বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

শৈশবের তালপুকুরওয়ালা বাড়ি

আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন তেমন দুষ্টুমি শিখিনি। এর একটা কারন হয়ত বাবা শিক্ষক, এবং তাতে বাসার পরিবেশটা অন্যরকম ছিল। দুষ্টুমির জন্য বকা খাওয়ার ব্যাপারটা একদম মনে পড়েনা। শুধু দুপুর বেলা যখন মা ঘুমোতেন, তখন অভ্যাস ছিল আস্তে করে উঠে গিয়ে খেলতে বসা। বাড়ির বাইরে যেতাম না। বিশাল বাড়ির কোন এক কোনে কিছু একটা খেলা আবিষ্কার করে সেই খেলায় মত্ত হতাম। ধুলোবালি মাখা অন্যতম অভ্যাস ছিল। আমার মনে পড়ে আমার তেমন খেলনা ছিল না। নিজের কোন প্রিয় খেলনার কথা আপাতত মনে করতে পারছি না। ছয়-সাত বছর বয়সের খেলনা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি ইয়ো-ইয়ো। মাঝে মাঝেই ইয়ো ইয়ো কিনতাম। এছাড়া তেমন কিছু না। খুলনা শহরের আমাদের ঐ বাড়িতে একটা পুকুর আছে। গত দশ-পনের বছরে নানা ভাড়াটিয়ারা সেই পুকুরটার যে হাল করেছে, এখন গেলেই খুব মন খারাপ হয়। পুকুরপাড়ে ছিল তালগাছ, সেটায় আলো পড়ছেনা বলে তেমন বড় হচ্ছেনা। আরেকটা ছিল ছফেদা গাছ। সেই পুকুরে সারা বছর পানি থাকত। বর্ষাকালে খুব বৃষ্টি হলে পানি থৈ থৈ করত। কখনো পানি উঠে ঘরের দেড়গোড়া পর্যন্ত চলে আসত, আমরা জানালায় বসে দেখতাম সেটা মনে পড়ে।
আর ছিল অনেক সাপ। সাপ মারার প্রতি আগ্রহ ছিল না কারো। সাপ মারার কোন স্মৃতি আমার নেই। তবে বর্ষাকালে প্রচুর সাপ দেখেছি তা মনে আছে।
ক্লাস ওয়ানে যখন ‘কানা বগির ছা’ কবিতাটা পড়লাম, তখন শব্দার্থে একটা শব্দ পেলাম, ‘তালপুকুর’। এর অর্থ লেখা ছিল যে পুকুরের পাড়ে তালগাছ আছে। আমার ভীষণ উত্তেজনা হয়েছিল এটা ভেবে যে আমাদের পুকুরটা একটা তালপুকুর। সন্দেহও হয়েছিলো, এত ছোট তালগাছেও কি তালপুকুর হবে? সেই পুকুরের অন্যপাড়ে দেয়াল ঘেষে ছিল নারকেল গাছ, খেজুর গাছ, দুধফল গাছ। আর ছিল একটা সুন্দরী গাছ। গাছটার মালিকানা আমার বড় ভাইয়ের। সে লাগিয়েছিল বহু আগে, গ্রাম থেকে এনে। গাছটা অনেক বড় হয়েছে। তার ওপারে ছিল হালিমাদের বাড়ি। সেই বাড়িটায় হালিমার মা নামে পরিচিত এক মহিলা থাকতেন, তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে। বাড়িটা তাঁদের না। অনেক বিশাল বাড়ি। পুকুরটাও ছিল মস্ত বড়। সেই পুকুরে ছিল বাঁধানো ঘাট। পিচ্ছিল শ্যাওলা পড়া সে ঘাটে গোসল করতে আমাদের খুব ভালো লাগত। দেয়াল টপকে ঐ বাড়িতে ঢুকতাম সম্ভবত। কখনো বলে, কখনো না বলে নেয়ে আসতাম। কারন বিশাল বাড়ির এ মাথায় ছিল পুকুর, অন্য মাথায় ছিল থাকার ঘর। মাঝখানে অনেক জায়গা, গাছপালা, সব্জীক্ষেত। তবে ঔ পুকুরে গোসল করতে মা হয়ত খুব অল্পই অনুমতি দিতেন। টুপ করে দেয়াল টপকে চলে যাওয়ার উপায় ছিল, কিন্তু এসব দুষ্টুমি তখনো শিখিনি।
হালিমাদের সেই পুকুরের মাঝখানে থাকত এক বুড়ি। কেউ সাতার কেটে
  মাঝে গেলেই পা টেনে নিচে নিয়ে যেত। তাই একলা সে পুকুরে যেতে পারতাম না আমরা। প্রচন্ড ভয় ছিল বুড়িকে। সেই কাল্পনিক বুড়িকে আমার বন্ধুরা নাকি অনেক দেখেছে। কখনো মাথা উচু করত পানির নিচ থেকে। বড়রা এই একটা ভয় দেখিয়েই হয়ত আমাদেরকে একটা বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। একলা পা হড়কে পরে যাওয়া খুব সোজা ব্যাপার ছিল। তবে বড় পুকুর দেখলে এখনো মনের কোনে আমার বুড়ির আতঙ্ক কাজ করে।
আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা ঘেষে কয়েকটা বাড়ি ছিল। একপাশে ইমদাদুল ভাইদের বাড়ি আর সম্ভবত বনিদের বাড়ি। এ দুটো দক্ষিণ দিকে। এখানে টপকে যাওয়ার উপায় নেই। পূবদিকে হালিমাদের বাড়ি। আর ছিল নাজমুলদের বাড়ি। নাজমুলদের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির তারকাটার বেড়া প্রায় সময়ই থাকত নষ্ট। তেতুল চুড়ি করতে যেতাম। আমার বড় বোন, আমি, ভাইয়েরা অনেকেই সেই তেতুলের লোভে ওপাশে বহুবার গিয়েছি। বিশ-ত্রিশ বছর বয়সের সেই তেতুলগাছে প্রচুর তেতুল হত। তেতুলতলা ভরে থাকত পাকা তেতুলে। আর উত্তর পাশে ছিল দিনাদের বাড়ি। দিনা আপার বাবা ছিলেন খুব সম্ভবত উকিল। একটু সরল-সোজা ছিলেন। তাঁর কর্মকান্ডে আমরা খুব হাসতাম। তাঁদের বড় আম গাছ ছিল। উনি চেঁচাতেন, “আম লবিইইই?” বলে। আমরা হেসে কুটিকুটি হতাম। তবে আমাদেরকে আম দিতেন কিনা তা মনে নেই।
বড়ই গাছে বড়ই হত প্রচুর। পাঁকার আগে প্রচুর খেতামও, তবু শেষ হত না। আমাদের একতলা বাড়ির ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিল না। মই বেয়ে উঠতাম। কখনোবা উঠতাম বাড়ির কোনে বের হয়ে থাকা ইট বেয়ে। গতবছর গিয়ে দেখি মই নেই। এক পিচ্চি সুড়সুড় করে ইট বেয়ে উঠে গেল। তারপর আমাকে ডাকল, আসেন। আমি দেয়ালে হাত রেখেই প্রচন্ড ভয় পেলাম। অবাক লাগল, এই দেয়াল বেয়ে ছয়-সাত বছর বয়সে প্রতিদিন উঠেছি। সানশেডে বসে লাঠি দিয়ে বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেড়েছি।
বাড়িতে পুকুর থাকায়ও সাতারটা ঠিক আয়ত্তে আনতে পারিনি। ভেসে থাকতে পারি, কিন্তু দুই-তিনবার দম নেয়ার পর দম বন্ধ হয়ে আসে। তবে পুকুরের প্রতি ভয় ছিলনা। আমার চাচা সুদানে কোন একটা স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাইরে থাকার কোন এক সময়ে দুই-তিন বছর ঐ বাড়িতে আমরা আর চাচার পরিবার থেকেছি। বাড়িটার মালিকানা আসলে দুই ভাইয়ের। আমার এক চাচাত বোন ছিল সমবয়সী। ওরা আসার পর আমার আনন্দ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। দিনের অধিকাংশ সময় দুই ভাইবোন মারামারি করে কাটাতাম। আমাদের ভ্যাঙ্গানোর অদ্ভুত একটা উপায় ছিল। সেটা মনে পড়লে এখনো
  হাসি পায়। একে অপরের মায়ের নাম বলে ক্ষেপাতাম। আমার মায়ের নাম ও বললে আমি কেন রাগতাম আমি জানিনা। ওর মায়ের নাম বললে ও কেন ক্ষেপত, তাও জানতে ইচ্ছে করে। তবে সবচেয়ে আগ্রহের দুষ্টুমি মনে হয় এটাই ছিল।
ওকে পানিতে ফেলে দেয়া আমার অন্যতম শখ ছিল। আমি ছেলেবেলায়ও এরকম ভগ্নস্বাস্থ্যের ছিলাম, তবে ও মেয়ে বলেই হয়ত ওর গায়ে জোর কম ছিল। তাই ঝগড়া হলে ঠেলে পুকুরে ফেলে দিতে আমার বেগ পেতে হত না। আমাকে ও তেমন পুকুরে ফেলতে পারেনি যতদূর মনে পরে। আর পুকুর এর পাড় এমন কিছু গভীর ছিল না যাতে বিপদ হবে। তাই আমাদের বাড়িতে পুকুর নিয়ে এমন কিছু আতঙ্ক ছিল না। আমাদের সময়ে চাচাত-মামাত ভাইবোনের বন্ধুত্ব মানেই ছিল মারামারি, ভ্যাঙ্গানো এসব। এখন আমার পরের জেনারেশনে ভাগ্নে-ভাতিজাদের দেখি গলায় গলায় ভাব মিলিয়ে কার্টুনের গল্প করে, ঘুরে বেড়ায়। ঝগড়া বলে কিছু নেই।
বাড়ির সামনে একটা আমগাছ ছিল, যেটায় এখন আম হয়। তার তলায় প্রায় পনের ফুট করে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে একটা খালি জায়গা। সেখানে ঘাস হত না। আমি আর আমার পিঠাপিঠি ভাই ঘাস এনে এনে লাগানোর চেষ্টা করেছি অনেক। সবুজ মাঠ দেখতে ভালো লাগত। কিন্তু তখন বুঝতাম না কেন ঘাস হচ্ছেনা আমাদের আঙ্গিনায়। কারন ছিল জায়গাটা ছায়াঘেরা, এবং নিয়মিত হাঁটাচলা করা হয় তার ওপর দিয়ে। একবার অল্প কয়টা ঘাস হয়েছিল, তা দেখে আমার আনন্দের সীমা ছিল না।
বিশাল এক জামগাছ ছিল ঘরের সামনে। সেই গাছটা খাড়া এবং এতই লম্বা ছিল যে সেই গাছটায় কেউ উঠতে পারত না। সবসময় জাম পরে থেতলে যেত। কখনো থেতলানো জাম খেতাম, তবে খুব কম। বাড়িতে আরেকটা জামগাছ ছিল, ক্ষুদিজাম। সেই জাম থেতলে যেত না। সে জাম হত খুব ছোট। মটরদানার চেয়ে একটু বড়। সেটা খেতে তেমন কোন আগ্রহ ছিল না আমাদের। এলাকার কারো সাথে মিশতাম না। কারো সাথেই না। তার কারন হয়ত ছিল পরিবারটা অন্যরকম। সে সময়ে এমন ধারনা হয়েছিল যে যেসব ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে খেলে বেড়ায় তারা আজেবাজে ছেলে। এলাকায় ধনী-গরিবের তেমন তফাৎ ছিল বলে মনে পড়েনা। সবার খেলা প্রায় একরকম, ঘুরে বেড়ানোর দল বয়সভেদে একটা। তবে আরো কিছু ছেলেমেয়ে ছিল পাড়ায়, যারা বের হত না আমাদের মতই। একটা আপার কথা মনে পড়ে, যার বিয়ের কথা আবছাভাবে মনে পড়ে। তাঁর একটা ছেলে হয়েছিল, এবং তাঁর বিয়ে ভেঙ্গে যায়। সেই বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার লেখা-পড়াটুকু সম্ভবত হয়েছিল আমাদের বাসায়। গতবছর খুলনা গিয়ে ওদের বাড়ির ওখানে গিয়ে দেখি কেমন অপরিচিত লাগছে। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম তোমরা এ পাড়ায় নতুন? বলল, না বছর বিশেক ধরে আছি। আমি থমকে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম পরিবারের কথা। ও বলল ওর মায়ের নাম। আমি চমকে গেলাম। সেই ছোট্ট ছেলেটা খুলনা জিলা স্কুলে পড়ে ক্লাস নাইনে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সময় কত দ্রুত যায়। জিলা স্কুলের কাস নাইনের আরেকটা ছেলেকে পেলাম, যার জন্ম হয়েছিল তখন আমি অনেকটা বড় হয়েছি। সুন্দরবন সরকারি কলেজে পড়ছে এমন এক বন্ধু পেলাম, যে বিয়ে করে ফেলেছে, এবং সেটা পাড়ায় এখনো জানানো হয়নি। বউ মাঝে মাঝে এসে থাকে ওদের বাড়িতে। আমার খুব হিংসে হল শুনে, কারন আমার কোন প্রেমিকাও নেই, আর ও সংসার করছে (গতবছরই খবর পেয়েছি বউ ওখানে থাকা শুরু করেছে)। এবং আগে যখন বউ আসত ওদের বাড়িতে, কেউ না জানলেও আমাদের সমবয়সী এক বন্ধু জানত। এবং সেই বন্ধুটা রাতে এসে জানালায় টোকা দিয়ে, ঢিল ছুড়ে জ্বালাত, সে খবরও পেয়েছি। আমাদের মত যাদের বাবা মা এই সুবুদ্ধি দেখাতে পারেননি, তাঁদের আসলে জানালায় ঢিল ছুড়েই শান্তি পেতে হবে। কপাল যার যত ছোট!
আমাদের ছেলেবেলা নিশ্চয়ই খুব আনন্দের ছিল। পড়ার কোন চাপ ছিল না। কে কেমন রেজাল্ট করছে সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা ছিল না। আহামরি ভালো ছিলাম না পড়ায়, হাতের লেখা বাজে ছিল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাত না বাসার কেউ। তবে আগ্রহ ছিল প্রচুর। কারন মা, বড় আপা কিছুদিন আগে বললেন আমি কীভাবে পড়তে শিখেছি তা তাঁরা জানেন না। বর্ণপরিচয় মায়ের কাছে শিখেছি। তারপর একলা একলাই বাংলা, ইংরেজী, আরবি তিনটে ভাষাই পড়তে শিখে গিয়েছি। সুর করে নানা জায়গার, নানা বইয়ের-ম্যাগাজিনের ছড়া পড়তাম মনে আছে। ইংরেজী ক্লাশের বইটাই শুধু পড়তাম। দেখে পড়তে পারতাম। আরবিও একলা শিখেছি। কোরআন শরীফ পড়তে পারতাম। সৌদি আরব থেকে বাবা চলে আসার সময় হাজার হাজার বই এনেছেন। সেসব বইয়ের নাম পড়তে পারতাম। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় শত্রু উইপোকা আর আগুন। একবার গ্রামের বাড়ি পুড়ে বহু বই ধ্বংস হল। খুলনায় উইপোকায় বহু বহু বই খেয়েছে। প্রায়ই আমরা উৎসবের মত করে সেসব বই রোদে শুকাতাম। তারপর বাবা নাম বলতেন, আমরা খুঁজে খুঁজে সে বই নিয়ে এসে সাজাতাম। কিছু বই ছিল, যেগুলোর প্রতিটা চার-পাঁচশ পৃষ্ঠার এবং বিশ-ত্রিশ খন্ড নিয়ে। সেগুলো পাশাপাশি তাকে রাখলে পাশ থেকে মিলে মিলে লম্বা একটা বাক্য পড়া যেত। আরবিতে বইয়ের প্রতিশব্দ ‘কিতাব’। আমরা সেসব বইকে এখনো তাই কিতাবই বলি। বাসায় তাই আরবি আর বাংলা বইয়ের পার্থক্য হয় বই আর কিতাব দিয়ে।
আরো একটা ভাষা শিখতে শুরু করেছিলাম, ঊর্দূ। আলিফ, বে, পে, তে, ছে, জীম, চে, হে... এতটুকু মনে পড়ছে বর্ণমালার। কারন ঐ বাড়ি ছাড়ার পর গত বছর পর্যন্ত আমার আর কখনো ঊর্দূ পড়া হয়নি। গতবার চেষ্টা করে মনে হয়েছে, ইশ! ছেলেবেলায় শিখলে মন্দ হত না!
বাড়ির সামনে রাস্তা, তার ওপারে বাড়িটা ছিল খালি। তারকাটা ঘেরা ঘন ঝোপঝাড়ে ঘেরা সেই বাড়িতে আমরা দুয়েকবার ঢুকেছি। মামা কলা নামে এক ধরনের লতা গাছ হত। সেই ফল খাওয়া যেত না। আর ছিল অনেক যশোরি লতা। কেটে-ছিড়ে গেলে এই পাতা পিষে আমরা লাগাতাম। মা-বাবাকে বলারও প্রয়োজন বোধ করতাম না। এখন সেই জমিটায় বড় বাড়ি হয়েছে।
খুলনা শহরে নিরালায় আমাদের আরেকটা বাড়ি ছিল। দুই-তিন কিলোমিটার, কিংবা আরো দূরে। আমরা হেঁটে যেতাম সেই বাড়িতে। বাড়িটা ছিল আমাদের বাগানবাড়ি। চাচা আর বাবার আরো বন্ধুর জমি এখনো সেখানে একসাথে এক আঙ্গিনায়। কেউ থাকেনা, তাই দখল রাখতে আলাদাও করা হয়নি। ঐ বাড়িতে যেতে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। এবং সেখানকার আনন্দ নিয়ে আলাদা একটা লেখা না লিখলে অপরাধ হবে। শুধু এটুকু বলে রাখি, নিরালায় যেতে ঘুরপথে না গিয়ে বিল পেরিয়ে যেতাম প্রায়ই। বর্ষাকালেও যেতে হত, এবং আমাদেরকে জোঁক ধরত। পাতা দিয়ে ধরে টেনে ছুটিয়ে ফেলতে একদম বেগ পেতে হত না।
এলাকায় এক আধপাগল মহিলা ছিলেন। আমরা তাকে ডাকতাম বাছা বু। আমাদের মায়েরা ডাকতেন বাছা বু, এমনকি বুড়িরাও ডাকতেন বাছা বু। তিনি সবার বাড়িতে একটা মাটির হাড়ি নিয়ে যেতেন, ভাতের মাড় নিতে। তাঁর কুকুরের জন্য। তিনি মারা গেছেন।
আর ছিলেন শাহিনের মা। আমাদের এলাকায় যখন মিঠা পানির ডিপ টিউবওয়েল বসাবে, তখন কেউ জমি দিতে রাজী হয়নি। বাবা এগিয়ে এলেন। আমাদের বাড়ির সামনের কোনাটা ছেড়ে দেয়া হল। সেখানে সরকারি টিউবওয়েল বসল, বড় বাঁধানো পাড় সহ। শাহিনের মা সবার বাড়ি বাড়ি কলসে করে পানি নিয়ে যেতেন। আমার জীবনে আমি সবচেয়ে পরিশ্রম করতে দেখেছি এই মহিলাকে। তাঁর স্বামি কখনো ঠেলাগাড়ি চালাতেন, কখনো রিকশা। আর প্রতিদিন স্ত্রীকে মারধোর করতেন। শাহিন আপার (যাকে আমরা তুই করে বলতাম গরীব বলে) বিয়ে হয় পরে। তাঁর মা কিছুটা স্বস্তি পান। তাঁর একটা ছেলে ছিল জাকারিয়া। ভীষণ দুষ্টু সেই ছেলের জন্মের সময়ের কথাও মনে আছে। ছেলেটাকে পালাও ওর মায়ের জন্য কষ্টের ছিল। ছেলেটাকে পরে সম্ভবত একটা এতিমখানা মাদ্রাসায় পড়তে দেয়া হয়। বাবা তো থেকেও নেই। এখনো পড়ছে ছেলেটা। এই ছেলেটা একবার খুলনা যাওয়ার পর আমাকে বলেছিল, আমি বড় হইয়া একটা মোবাইল আর একটা ট্রাক কিনমু। যখন বলেছে তখন আমি তেমন কিছু বড় হইনি, তবু খুব মন খারাপ হয়েছিল স্বপ্নের দৌড় দেখে।
ভিক্ষুক আসত অনেক। সবাইকে আধা পট করে চাল দেয়ার নিয়ম ছিল। দুই বুড়ির কথা মনে পড়ে। একজন ছিলেন যার একটা নীল শাড়ি ছিল। সম্ভবত একটাই শাড়ি তার, কারন আমার তাঁকে ঐ শাড়ি ছাড়া মনে পড়ছে না। তাঁর নাম সম্ভবত ছিল আছিয়া। কিংবা তার নাতনির নাম ছিল। এই নাতনি আমার কোন এক খেলার মধ্যে এসে পড়েছিল। আমার আবছাভাবে মনে পড়ছে আমার কিছু একটা আমি ওকে করুনা করেই হয়ত ধরতে দিয়েছি। ও আবার বলেছিল আমারে খেলায় আসতে দেখলে মারবে। মানে আমার মা কিংবা বড় আপার মারের ভয় পেত। আমার পরিবারে সবসময়েই গরীবরা বেশ সম্মান পেয়েছে দেখে এসেছি। সাভার শিল্প এলাকা। হাজার হাজার গার্মেন্টস ওই এলাকায়। বহু গার্মেন্টসকর্মী মহিলাকে আসতে দেখি মায়ের কাছে নানা প্রয়োজনে। তবে কেন ভিক্ষুকের নাতনি আমার খেলার মধ্যে এসে পড়ায় মারের ভয় পেত? আমার স্মৃতি কি প্রতারণা করছে?
বাড়ির পুকুরে মাছ হত। পুটি মাছ, তেলাপিয়া মাছের কথা মনে পড়ে। বড়শি দিয়ে আমরা মাছ ধরতাম প্রায়ই। একটা জাল ছিল। বড় ভাই সেই জাল ফেলেও মাছ ধরতে পারতেন। অনেক মাছ খেতাম। একটা শিরিষ গাছ ছিল। বসন্তে কিংবা শরতে (যখন অনেক বাতাস থাকত এটুকু মনে পড়ে) সেই গাছ ভরে ফুল ফুটত। শিরিষ গাছের ফুল ভয়ানক সুন্দর। উঠোনে ফুল ছড়িয়ে থাকত, আমি সেগুলো জমাতাম। বিশাল গাছ ভরে যখন ফল হত, সেগুলো পেকে পেকে পরত নিচে, আমরা কুড়িয়ে রাখতাম, জমাতাম। সত্যি বলতে, ঐ বয়সের কোন মন খারাপের স্মৃতি আমার নেই। একটা জিনিস মনে পড়ে, প্রায় বেলায়ই খেতে চাইতাম না বলে মা খুব মারধোর করতেন। এখনো বলেন, ছেলেটা জীবনে দুষ্টুমি করে মার খায়নি, কিন্তু খাওয়ার জন্য মার খেল আজীবন। এখনো আমি সে অভ্যাস ছাড়িনি। খাওয়াটা একদম কমই নিয়মিত করি। আমাকে যে কেউ অল্প কদিন পর দেখলে বলে, তুই আরো শুকিয়েছিস। এক বন্ধু (আমি ছেলে-মেয়ে সবাইকে ‘বন্ধু’ বলি) বলেছিল, ও যখন আমাকে প্রথম দেখে, একটা বড় পুরষ্কারে আমার নাম ঘোষণার সময়। তখন ওর পাশের জনকে বলেছিল, “এই ছেলে! একে দেখলে তো মনে হয় ফুঁ দিলেই বাতাসে উড়ে যাবে!” তখন আমার গলা খানিকটা ভরাট ছিল, সেটাও নাকি ওকে অবাক করেছে। পরে এই গলা খানিকটা মেয়েলি হয়ে যায়, তারও পরে আবার এখন বেশ ভরাট হয়ে যায়। এক বন্ধুর (বন্ধুত্বটুকু এখন নেই) ছোট ভাই ফোনে আমার কণ্ঠ শুনেছে, ওর বড় আপার ঘুমের সময়ে ফোন রিসিভ করায়। সেই ছেলেটা যখন আমাকে প্রথম দেখে, বলেতুমিই ওমর ভাইয়া! আমি ভেবেছিলাম ওমর ভাইয়া আরো অনেক স্বাস্থ্যবান আর বড় কেউ হবে।” সেই বন্ধুটা সেদিন আমাকে দুই-চার সপ্তাহের ব্যাবধানে দেখেই বলে, তুই আরো শুকিয়েছিস!
এই দুটো গল্প বললাম, কারন আমি নাকি একদম ছোটবেলা থেকে অনবরত শুকাচ্ছি। যেই যে সময়ে দেখেছে, বলেছে আগেরবার যা দেখেছি তারচেয়ে শুকিয়েছ। যখন দিনভর খুটখুট করে ঘুরে বেড়াতাম, তখনই অল্প খাওয়া আর বেশি শক্তি খরচ শরীর বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। ২০১১ সালে আমার ওজন ছিল ঊনপঞ্চাশ কেজি। ২০১৪ সালে সেটা কমে হয় ৪৩.২ কেজি। গত মাসে সেটা দেখেছি ৪২.৩ কেজি। এই মাসে সেই বন্ধুর কথা শুনে আরেকবার মেপে দেখার সাহস হয়নি। ছোটবেলায় আহামরি লম্বা ছিলাম না। ২০১০ সালে হঠাৎ করে বেড়ে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি হয়ে যাই। আর এখন সেটা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। আসলে ঐ অতটুকু থাকতে লম্বা মানুষদের প্রতি হিংসে হত। এখন আমিও লম্বার কাতারে পরি, তবে অসম্ভব শুকনো হিসেবে।
রূপসা নদী ছিল কাছে। সেই নদী দেখতে মাঝে মাঝে যেতাম। বিশাল বিশাল তেলের শীপ আর নানারকম কার্গো যেত সে নদী দিয়ে। দুই পাড়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে দেখতে বেশ লাগত। আর কাজ হচ্ছিল সেতুর। সেতুর কাজ ছিল বিদেশি কোন এক কোম্পানির। আমরা দেখতে যেতাম সেই কাজ। অনেক বড় জেনারেটর আর নানারকম যন্ত্র ঘরঘর শব্দ তুলে ঘুরছে, আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বিদেশিরা মাথায় হ্যাট পরে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখতে ভালো লাগত। নদীর পাড়ে ছিল কোকা কোলার ফ্যাক্টরি। আসলে বড় হয়ে জেনেছি, সেখানে কোকা কোলা বানানো হত না। শীপে করে এনে গুদামজাত করা হত, আর সেখান থেকে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে সাপ্লাই দেয়া হত। আর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ছিল। সেটাও অনেক বড়। সেখানে ঢোকার শখ ছিল বরাবরই, কিন্তু সে শখ পূরণ হয়নি। কর্ণফুলি পেপার মিলসে গিয়েছি কয়েকবার। বড় বড় গাছ চৌবাচ্চায় রেখে যান্ত্রিক ঝর্ণা দিয়ে পানি দেয়া হচ্ছে ঘুরে ঘুরে। মিলের সামনে নদীতে একটা স্পীডবোট বাঁধা থাকত, যা আমাকে বেশ টানত।
গোলগোল্লা নামের একটা জিনিস ভাজা হত সকালবেলা। খুব ভোরে এক টাকা নিয়ে সেই গোলগোল্লা কিনতে যেতাম। ভাপ ওঠা গোলগোল্লার কথা এখনো মনে পড়ে। গত বছর ঢাকা মেডিকেলের সামনে সেই গোলগোল্লা দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম। এরপর থেকে প্রায় দিনই বাসায় ফেরার সময় দলবেঁধে হয় টিএসসিতে পাকুড়া খাই, নয়ত ঢাকা মেডিকেলের সামনে গোলগোল্লা। আমাদের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল এদুটোর একটা প্রতিদিন খাওয়ার।
বারবার আমার চেষ্টা থাকে শৈশবে ফিরতে। যাই ঘটুক, শৈশবের স্মৃতির সাথে মেলাতে চেষ্টা করি। কারন শৈশবটা ছিল সুন্দর। আমি জানিনা ঢাকার বাইরে থাকলে সবার শৈশবই তখন এত আনন্দের হত কিনা। আমার কয়েকবছরে আগে পর্যন্ত ধারনা ছিল, ঢাকার বাইরে সবাই বুঝি নিজেদের বাড়িতে থাকে, এবং সেখানে নিশ্চয়ই গাছপালা, উঠোন, পুকুর থাকে। আনন্দে আনন্দে বড় হয়। তাই যারা ঢাকার বাইরে থাকছে, তাঁদেরকে হিংসাও হতে শুরু করে। কিন্তু দেখতে পাই বাস্তবটা অত সত্যি না। আমার শৈশব এমন আনন্দের ছিল, যেটা অন্যরা হিংসে করতে পারে। সৌন্দর্যের পেছনে অবদানটা পরিবারের। বাচ্চাদেরকে চাপ দেয়া হয়নি তো সে কল্পনায় মেতে উঠতে পারবে।
খুলনা শহরের সেই বাড়িতে প্রায় আট বছর বয়স পর্যন্ত থেকেছি আমি। তারপর পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। জীবন একদম বদলে যায়। খুলনায় বসে ঢাকা তখন আমাদের কাছে স্বপ্নের মত। সেই ঢাকায় আসার সময় প্রবল উত্তেজনা ছিল। এসে আনন্দ কমেছিল কিনা আমার মনে নেই। তবে একদম ভদ্র আমি নানারকম দুষ্টুমি শিখে যাই নিমিষে!


গল্পশেষে ভূমিকা

আমার একটা ডায়েরি আছে এই বছরে লেখা। সেই ডায়েরিটা এক বন্ধুকে দিয়েছি লেখা শেষ হতেই। যাকে দেয়া হয়েছে, সেও সেখানে আমার অনেক কথার নিচে দুয়েক লাইন মন্তব্য লেখে। কোথাও একটা কান্নামাখা ছবিও এঁকেছে। সেই ডায়েরিটার প্রতি আমার একদম আগ্রহ নেই এখন। যাকে দেয়া হয়েছে, তারও আগ্রহ ফুরিয়েছে। সেটা নষ্ট করে ফেলার কথা উঠল। কিন্তু তাঁর কাছে তাঁর বন্ধুরা ডায়েরিটা চেয়ে বসল। আমি তাতেও না করিনি। এখন কিছু বিরক্তি এমন পর্যায়ে চলে এসেছে, আমার তাঁর সামনে বসে ডায়েরিটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু আহমাদ এবার বলল, ছিড়বি কেন! এটা রেখে দিবি না? বড় হয়ে এসব লিখতে হবে না? কোত্থেকে লিখবি?
তখন মনে হল, যদি কোনদিন কষ্ট করে বড় হয়ে যেতে পারি, তবে ঐ ডায়েরি নিশ্চয়ই বই হিসেবে বের করতে পেছনে লাগবে মানুষ। কারন সেই ডায়েরি যারা পড়েছে (চুরি করে, কিংবা চেয়ে নিয়ে), তাঁরা জানে সেটা কতটা মজার। এই যুগ এবং আমার বয়স, দুটোর তুলনায়ই সেই ডায়েরি অসম্ভব মজার। কারো কাছে সেটা অসম্ভব সুন্দর, কারো কাছে সেটা প্রিয়, কিন্তু আমি এবং আমার দুষ্ট বন্ধুদের কাছে সেটা নিখাদ মজার একটা বিষয়। আমি যেহেতু বড় হবার স্বপ্ন দেখি, তাই বড় হওয়ার জন্য সব জমিয়েও রাখতে হয়। সেজন্য এই শৈশবকে একরকম করে লিখে ফেললাম। আরো সব স্মৃতির বিষয়গুলোও লিখতে শুরু করব শিঘ্রী, দুয়েক মাস পর যখন আমি মুক্ত সময় হাতে পাচ্ছি।
সেই ডায়েরিটা আমি আমার কাছে রাখতে রাজী নই। যাকে দেয়া হয়েছে, সেও রাখবেনা। দুজনের বিরক্তি এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে। ডায়েরিটা কার কাছে থাকবে তবে? কেউ রেখে দিতে চাইলে আমরা ভেবে দেখতে পারি।


1 টি মন্তব্য:

  1. আহা! আহা!

    এই স্মৃতিকথার সিকুয়েল কি পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে?

    খুব ভালো লেগেছে :-)

    উত্তরমুছুন