া এক প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়ালে দু ঘন্টা মিছিল কিংবা দু'শ পোস্টার মেরে আসত, তাদের সাথে ও দাঁড়িয়ে পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফুঁকছিল। আমরা যে আগে লুকিয়ে সিগারেট খাইনি, তা নয়। কিন্তু বড়রা হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, সবাই পাড়ার মুরুব্বি, তাঁদের সামনে! এবং একটু পর পাশের পাড়ার একটা মেয়ে যখন সাইকেল নিয়ে গেলো, তখন ওর সাথের পাঁচ-ছয়জন ছোকরা চেঁচিয়ে বাজে কথার ফুলঝুরি ছোটাতেই ও হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, এবং আমাকে দেখেই সজল হাঁক ছেড়েছিল, 'কিরে সাধুবাবা! হবে নাকি দুই টান?'

সেই থেকে ওকে ঐ দলেই দেখা যায়। অথচ একটা সময় আমাদের খুব কম্পিটিশন ছিল পড়াশুনায়। ওর সাথে বহু সিনেমা দেখতে গেছি, ওর পয়সায়। কিন্তু ওর বাবা মেয়র হবার পরে ওর সাথে তেমন কথাই হয়নি আর কখনো আমার। প্রথম দিকটায় দেখা হলে কুশল বিনিময়টা হত, পরে সেটাও বন্ধ হয়। আমি সরে আসি, তেমন না। ওরও আগ্রহ ছিল না আমার মত 'সাধুবাবা'র সাথে মেশার।

হঠাৎ করে খুন করবার প্রয়োজনটা হয়ে পড়েছে। বাবা রিটায়ার করার পর আমাকে টিউশনি করাতে হয়। আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে, নাম পড়শি। শুকনো পাতলা দেহ, লম্বাটে মুখের কোনে একটা বাঁকা হাসি, কাজলটানা চোখ, লম্বা চুল- এই হল পড়শি, যাকে দেখলেই আমার বুকের কোনে চিনচিনে ব্যাথা হয় কয়েক বছর ধরে। কিন্তু কিছু বলবার সাহস আমার নেই। এবার ইন্টারমিডিয়েট-এ ভর্তি হল ও। ওকেই পড়াচ্ছি। বাসার বাজার থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল, কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া, সবকিছু আমারই করতে হয়। বোনটাকে পড়ানোও একটা কাজ। এর মধ্যে নিজের পড়াশুনার চাপ তো আছেই। পড়শিকে পড়ানো আমার দিনের একমাত্র ভালো সময়। সপ্তাহে তিনদিন ওকে পড়াতে হয়। সন্ধ্যার পর যখন যাই, প্রতিবারই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পড়াতে গিয়ে আমি চুপ হয়ে যাই, একমনে চেয়ে থাকি। প্রতিবারই পড়শি হেসে বলে, চোখ গেলে দেব কিন্তু! পরের দিকে কোত্থেকে যেন একটা খেজুর কাঁটা এনে রেখে দিয়েছিল পড়ার টেবিলে।

দুই.
ছয়টায় আমি পড়াতে যাই, পড়শির কলেজ থেকে আসবার কথা এর অনেক আগেই। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম ও আসেনি। উদ্বিগ্ন হয়ে ওর মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর বাবা তখনো ফেরেননি অফিস থেকে। ব্যাংকের ছোট চাকরি তাঁর। আমি ভেতরে বসলাম। আমারও কিছুটা দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কাজের মেয়েটা বিস্কুট আর রং চা দিয়ে গেল। আমি একটু চুমুক দিয়ে রাখতেই পড়শির মায়ের হুংকার শুনতে পেলাম। প্রচণ্ড এক চড় কষিয়েছেন তিনি এক ঘন্টা দেরি করে আসা মেয়েকে। আমি ছুটে গেলাম সামনের ঘরে চাচিকে থামাতে। কিন্তু তিনিই তখন আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। পড়শির মুখ পাথরের মত শক্ত, ঠাণ্ডা চাহনি, ঠোটের কোনে হাসির বদলে জমাট রক্ত, চুল অবিন্যাস্ত, এবং একটু খুড়িয়ে ও দরজার দিকেই আসছিল। আমার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসল, পড়শি! একবার আমার চোখের দিকে তাকাল, শ্লেষমাখা সেই চাহনিতে আমার বুক কেঁপে উঠল। ঠিক আমার পাশে পৌঁছবার পর খুব আস্তে করে বলল, 'সজল'। এবং আমাকে পাশ কাটাবার পর আবার পেছনে তাকাল, 'আপনার বন্ধু'। এবারে স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখতে পেলাম সেই চোখে। এবং সেই মূহুর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুন করতে হবে আমাকে একটা। 

ওর বাবা যখন বাসায় এলেন, ততক্ষণে ওর মায়ের কান্না বন্ধ হয়েছে। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে। পড়শি বাড়ির পেছন দিকটায় একটা চেয়ার পেতে বসে আছে একলা। আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম চুপ করে। চাচা এলেন, জানলেন, এবং আমার হাত চেপে ধরে বললেন, 'বাবা! কাউকে বোলো না।' ফেরার আগে প্রচণ্ড আশঙ্কা নিয়ে গেলাম পড়শির কাছে। মাথায় হাত রাখতে গিয়েও পারলাম না। পেছন থেকে বললাম, 'কথা দাও, বেঁচে থাকবে।' আলতো করে মাথা নাড়ল ও। আমি অবাক হলাম, এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলাম।

কিন্তু পরদিন জানলাম, পাড়ার ছোকরারা সবাই জানে এই গল্প। তিনজন ছিল ওরা। মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে অনেকগুলো দোকান। এরপর একটা বাড়ির পেছন দিককার দেয়াল, এবং সেটার ওপাশে একটা স্টুডিও। এটার মালিক মেয়রের পরিবার। সজলের আড্ডা দেবার একটা জায়গা এই স্টুডিও। তার সামনে দিয়ে আসতে হয় পড়শিকে। 

পুলিশ কোন মামলা নিল না। অদ্ভুত অশ্লীল সব প্রশ্ন ছুড়ছিল ওসি আমার এবং ওর বাবার সামনেই পড়শিকে। মুখ শক্ত করে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল পড়শি। একটা সময়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওসি শব্দ করে হেসে ফেলল। লম্বা সে হাসি থামিয়ে সে বলল, এসব কিছুই হয়নি। শুধু শুধু তোমরা গল্প ফাঁদতেছ ক্যান

বোরকা পরা পড়শিকে নিয়ে আমরা যখন থানা থেকে বের হয়েছি, তখন ওর বাবা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। একটা কুকুর শুয়ে ছিল সামনে, আমি শরীরের সব শক্তি জুগিয়ে একটা লাথি কষালাম। আৎকে উঠে কুকুরটা লাফিয়ে সরে গেল। একটু দূরে যেয়েই ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কাছে আসবার সাহস নেই যেন। লাথি মারার সাথে সাথে পড়শি শুধু বলল, 'আকাশ ভাই!

আমার খুনের ইচ্ছা আরও প্রবল হল।

তিন.
আমি ঠিক করেছি খুনটা ওই স্টুডিওতে করব। স্টুডিওর লোক চলে যায় সন্ধ্যার সাথে সাথে। প্রায় দিনই ওখানে সজল বসে, আটটা বাজতে অন্য বন্ধুরা আসে। আমার সময় ছয়টা থেকে আটটা। আমাকে আসতে হবে উল্টো দিক দিয়ে। ওখানকার রাস্তায় আলো নেই। এসে সোজা স্টুডিওতে ঢুকতে হবে। খুনটা করে বেরিয়ে আসব। আমার কাছে বাজারের ব্যাগ থাকবে। সেটাতে না, ছুরিটা থাকবে আমার কোমরে। কাগজ পেঁচিয়ে। কোরবানির সময়ে এই ছুরিটা ব্যবহার হয়। বাসায় কেউ না থাকা অবস্থায় আমি শীল ঘষে ছুরিটা ধার দিয়েছি। ওটা আছে আমার বিছানার নিচে। 

বাজারের ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যায় বের হলাম। প্রায়ই আমি বাজারটা বিকেলে করি। পটল, ঝিঙে, পাঙ্গাশ মাছ কিনে ফেরার পথে আমি দেখেশুনে ঢুকে পড়লাম দি নিউ সুচিত্রা স্টুডিওতে। কেউ আমাকে দেখেনি, এবং সজল একলা ছিল এখানে। আমি বললাম, চার কপি পাসপোর্ট, এক্ষুনি দিতে পারবি?
ওর আধখাওয়া সিগারেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'ইকোনমিক্স ছেড়ে কেরানিগিরি ধরবি?'
'না। একটা সোশ্যাল সোসাইটিতে এপ্লাই করব' উত্তেজনা চেপে বললাম। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে যোগ করলাম, 'ভেতরে আয় তো!'
আমি ভেতরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে কোমর থেকে ছুরিটা বের করে পেঁচানো কাগজ ছাড়ালাম। সজল সামনে থেকে বলল, 'তোর সাজ হল?'
'হয়েছে'। গলার স্বর কেপে উঠল যেন একটু।

প্রথমে যখন ছুরিটা ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, মূহুর্তে ওর চোখ বিস্ফোরিত হল। সজল এর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওকে মারা হচ্ছে। এবং দ্বিতীয়বার ছুরি চালাবার আগেই আকুতি করে উঠল, 'জানে মারিস না ভাই'। ভাই ডাকটা যেন আমাকে থমকে দিল। ছেলেবেলায় ভাই পাতিয়েছিলাম আমরা। আমি হিংস্র স্বরে বললাম, 'পুলিশে সব স্বীকার করবি আজকেই?' হুমড়ি খেয়ে পরল ও কার্পেট বিছানো মেঝেতে। কার্পেট লাল হয়ে যাচ্ছিল রক্তে। আবারো কাতর স্বরে বলল, 'জানে মারিস না। তোর পায়ে পরি।' এরপর হড়বড় করে বলল, 'স্বীকার করব আমি। আজকেই স্বীকার করব সব!' একই কথা বারবার বলতে লাগল সজল। বাঁচবার প্রচণ্ড আকুতি শুনতে পেলাম আমি ওর কণ্ঠে। কিন্তু ও একজনের বাঁচবার সাধ নিয়ে খুব সহজে ফুর্তি করেছে, গত সপ্তাহে, এখানেই। 

হঠাৎ করে আমার সব উত্তেজনা পানি হয়ে গেল। কোমল স্বরে আমি বললাম, 'আমি যদি তোর একটা চোখ উপড়ে নেই?' ওর তখন তেমন হিতাহিত জ্ঞান নেই। কাতরে বলে উঠল, 'জানে মারিস না। দুইটা চোখ নে। জানে মারিস না। জানে...' আমার তেমন কানে ঢুকল না। আমি সত্যি ছুরিটা ওর একটা চোখে ঢুকিয়ে দিলাম।  শেষবারের মত 'জানে মারিস না' বলে ও জ্ঞান হারাল। দুটো ক্ষত করেছি আমি। একটা চোখ নষ্ট করেছি, আর পেট। তেমন কিছুই না, আমার মনে হল। এক্ষুনি ওকে হাসপাতালে নেয়া দরকার, মনে মনে ভাবলাম আমি। 

বের হবার আগে হাতের রগগুলো কেটে দিলাম। ওর দেহের শেষ ঝাঁকুনিটা দেখে আমি বুঝলাম, আমি একটা খুনি। 

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক


Copyright © 2015 Tony Fed


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। এটা শুধু যে সময় নষ্ট করে তা না। অভ্যাস, দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সক্রিয়তা অনেকটা কমিয়ে দেয়। সেজন্য আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই। সামাজিক যোগাযোগের অন্য অনেক সাইটেই একাউন্ট আছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের বাংলাদেশে তেমন কেউ চালায় না বলে তাতে এডিক্টেড হতে পারিনি। যখন সবাই সেগুলো (টুইটার, গুগল প্লাস এসব) চালাবে, তখন ছেড়ে দেব। 

একটা বন্ধু আমাকে বলত, তুই বড় নার্সিসিস্ট! সবসময় নিজের কথা শোনাতে চাস। সত্যি বটে। কিন্তু কেন এটা আমার কাছে কোন সমস্যা লাগে না, এবং নার্সিসিস্টই রয়ে গেছি, তার ব্যাখ্যা আমার আছে। তার আগে বলি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর কথা।

মানুষ নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে ভালোবাসে। সমাজবিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, মোটামুটি দিনের চল্লিশ শতাংশ কথা আমরা নিজেদের সম্বন্ধে বলি। এর কারণটাও মজার। ডোপামিন! আমরা জানি, সেক্স করবার সময়, চকলেট খাবার সময় এই হরমোনটা নিঃসরণ হয় বলে আমাদের তখন অত ভালো লাগে। নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলবার সময়ও মস্তিষ্কের ভালোলাগার কেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক সেক্সের মত! তাই এত আনন্দ!

বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭

জীবন



এক
সজীব মিয়ার জীবনে আজ দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছে। সে বেশ উত্তেজিত। রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গল, এবং সে দেখল একটা মোটরসাইকেল তার পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা লোক কাতরাচ্ছে তার পাশেই। সজীব মিয়ার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল, এবং ক্ষুধাটা উবে গেল, যখন মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পরা লোকটার ব্যাগ খুলে দেখতে পেল ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। সে ব্যাগটা ধীরেসুস্থে চেইন আটকে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে যে জামা-প্যান্ট, একটা পুটুলিতে কিছু জিনিস, একটা ছেড়া তেল চিটিচিটে কাঁথা আর একটা পিভিসি ব্যানার- সেসব গুটিয়ে হেঁটে হেঁটে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিকে চলে গেল। একসিডেন্ট হয়েছে জহির রায়হান রোডে যেখানটায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার উঠে গেছে তার পাশে। সে তখন ঘুমিয়েছিল বার্ন ইউনিটের ধার ঘেষে ফুটপাতে। এখানে এমনি প্রতিদিন বেশ কিছু মানুষ ঘুমায়। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় সবাই উঠে মাথার ওপরের ঠাইয়ের খোঁজে চলে গেছে কোথাও। সজীব মিয়ার ঘুম পেয়েছে বৃষ্টি থামবার পরে। তাই এই জায়গাটা একদম খালি পেয়ে গেছে। 

সজীব মিয়ার বয়স হবে সাতাশ কিংবা আটাশ। এককালে তার চামড়া তামাটে রঙয়ের হয়তবা ছিল, কিন্তু এখন একদম নেই। রোদে পুড়ে চেহারা হয়েছে কুচকুচে কালো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে, গোঁফ আছে। নানারকম নেশার ভারে তার শরীর দাঁড়িয়েছে কাঠির মতন, লম্বাটে মুখ, চিবুকের হাড় স্পষ্ট।  হাড় জিরজিরে শরীরে জটাধরা উষ্কোখুষ্কো চুলের সাথে কপালের শিরাগুলোকে মনে হয় বলিরেখার মত। শরীর তার সামনের দিকে একটু বেঁকে গেছে। এখানকার আরো অনেক নেশাখোরের মত তারও জীবনে নির্দিষ্ট কোন ভাবনা কিংবা উদ্দ্যেশ্য নেই। কিন্তু হঠাৎ করে এতগুলো টাকা তার হাতে চলে আসায় সে কিছুটা বিচলিত। তার যে প্রয়োজন ছিল না টাকার, তা নয়। কিন্তু প্রতিদিন এটা সেটা কুড়িয়ে, এদিক সেদিকে ছুটকো চুরি করে যা হত, তা দিয়ে আধপেট ভাত আর নেশা হলেই হল।

রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

মা

এই পৃথিবীতে সবার একটা করে মা আছে। ঐ দেবদারু গাছ, উঁইপোকা, কিংবা আমার- সবারই আছে। এই সম্পর্কটাকে স্রষ্টার দান কিংবা বিবর্তনের ফল, যেভাবে যে বলুক, সেটা একটা ভালোবাসার সম্পর্ক।

আজ নিউট্রিশন ক্লাসে লেকচার ছিল প্রেগন্যান্সি নিয়ে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার জেনে বেশ খানিকক্ষণ থমকে ছিলাম। স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে ক্যালসিয়াম থাকে, সেটা এখন সবে জানে। মায়ের দুধেও ক্যালসিয়াম থাকে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ মায়েরা তো সেই পরিমাণে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার পান না, তবে ক্যালসিয়াম আসে কোত্থেকে? উত্তরটা চমকে যাবার মত। হাড্ডির একটা মূল উপাদান ক্যালসিয়াম, জানি সবে। মায়ের হাড্ডির কোষগুলো ভেঙ্গে ক্যালসিয়াম যায় দুগ্ধগ্রন্থিতে, সেই থেকে বাচ্চার ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন মেটে। একজন মা যখন ক্যালসিয়াম পাচ্ছেন না ডায়েটে, তখন তাঁর হাড্ডি ভেঙ্গে (আক্ষরিক অর্থেই) আমরা বেঁচে থাকি? 

আমার মায়ের জন্য ভালোবাসা। সকল মায়ের প্রতি ভালোবাসা। 
এবং শ্রদ্ধা (আজকাল এর বড় অভাব)।

শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭

আ জার্নি টু বোলপুর



এক.
আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রিন্ট করা একটা পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ছাদে। ওপাশে প্রীতি খেলছে আর দুটো ছোকরার সাথে। আমার সেদিকে মন নেই। আমি অপেক্ষা করছি মিমির জন্য। বলেছি সোজা ওপরে চলে আসতে, ক্লাস শেষেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের সহকারী অধ্যাপক সে। আমি এই মূহুর্তে অকর্মার মত ঘরে বসে আছি। ফুলার রোডে শিক্ষক ভবনে থাকছি আমরা প্রীতির জন্মের পর থেকেই। মিমি ছাদে ঢুকল, ধীর-স্থির ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, দারুণ খবরটা কি শুনি
আমি ভাবলাম, খানিকটা রহস্য না করে পারা যায় না। হাসলাম। ছেলেবেলা থেকে মিমির যে একটাই অভ্যাস, গুনগুন করে বলা, 'অসভ্য!' সেটা বলে ও আমার হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিল। একটুক্ষণ চোখ বুলিয়ে হাসল, 'আবেদন করবে?'
কাগজটা ছিল একটা চাকরির বিজ্ঞাপন। বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে। ওদের এগ্রো কেমিস্ট্রি বিভাগে দুজন অধ্যাপক নিচ্ছে, মূলত গবেষণার কাজে। 'বেশ তো, করো আবেদন!' এটুকু বলেই ও চেঁচাল, রাণী... রাণী... প্রীতি দৌড়ে এল। মায়ের কোলে ঝপিয়ে পড়ল। আমাদের একমাত্র মেয়ে এই প্রীতিলতা। বয়স চার এর একটু বেশি। বড় দুরন্ত হয়েছে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর নামে রাখা ওর নাম। এই নাম নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি বাড়িতে।

বুধবার, ১০ মে, ২০১৭

শুয়োর কা বাচ্চা


এক.
সালেহ মিয়ার দোকানটা ছোট। চায়ের দোকান সেটা। চা-রুটি-কলা বেচে কুলায় না। তাই সুঁই, কলম, চুলের খোপা জাতীয় অনেক কিছুই উঠিয়েছেন তিনি। তবু সেটা মুদি দোকান হয়ে উঠতে পারেনি। বসতভিটের সামনে টিনের ছোট ঘর তুলে বানিয়েছেন দোকানটা। তবে চারটে বাড়ি পরেই মণ্ডল ব্যাপারীর মুদি দোকান। সব রসদ সেখানেই আছে। অল্প পুঁজিতে সালেহ মিয়ার যা ওঠানোর সাধ্য, তাতে মানুষ টানবে না। অগত্যা এটুকু দিয়েই চলতে হয়। তবে পাশেই প্রাইমারি স্কুল, ওপাশে ব্রাক স্কুল। ছেলেমেয়েরা এক টাকা-দুই টাকা নিয়ে দৌড়ে আসে প্রায়ই। ক্লাসের মাঝে, টিফিন পিরিয়ডে, এমনকি ক্লাস শুরুর আগেও ভীড় লেগে থাকে ছেলেপেলের। তবে তাতে আর কত আয়? বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই দিনে পায় দুই টাকা, খুব অল্প কজনই পাঁচ টাকা। অনেকে কখনোই বাড়ি থেকে টিফিন খরচ বলে কিছু পায় না। বাড়িটাও ছোট। যা কিছু চাষ হয়, ছোট পুকুরে যা মাছ হয়, তা খেয়ে পরে বেচার উপায় নেই। 

সালেহ মিয়ার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোদে পোড়া মুখ, ভ্রু ঘন, কপালে এর মধ্যেই ভাজ পড়েছে। লম্বাটে মুখে সবসময় যেন রাজ্যের ক্লান্তি লেগে আছে। তিন মেয়ে তার। বড়টা ক্লাস এইটে পড়ে, মাঝেরটা ব্রাক স্কুলে এবার যাওয়া শুরু করল, আর ছোটটার বয়স দুই বছর। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু নেই বহু বছর হল। টানাটানি নেই, এমন কখনো যায় না। এক টুকরো জমিও নেই যে ফসল উঠলে মুখে হাসি ফুটবে। একটা গাভীর জন্য বড় সাধ। মেয়েগুলো বছরে একটা দিনও দুধ খেতে পায় না। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ দেবার কথা বলে যে আপারা বাড়ীতে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে যায় প্রায়ই, তাদের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারেন না তিনি। সুদের বোঝা বড় ভারী। ও পাড়ার এক বউ নিয়েছিল ঋণ। গরুই কিনেছিল। সাপে কামড়াল গরুটাকে, সেই সুদ সামলাতে এক টুকরো জমিই বেচতে হয়েছিল ওদের। 

বড় মেয়েটার নাম কমলা। তরতর করে বেড়ে উঠছে সে। এরমধ্যেই গ্রামের ছেলেরা আড়চোখে তাকায়। বাপের মত লম্বাটে মুখই পেয়েছে মেয়েটা। চিবুক যেন অনেকটা সুঁচালো। চোখগুলো বড় বড়, দেখলে মায়া পড়ে যায়। বিয়ের কত প্রস্তাব আসে। কিন্তু সালেহ মিয়া ফিরিয়ে