বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

দীর্ঘশ্বাস


কী রাঁধছ?’  
আমার স্ত্রীর ছোট্ট মেসেজ ফোনে ভেসে উঠল। আমার খানিকটা দুশ্চিন্তা হল। উত্তর দিতে হবে, এবং কিছু একটা মিথ্যে বলতে হবে। কারন আমি এখনো বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছি। দুপুর যদিও দুইটা বাজে, মুখও ধোয়া হয়নি। ফিজিক্সের শিক্ষিকা বিয়ে করার নানারকম ঝামেলা। ভ্রু কুঁচকে বকাবকি করতে তাঁদের একদম মায়া হয় না। আমি অকম্মা, ঘরে বসে দু চারটা কলাম লিখি পত্রিকায়, আর লবণাক্ত-আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় পানির সমস্যা সমাধান নিয়ে নানারকম কাজ করি। এই কিছুদিন ইউনিসেফ এর সাথে কাজ করলাম,
কখনো কারিতাস এর সাথে, আবার কখনো বিভিন্ন এলাকার তরুণ সংঘ-সবুজ সংঘ জাতীয় সংগঠনের সাথে। গত দুইমাস ধরে একদম টানা ঘরে বসে আছি। একটু বিশ্রামে বলা যায়। নিজেকে লাগে ভাটি অঞ্চলের জমিদারদের মত। বর্ষাকালে ঢাকায় বসে বসে হাই তুলি। কারন এ সময়টায় যে কোন প্ল্যান্টে কাজ করা কষ্ট। আর স্বেচ্ছাসেবী বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো কাদা-পানির ঝামেলায় কাজ নামাতে চায় না। কারন আছে। এসব অতি খরুচে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় কর্তারা গ্রামে কাঁদাপানির মধ্যে যেতেই চান না।

আমি মনে মনে হিসেব কষলাম। ভার্সিটির ক্লাস শেষ হয় পাঁচটায়, ওর রিকশা করে বাসায় আসতে বাজবে সাড়ে পাঁচটা। এর মধ্যে রান্না প্রস্তুত থাকলেই হল। ভেবে দেখলাম, সবচেয়ে সোজা উপায় হল মুরগির মাংস রান্না করে ফেলা। ফ্রীজে সবরকম মষলা পেষা আছে। শুধু চড়িয়ে দিলেই হল। উত্তর লিখলাম, উপোস থাকতে হবে আজ তোমাকে। হাত পুড়িয়ে ফেলেছি
সাথে সাথে কল এল, আমি ধরলাম, আর হড়বড় করে একগাদা কথা শুনলাম। মোটামুটি বুঝলাম, ও এখুনি চলে আসছে। আমি এই বয়সেও এ জাতীয় দুষ্টামি করি অহরহ, কারন ও ক্লাসে থাকতে কখনোই ফোন ধরবেনা। কথা বলতে ইচ্ছে হলে খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিতে দোষের কী? বললাম, কিচ্ছু হয়নি। মুরগি রান্না করছি।

অসভ্য’।বলে ফোন রেখে দিল। আমি প্রস্তুতি নিলাম রান্নাবান্নার। কাজটা আমার তেমন কষ্ট হয়না। খুব অল্প সময়ে অল্প পরিশ্রমে যে কোন রান্না শেষ করে ফেলার কৌশলটা শিখে ফেলেছি আমি কৈশোরে। একটা ছেলে যখনই রাঁধতে যায়, তখন তার মাথায় প্রথম কাজ করে, কত দ্রুত শেষ করা যায়। তাই বছর দশেকে গুণটা ভালোই আয়ত্তে এসেছে। আজ আমাদের সন্ধ্যায় যাওয়ার কথা গাজিপুর এর ওদিকটায়। কাশিমপুরে। বাবা একটা অর্ধপূর্ণ বাড়ি রেখে গেছেন। তার সামনের একটা ধানক্ষেতও টিকে গেছে। সেখানে প্রচুর পরিমাণে তারা দেখা যায়। হারকিউলিস মন্ডলীতে এ সময়ে প্রচুর উল্কাপাত হয়, আকাশ পরিষ্কার থাকলে টেলিস্কোপে ভালোই দেখা যাবে। ভার্সিটিতে উঠে প্রতিদিন দুটো টিউশনি করিয়ে, টাকা ধার করে এই এগারো ইঞ্চি টেলিস্কোপ কিনেছিলাম। সে সময়ে এত বড় টেলিস্কোপের কী দরকার ছিল আমার মনে নেই। কারন কখনোই আমি খালি চোখে দেখা যাওয়া তারাগুলো ছাড়া অন্য কিছুর দিকে মনযোগ দিয়ে তাকাইনি। গ্রহ দেখতে আমার তেমন ইচ্ছে হত না। খালি চোখে দেখা দেড়-দুইশ তারার নাম জানার পরে হয়ত ভয় ছিল, এবার টেলিস্কোপে তাকালে নতুনগুলোকে মনে রাখতে পারবনা।

একসময় ভার্সিটির শিক্ষকরা হত খুব গরীব। এখন তেমন না। চলার মত অল্প কিছু টাকা অন্তত পাওয়া যায়। দুজনের সংসার চলে ওর আয় দিয়েই। আমি প্ল্যান্টের প্ল্যান করে যেসব টাকা পাই, সেটা গ্রামে ফ্রী কাজ করতে আর বই কিনে উড়ে যায়। তবু মাঝে মাঝে আমার হাতে টান পরে। তখন মিস ফিজিক্স এর কাছে ধরণা দিতে হয় টাকার জন্য। কিছুক্ষণ বকাবকি করে টাকা দিতে ওর কার্পণ্য নেই। আমাদের খরচ তো শুধু থাকা খাওয়া আর বেড়ানো।
বিকেলে এসে খেতে বসল ও। আমি মিথ্যে বললাম, দুপুরে খেয়েছি। তবু একসাথে খেতে বসলাম। হয়তবা ও বিশ্বাস করেনি খেয়েছি, কারন এক দুপুরে দুইবার খাওয়ার মানুষ আমি না। কিন্তু বিশ্বাস করার ভাব করল। ঝাল নিয়ে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না। এসব ছোট বিষয় নিয়ে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘরের সব কাজ আমি পারি, করি। তবে বিবর্তনের ধারায় মানুষে এসব কাজে মেয়েরাই পটু হয়েছে। তাই আমার সব কাজে খুঁত থাকবেই। বিছানা খুব সুন্দর করে বিছালাম, কিন্তু আবিষ্কার হবে চাদরটা উল্টো। ঘর ঝাট দেয়ার পর দেখা যাবে ময়লাটা এক কোণে রয়ে গেছে। সেটা আর ফেলা হয়নি। কিংবা কাপড় ইস্ত্রি করলে দেখা যাবে কাপড়ের একপাশটা কুঁচকে আছে।
খেয়ে আমরা রেডি হতে শুরু করলাম। সবসময় রেডি হতে লম্বা সময় আমারই লাগে। বিপত্তি বাঁধল ব্যাগ নিয়ে। আমরা ওখানে থাকব একদিন। কিন্তু ব্যাগে ছয়টা বই নিয়েছি। মিমির আপত্তি তাতে। ওর দাবী, আমি কখনো একটার বেশি বই বাইরে গিয়ে পড়ি না। ও নিজে অংকের একটা ইয়া মোটা বই নিয়েছে, সেটা গম্ভীর হয়ে পড়ার চেষ্টা করবে। আমাকেও একটা বই নিতে হবে, নইলে আমার সাথে যাবেনা। ওখানে আমার ভাতিজার একগাদা বই আছে। তাতে কী? নিজের বই ছাড়া যেতে কার ভালো লাগে?

আমার বড় ভাইয়ের ছেলে রাশেদ। এবার গেল এমআইটিতে পড়তে। আর ছোট মেয়েটার বয়স নয় বছর। ওর জন্য আইজ্যাক আজিমভের সমগ্রের বাংলা অনুবাদ কিনেছি কাল। ছেলেবেলায় আমার দশ খন্ডই ছিল। সেগুলো বন্ধুদেরকে নানা সময়ে দিয়ে দেয়ায় এখন একটা দুটো আছে। নয় বছরের মেয়ে আজিমভ কেন পছন্দ করবে, তার উত্তর কেউ জানেনা। আমাদের পরিবারে বহু আগে থেকে বই নিয়ে উত্তর না জানা এসব ঘটনা ঘটে আসছে।
পৌছালাম সন্ধ্যার অনেক পরে। মেট্রোরেলে করে উত্তরা, তারপরে বাসে করে বাকিটা। গিয়েই দেখা গেল নাফিসার সাথে খেলতে বসে গেল মিমি। এখন ওকে দেখলে মনেই হচ্ছেনা এত্ত বড় একটা মেয়ে, যার আস্ত একটা সংসার আছে। চেচামেচি, হুল্লোড়ে বাড়ি মেতে উঠল। আমি কী করব? ভাইয়ার সাথে বসে দেশ-দশের গল্প জুড়লাম। ভাবী যথারীতি রান্না ঘরে। আমার রান্না খেয়ে মিমি খুব দ্রুত শুকাচ্ছে। কলেজে থাকতে ওর শখ ছিল আরেকটু শুকিয়ে নিবে, যাতে শাড়ি পরতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। সেই শখ সে কালে পূরণ হয়েছিল, তবে এখন আমার রান্নার হাতে পরে ব্যাপারটা ষোলকলা পূর্ণ হচ্ছে। ভাবীর রান্নার হাত বেশ। পারলে আমি একটা স্বর্ণপদক দিতাম তাঁকে। কিন্তু সমস্যা হল সেই পদক দিতে চাইলে মিমির কাছে হাত পাততে হবে টাকার জন্য।
খেয়েদেয়ে আমরা টেলিস্কোপ সেট করতে বসলাম। এতদিনে আমি কাজটা ভালো করে আয়ত্তে আনতে পারিনি। কিন্তু পিচ্চি নাফিসা সেটা খুব ভালো পারে। বড় লেন্স ছাড়া সবই ওকে ধরতে দেয়া হয়। আমি কেনার পর থেকে ক্যাটালগ দেখে বহুবার চেষ্টা করে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমরা আকাশে তাকাইনি প্রায় দুইমাস ধরে। ঢাকা এসে বসে আছি, তারপর থেকে ঘুম ছাড়া আর কিছু হয়নি। দুজনেই শুধু পরে পরে ঘুমাই। আর আমি বই পড়ি, ও ক্লাস নেয় ভার্সিটিতে। অনেকক্ষণ বসে প্রস্তুতি হল, মাঠে গিয়ে বসানো হল টেলিস্কোপ। হৈ হৈ করে আমি, মিমি, আর নাফিসা গেলাম। আকাশ পরিষ্কার। হারকিউলিস মন্ডলীতে ফোকাস করলাম। আমি করিনি, এ কাজটাও আমাকে দিয়ে হয়না। মিমি করে দিল। আমি তাকালাম। মনযোগ দিয়ে খুঁজতে লাগলাম উল্কাপাত। মিমি নাফিসাকে গল্প শোনাতে লাগল কোমা বারেনেসিস এর। এক রাণী, যার চুল হারিয়ে যায় মন্দির থেকে। পুরোহিতরা আকাশের এক মন্ডলীর নাম দেন কোমা বারেনেসিস।

হঠাৎ মেঘ করে এল। আমাদের কেন যেন মন খারাপ হল না। টেলিস্কোপ ওরকম রেখে নাফিসা গান ধরল। মিমি ওর সাথে গাইতে লাগল। আমি একবার একটু গেয়েই থেমে গেলাম। আমাকে মানাবে না ওসব গান। আমি বললাম, চলো ঘরে যাই। মিমি মনে হয় বিরক্তই হল। বলল, কী করবা গিয়ে? রোমের ইতিহাস পড়বা মনে হচ্ছে?

ঘরে এলাম। ছুটির আগের রাতে ঘুম একটু দেরীতে আসে, ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। দুজনে গল্প করতে লাগলাম। কাল থেকে যাব, আরেকবার উল্কাপাত দেখার চেষ্টা। আমি গল্প-টল্প তেমন জানিনা। ছোটবেলা থেকে আমার গল্প গিয়ে ঠেকবে লেখালেখি, তারা, আর পানি সমস্যা। ভুলোমনা আমি বড় বড় পরিসংখ্যান তখন থেকে বলে যেতে পারি নিমিষে! পানির গল্প এল। গতবছর উগান্ডা আর সোমালিয়ায় ছিলাম অনেকদিন। কীভাবে প্ল্যান্টগুলো করলাম, সেসব কথা বলতে থাকলাম। গল্প আসল অন্য একটা। আমার সারাজীবনের বড় একটা স্বপ্নের একটা অংশ পূরণ হতে যাচ্ছে মনে হয়। ইউনিসেফের দেড়শ কোটি টাকার একটা বাজেট হচ্ছে প্রায় নিশ্চিত। ১৬ টা জেলার সব গ্রামে মিডিয়া ফিল্টার বসবে। ষোল জেলার অধিকাংশ মানুষ একদম বিশুদ্ধ পানি পাবে। পাইপলাইনও বসবে পুরো গ্রাম আর মফস্বল জুড়ে। এইটুকু শেষ হলে আমি মরে গেলেও দুঃখ পাব না।

সকালে নদী দেখতে গেলাম দুজনে। আকাশ গাঢ় নীল বলেই আগ্রহটা জন্মাল। বসে রইলাম নদীর ধারে। ইন্ডাস্ট্রির বর্জ্য নদী দুটোকে মেরেই ফেলছে। নদীর ধারে চুপচাপ বসে থাকলাম। মিমিকে আবিষ্কার করলাম অনেক বেশি অন্যমনস্ক। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল! “মিলে গেছে!” আমি চমকে তাকালাম। আনন্দে ঝলমল করছে ওর হাসিমুখ। তারপর হড়বড় করে ফিজিক্সের কিছু জটিল কথা শোনাল। যার এক বিন্দু বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু বাংলাটুকু বুঝলাম। ওর পিএইচডির গবেষণায় ছোট্ট একটা সমীকরণ নিয়ে আটকে ছিল। সেটার সমাধান হয়ে গেছে! আমার তখন ইচ্ছে হল আমিও চেঁচিয়ে উঠি। তা হয়না। ও ব্যাগ থেকে পেন্সিল-নোটবই বের করে কিসব লিখতে লাগল।

আমার তখন মনে পড়ল, এবার কিছুদিনের জন্য আমেরিকা চলে যাবে ও। টুপ করে মন খারাপ হয়ে গেল। আমি নিজে অধিকাংশ সময় বাইরে থাকি, কিন্তু যখন খুব ইচ্ছে হয়, চলে আসি ঢাকা। কিন্তু আমেরিকা চলে গেলে তো টুপ করে চলে আসা হবেনা ওর।

মিমি লিখতে লাগল, আমি ঘাস খুটতে লাগলাম। তখন মোবাইলে ই-মেইল এর টোন পেলাম। মেইলটা খুলে আমার অস্ফুট একটা শব্দ বেরুল মুখ থেকে। তবে মিমি চমকেই তাকাল। ইউনিসেফ থেকে মেইল এসেছে, বাজেটটা বাংলাদেশ পাচ্ছে না। আমাদের সরকারের অনিচ্ছা। আফ্রিকার সাতটা দেশে ভাগ হবে টাকাটা! দেড়শ কোটি টাকা। আমার সারা জীবনের স্বপ্নের একটা বড় অংশ।
দুটো মানুষ, এত বছর ধরে একসাথে আছি। একজনের স্বপ্নপূরণের মূহুর্তে অন্যজনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। ঢাকা থেকে জানানো হয়েছে, সরকার ওসব জেলায় কাজ শুরু করবে আগামি বাজেটে। তাই এই টাকাগুলো ইউনিসেফ অন্যখানে খরচ করতে পারে। সামলানোর আগেই মেইল পেলাম আরেকটা। রিজিয়া রহমানের মেইল। প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন সচিব। শুধু এটুকু লেখা, ‘Got anything from Unicef?’

সেদিন আমাকে সে বলেছিল আমি কেন এসব বিদেশি কোম্পানির পেছনে ঘুরছি? আমাদের সরকারই তো দেশের জন্য সব করছে! আসল ব্যাপারটা হল নব্বই এর দশক থেকে সব সরকার পানি নিয়ে কাজ করছে। এবং তাতে কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। আসলে তো লুটেপুটেই খাচ্ছে। বিদেশি কেউ, বিশেষ করে জাতিসংঘ সমাধানটা করে ফেললে তাদের মান যাবে, মানুষের বিশ্বাস জন্মাবে বিদেশিদের প্রতি। মিমি তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। এখনো বুঝতে চাইছে হয়েছেটা কী। মুখ থেকে ওর হাসিটাও মুছে যায়নি পুরোপুরি।
 
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর রিজিয়া রহমানকে লিখলাম, ‘You played well.’
তাকালাম মিমির দিকে। বললাম, রাজনীতিতে যাচ্ছি আমি। পৃথিবীটা তো কঠিনই। সহজ করে নিব। আর তুমি তো আমেরিকায় সহজ জীবন পাবেই।


1 টি মন্তব্য:

  1. গভীর রাতে পড়তে বসে মনে হল বেশ লিখেছ! তবে শেষের দিকটা হয়তো আরেকটু চমৎকার করা যেত :')

    উত্তরমুছুন