সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০১৬

একটি সুখি বাঘের আত্মকাহিনী

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ টাইগার মোবাইলস





শুরুর আগে
আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন একটা গল্প লিখেছিলাম, বেশ মন খারাপের গল্প। তখন শিকারীদের হানাদার মনোভাবে বাঘেরা ছিল বড় দুঃখী। সেই গল্পটা পড়ে এই গল্পটা শুরু করতে হবে। গল্পটা পাওয়া যাবে নিচের লিংকে- 

গল্পটা
সেই বাঘেরই মাসি। তাদের এখন সুখের সীমা নেই। তবু তো কিছু দুঃখ থাকে। তাতে কী? দুঃখ তো মানুষেরও আছে। মাসির মেয়েটা হয়েছে বড় চটপটে। কাজে মন নেই, ঘরকন্নায় মন নেই, বিয়েটাও দিতে পারছেন না। মাসি কাল বললেন, বিদ্যুৎ বিলটা দিয়ে আসতে, তাতেও তার আপত্তি। শুধু পারে মুখে লাল রঙয়ের মেকআপ মেখে মস্ত বীর সেজে ঘুরে বেড়াতে, যেন এইমাত্র এক হরিণ শিকার করে এল। আর এসেছে গরমকাল। একটু পরপর লোডশেডিং। অতিষ্ঠ হয়ে পড়তে হবে যে! মাসির কর্তা ঠ্যাঙয়ে রশি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দুটো বানর নিয়ে এসেছেন বাজার থেকে। লাবণি পয়েন্টে বড় বাজার বসে হরিণের-বানরের। আজ যে হাটবার। 

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখনো বিদ্যুৎ আসার নাম নেই। রাত হলেই মশাগুলো বড় জ্বালাতন করে। ধুপ না জ্বাললে গুহায় টেকার উপায় নেই। এই মানুষগুলো হল পাজির পা-ঝাড়া। তাদের বসতিতে লোডশেডিং তো দূরের কথা, দিনের বেলায়ও বাতি জ্বলে। অথচ বনবাসীদের কোন অধিকার যেন নেই। ওদের জমি দখল করে মস্তবড় ইঞ্জিন বসিয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের, অথচ
বিদ্যুৎ দেবার সময় নাম নেই। বললেই, বলে উৎপাদন কম। কিছু তো করার নেই, যন্ত্র ওদের, কয়লা ওদের, জমিটাই শুধু বাঘ-মাছের। অবশ্য একটা সুবিধা আজকাল বেশ হচ্ছে। মাঝে মাঝেই বিশাল কয়লাভর্তি জাহাজ ডুবে। সেই কয়লা জলে পরে থাকে, বিদ্যুৎওয়ালাদের নেয়ার নামই থাকে না। তাদের নাকি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন টন কয়লা মজুদ আছে। এই পাঁচ-দশ হাজার টন কয়লা গেলে কার কী? বনের সবাই সেই কয়লা পুড়িয়ে আলো জ্বালে। 

বক-মাছরাঙা আজকাল খুব বেড়ে গেছে। বেয়াড়া হয়ে উঠছে বেয়াদবগুলো। পেটে অন্ন পেলে সবার শরীরেই জুৎ আসে। কয়লা ডুবে, রাসায়নিক পড়ে, নদীতে আর মাছ বাঁচবার উপায় কী? নদীর পাড়ে পাড়ে শত শত মাছ মরে পড়ে থাকে ভাটির সময়ে। বিনা পরিশ্রমে মাছ পেয়ে বকগুলোর শরীরে তেল জমছে। এতই তেল জমেছে, যে জ্ঞানী শেয়াল বলেছে কদিন পরে বকেরা উড়তেই যাবে ভুলে। ভোদরেরও সেই একই অবস্থা, ঘুমুচ্ছে ঘুমুচ্ছে, ঘুমুচ্ছে... এককালে বড় একটা প্রাণী ছিল, মাসি ছোটবেলায় দেখেছে। ডাঙায়ও থাকত, পানিতেও থাকত। তার নাম কুমির, লেজ ছিল খাঁজকাটা। কত বাঘের সাথে লড়াই হয়েছে কুমিরের! বড় সাহসী ছিল প্রাণীগুলো। কিন্তু মানুষেরা যে আরো সাহসী! মেরে কেটে দেশ থেকে কুমিরকে একদম নিশ্চিহ্ন করে তবে ছেড়েছে। এখন আর বাঘদের লড়তে হয়না কুমিরের সাথে। মানুষই বাঘের আসল বন্ধু। বিদ্যুৎ দিয়েছে, কুমির মেরেছে, আরো কত সাহায্য!

আগে নানারকম পাখি ছিল এই বনে। তারা সব শহরবাসী হয়েছে। এই শব্দ, এই আলো নাকি কারো ভালোই লাগে না। তাই পাখিরা বন ছাড়তে শুরু করল। সে অনেক আগের কথা। যখন বিদ্যুৎকেন্দ্র বসল বনের ধারে, বাঘেরা আধুনিক হল, তখন। তারপর সেই বন ছাড়া পাখিরা দেখল সবখানেই একরকম আলো, একরকম শব্দ। বনের গাছ তো সব যাচ্ছে মরে, তারচেয়ে শহুরে ছাদের কোনে-ভেন্টিলেটরে থাকতে সুখ। শহরের ডাস্টবিনে আছে হরেক খাবার। বনে তো এখন আর সেরকম ফুল-ফল হয়না। পোকামাকরও নেই। কে থাকে এই বনে? ঈগল ছিল, শকুন ছিল এককালে। এখন এসব কিছু নেই। পাখির রাজা হয়েছে চড়ুই। ওদের থাকার জায়গায় গিয়ে যে বাসা বেঁধেছে সবাই! আর কাকগুলো সব নাদুস-নুদুস হয়েছে। খাবারের মূল মালিক তো এই কাক। সেই আদিকাল থেকেই।

মাসির এক খুড়তুতো বোন এখন বনের রাণী। তবে আর অল্প কটা দিন, মাসিই হয়ত সামনের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছেন। বনে যাবেন বনের রাজা। তখন মানুষের সাথে চুক্তিটা আরো ঝালাই করে নিবেন। বিদ্যুৎ ছাড়া দুনিয়া অচল। জোগান বাড়াতে হবে বিদ্যুতের। আরো কিছু জমি নাহয় দিলেন। সেই জমিতে কেন্দ্র বড় হল, বিদ্যুতের অভাব মিটল। তবে বনের কিছু বেয়াড়া আছে। সাপ, শেয়াল আর পেঁচা। এদের তো আলো সহ্য হয়না। তাই অন্যদের উন্নতি নিয়ে আপত্তি করে। জমি দেয়া নিয়ে হাঙ্গামা বাঁধাবে। কিন্তু মাসি মানুষের কাছ থেকে শিখেছেন, প্রজাদের কথার কোন দাম নেই। রাণীর ইচ্ছা, সবার সিদ্ধান্ত। বিদ্যুৎকেন্দ্র বড় হবে, ছানাপোনা সুখে থাকবে। 
[চলবে...]