রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬

হেই টিচার, লীভ আস কিডস এলোন!


"হেই টিচার! লীভ আস কিডস এলোন"
হাতুড়ি মেরে জীবনটা পঙ্গু করে দিতে কে বলেছে আপনাদেরকে? আপনাদের জীবিকা। তাই বলে এত নির্লজ্জভাবে? পিংক ফ্লয়েড ব্যান্ডের গানগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছি। প্রিয় শিক্ষকেরা, আপনারা বাবার মত, তবে সৎ বাবা।
ভেবেছিলাম রেজাল্ট নিয়ে লিখবনা কিছুই। কিন্তু তা হল না। প্রচন্ড রাগ লাগছে। আমি এই মাত্রার লুজার নই যে এই অসহ্য রেজাল্ট আমার নামের পাশে দেখতে হবে। পরীক্ষা দিয়েছি জান বের করে। সত্যি কথা হল, এই টর্চার সহ্য করতেই খেটেখুটে পড়েছি অনেক। শেখার ইচ্ছে থেকে খুব অল্প কয়টা কিছু পড়েছি। হলটা কী? একটু থমকাতে পারি, একটা বিষয়ে একটুখানি ঝামেলা হতে পারে। তবে চারটা বিষয়ে ছিটকে পড়ার মত লুজার কোনকালে আমি ছিলাম বলে মনে পড়েনা।

আমাদেরকে মেশিনে ঢুকিয়ে পিষে নুডলস বানাতে আপনাদের কেমন আনন্দ হয়, তা দেখতে ইচ্ছে করে। আপনার ছেলেমেয়েদেরকে যখন আপনার মতই শিক্ষা-পেশাজীবিরা পিষে দেয়, খুব ভালো লাগে? আমার বাবা একজন শিক্ষক। তিনি তার হাজারো শিক্ষার্থীকে এমনভাবে টর্চার করেননি কোনকালে। তাই তাঁর কাছে আপনাদের পিষুনি খুব একটা মধুর লাগার কথা না। তবে তিনি যেহেতু প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন জীবনে, নানা জায়গায় নানারকম শিক্ষকদের সাথে কাজ করেছেন, এমন দেশ থেকে শিক্ষক ট্রেইনিং নিয়েছেন, যে দেশে এই নির্লজ্জ খেলা নেই, তিনি জানেন শিক্ষকরা কেমন হয়। তবু সব শেষে এসব তাঁর কাছে অসহ্য।

এই আমি ক্লাস এইটে থাকতে সবচেয়ে ভালো বুঝতাম অংক আর বিজ্ঞানটা। বিজ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে একটা বাক্য বলেছিলাম, "শ্লা যা লিখেছি! আইনস্টাইন আসলেও পঁচানব্বুই এর নিচে নাম্বার দিতে পারবেনা"।
কিন্তু যে ব্যাটা খাতা দেখেছে, তার মাথায় কী ছিল কে জানে? সত্তুর এর ঘরে নাম্বার পেলাম। জিপিএ পাঁচ যদিও আসেনি, তবু উপজেলায় হলাম সেকেন্ড। এর আগে ফাইভের পরীক্ষায় উপজেলায় থার্ড ছিলাম। এক উন্নতি হল। কিন্তু একটা ভয় ঢুকল, এসএসসিতে ভয়টা কিছুটা কাজ করেছে। কিন্তু সেবার সোনার হরিণ ধরা দিল। তারপর কলেজের নির্লজ্জ শিক্ষকদের গল্পগুলো চেপে যাই। তাঁরা এই লেখা কখনো দেখতেও পারেন। তবে যদি আপনারা দেখেন, তবে জেনে রাখবেন, আপনারা নির্লজ্জ।

আমি এত খারাপ কিছু পেতে পারি জানতাম না। আমার ভাই, আমার কাছের বন্ধুরা পেতে পারে জানতাম না। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা জানিয়েছেন। আরো অনেক কিছু শিখিয়েছেন। অনেকে বলে, উচ্চমাধ্যমিকের অংক খুব কঠিন। যে লোকটা আমার খাতা দেখেছিলেন, তিনি যদি জানতেন, আমি অংকের বই দুটোর যতগুলো অংক পারতাম, তার প্রতিটা অংক নিজে বই পড়ে পড়ে শিখেছি, গাইড দেখে একা একা বুঝে নিয়েছি, তাহলে তাঁর হয়ত হাত কাঁপত আমার সঠিক অংকে নম্বরগুলো এভাবে কাটতে। দুই বছরে আমি আমার কলেজকে টাকা দিয়েছি, আমার সরকার কোটি কোটি টাকা দিয়েছে। এমন একটা কলেজে পড়েছি, যেখানের প্রতিটি পিরিয়ডের জন্য সরকার গড়ে লক্ষ টাকা নাকি খরচ করে। সেই কলেজের শ্রদ্ধেয় তিন অংক শিক্ষক আমাকে দুই বছরে একটা অংক শেখাননি। কিন্তু আমার তো ক্লাশে উপস্থিতি নব্বুই ভাগের ওপর ছিল। তবু কেন বাসায় বসে একলা একলা পড়তে হল? আহমাদের কাছে হয়ত দুই বছরে দশ-পনেরটা অংক শিখেছি, বাকি সবটা একলা শেখা। একদম একলা। অবদান যা আছে আমার, আর এস ইউ আহম্মদ নামের প্রিয় অংক বইয়ের লেখকের।

জীবনে কখনো প্রাইভেট পড়িনি, কোচিং করিনি। উচ্চমাধ্যমিকের আগ পর্যন্ত ক্লাশে শিখেছি, তারপরে শিখেছি একলা। সেই সাধ্য সাধনার পরীক্ষা দিতে বসেছিলাম। কিন্তু মায়া হয়নি তাঁদের। লাল কালি দিয়ে একটা একটা করে সঠিক উত্তর কেটে দিয়ে পাশে শূণ্য বসাতে তাঁদের হাত কাপেনি। সেই টাকা দিয়ে বউয়ের জন্য ঈদের শাড়ি কিনতেও চোখে জল আসেনি। তবে তাঁদের নিষ্ঠুরতা বাবার বিছানায় বসে যখন আমি প্রথম দেখেছি, আমার চোখে জল এসেছে। আমার শিক্ষক বাবা অন্তত দশ বছর পর আমাকে কাঁদতে দেখেছেন। আমাকে প্রার্থনা শিখিয়েছেন, স্রষ্টার কাছে কেমন করে হারানোর চেয়েও বেশি কিছু পাওয়ার জন্য চাইতে হয়।

উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যাপারটা কী হল? জিপিএ ৪.৬৭। আচ্ছা, এটা দিয়ে সবটা বোঝা যায়না। ফিজিক্সের প্র্যাক্টিক্যাল এর কথা বলি। টিচারকে সেদিন প্রত্যেকের দিতে হয়েছিল একশ টাকা। আর যে কর্মচারি খাতা তুলেছেন, তাকে বিশ টাকা করে। তো সেই শিক্ষক এর কাছে আমি ভাইভা দিলাম। পারলাম। তিনি খুব মহৎ মানুষ। দুই পেপারের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেয়ার সময় নেই। আমাকে তিনি একটা পরীক্ষা নিয়ে সেটার জন্য প্রথম পত্রে দিলেন পঁচিশে পঁচিশ। নিশ্চয় আমার উত্তরে মুগ্ধ হয়েছেন। সবাইকে তো চব্বিশ দেন। কিন্তু নাহ! দ্বিতীয় পত্রে দিয়েছেন আঠারো! আমি কাউকে দেখিনি দুই পত্রে জোড়ায় জোড়ায় নম্বর ছাড়া পেয়েছে। অনেকে এক কম-বেশি পায়। আমি সাত! তার মধ্যে একটায় ফুল মার্ক। তিনি একটা পরীক্ষা নিয়ে এত সুন্দর কম্বিনেশন করলেন কেমন করে?

একশ টাকা, কিংবা এটুকু থাকুক। এক ছেলে ভাইভা দিতে গেল। ঐ শিক্ষকের ধর্ম দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম না। সেই ছেলেটাও তাঁর স্ব-ধর্মীয়। নাম জিজ্ঞেস করলেন, এবং বললেন আচ্ছা বাবা যাও। ছেলেটাকে পূর্ণ নম্বর দিতে তাঁর একটুও বাঁধল না। দেশের অন্যতম শ্রদ্ধ্যেয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করে একজনের ফিজিক্স পরীক্ষা নিতেও তাঁর বাঁধেনি। কিংবা একটি ছাত্ররাজনৈতিক দলের ব্যাপারে প্রশ্ন করে। এই করে আয় করা টাকা দিয়ে তিনি যখন তাঁর ছেলের অসুখে মুখ কালো করে মাথার কাছে বসে থেকে খরচ করেন, তখন তাঁর কি কষ্ট হয়? লজ্জা লাগে? কিংবা ইশ্বরের ভয় হয়? জানতে খুব ইচ্ছে করে।

সেই শিক্ষক তাঁর কাজ কমাতে খাতার ওপরের ফর্মটা পূরণ করতে দিয়েছিলেন আমাদেরকে। তিনি কীভাবে নম্বর দিয়েছেন আমরা দেখেছি। সর্বোচ্চ পঁচিশ। তবে বিশ-ত্রিশ শতাংশ খাতায় চল্লিশের মধ্যে পাওয়া মার্কগুলো বাইনারি। ফেল অর্ধেক খাতায়। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ উত্তর করে শুণ্য পেয়েছে অনেকেই। তাঁর হাত কাপেনি নম্বর কাটতে? 

বাংলাদেশে একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের আয় কত? যদি কোন সমীকরণে তাঁর বেতন আর মোট আয় থাকত, তবে >> চিহ্ন ব্যবহার করে একটা শর্ত লিখে আমি সমীকরণ থেকে তাঁদের বেতন বাদ দিতে পারতাম। অথচ তারা নাকি মহান ব্রত নিয়ে পড়ান। সেই ব্রতটা কী, একদিন আমি জিজ্ঞেস করব।

শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ তাঁর শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে ধুমপান করছিলেন। তাঁর শিক্ষক আরেকজনকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন ছেলেটা কেমন বেয়াদব। শিক্ষকের সামনে সিগারেট খায়। আমাদের সময় শিক্ষকের সামনে দাঁড়াতে হাটু কাপত। হুমায়ূন আজাদ বললেন, আপনাদের শিক্ষকরা অনেক জ্ঞানী ছিলেন। তাঁদের সামনে দাঁড়ালে হাটু কাঁপারই কথা।

টিচারদের প্রতি এত ক্ষোভ, নিজের প্রতি নেই? আমি হৃষ্টচিত্তে উত্তর দিব, একবিন্দুও না। নির্লজ্জরা মরে যাক।
এক রেস্টুরেন্টে বসে পেস্ট্রি খেতে খেতে একদিন গুনগুন করে বললাম, আমি রাজনীতিবিদ হব। সামনে বসে থাকা মানুষটা বলল, আমি রাজনীতিবিদ বিয়ে করব না। অবাক হয়ে তাকালাম, এমন কথা কেন? তাঁর সোজা উত্তর, একটা মানুষ প্রতিদিন মাথায় বিপদ নিয়ে বের হবে, সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকব কেউ তাঁর ক্ষতি করছে কিনা, তা আমি পারবনা।
তার মাসখানেক পর, আমি যখন হতাশায় নুয়ে পড়েছি, তখন জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা, সারাদিন দুশ্চিন্তা করার পর সন্ধ্যাবেলা যদি দেখিস সেই মানুষটা এমন একটা জিনিস বদলে দিয়ে ঘরে ফিরছে, যা তোর আগের জেনারেশনকে ভুগিয়েছে, তুইও যেটা বদলে যাবে স্বপ্ন  দেখেছিস, তোর পরের জেনারেশনের জন্যও যেটা বদলানো দরকার ছিল, তখন তোর কেমন লাগবে?" তখন অসম্ভব মমতাময়ী মেয়েটা চুপ রইল।
আমি একদিন রাজনীতিবিদ হব। আজ যারা কাঁদছি, একদিন বদলে দিব এসব। শপথ করছি। 

আমাদেরকে নিয়ে প্রিয় শিক্ষকেরা কী করেন, সেটা নিয়ে তিনটা মিউজিক ভিডিও আছে পিংক ফ্লয়ড এর। পিষে পিষে আক্ষরিক অর্থে নুডলস বানানো। হেই টিচার! লিভ আস কিডস এলোন!

সবচেয়ে সুন্দর এই প্রথম ভিডিওটা।








শিক্ষকদের প্রতি রইল শুভকামনা। রইল ভালোবাসা। আর রইল ঘৃণা (যাদের জন্য প্রযোজ্য)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন