বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

পৃথিবীটা কমলালেবুর মত গোল

তুমি আমাকে ভুল বুঝলে, ভীষণ লজ্জায় আমি পালিয়ে যেতে চাই। কখনো আর মুখ দেখাতে চাই না। তা আমি পারব কেমন করে? পৃথিবীটা যে গোল! ঘুরেফিরে আবার তোমার সামনে আমি পড়বই! তোমাকে আবার আমার মুখ দেখাতে হবে। হু, এ পৃথিবীতে এখন আর পালিয়ে যাওয়া যায়না।

পৃথিবীটা যদি হত থালার মত চ্যাপ্টা, তবে তুমি যেপথে হাঁটছ, উল্টোদিকে চললাম, আর দেখা হবেনা। একদিন চ্যাপ্টাই ছিল, তখন পালিয়ে বাঁচা যেত। কিন্তু এখন আর নেই যে সে দিন! বারবার মুখোমুখি হতে হবে।

অপ্রাসঙ্গিক শুরুটা থাকুক। 'অশিক্ষিত' লোকজন আমার একদম অসহ্য লাগে। গা জ্বলে বলা যায়। কিছু মানুষ আছে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষিত মন নিয়ে বেঁচে আছেন। আমি তাঁদের কথা বলছিনা। ডায়েরিতে দেখলাম, 'অসহ্য লাগে অশিক্ষিত মানুষদের'- কথাটা খুব সুন্দর করে লেখা। কবে কী কারনে লিখেছিলাম, ভুলে গেছি এতদিনে। তবে অসহ্য এখনো লাগে, লেগে যাবে।



মানুষগুলো 'অধিকার' শব্দটার সাথে ঠিক পরিচিত না। তবে 'আদায়' শব্দটাকে ভালবাসে। আমি যে ব্যাপারটাকে অধিকার হিসেবে অনুভব করি, সেরকম একটা অনুভূতি তাদেরও আছে। সেটা হল যেভাবেই হোক সবক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদায় করে নিতে পারাটা। অনেকে ভদ্র হয়, তারা ঠিক জবরদস্তি কিংবা চেঁচিয়ে আদায় করতে পারেনা। তবু চেষ্টা থাকে পেতে হবে। কতটুকু পাওনা সেটা তারা জানে না। শুধু জানে পেতে হবে আমাকে। এবং পেতে হবেই! আর অন্যরা আরেক কাঠি সরেস। তারা তাদের অনুভূত অধিকার আদায়ে সোচ্চার!

তাদের ভাললাগাগুলো অদ্ভুত, তাদের অগ্রগণ্য বিষয় দেখতে পেলে হাসি পাবে সবার। তারা ঠিক কী নিয়ে ভাবছে, সেটা সুস্থ্যরা সহজে বুঝতে পাবে না। কিন্তু তাদেরকে চেনা খুব সোজা।

টয়লেটের বাতিটা না জ্বালিয়ে হয়ত তারা টয়লেটে যাবে অল্প আলো আছে বলে। দেখে মুগ্ধ হতে হবে। বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করছে। এবং প্রায় সব সচেতন মানুষও এ আলোয় বাতিটা জ্বালিয়ে নেয়। কিন্তু দেখা যাবে সে একটা জিনিস রান্না করে চুলোটা অল্প আঁচে জ্বালিয়ে রেখেছে, ম্যাচকাঠি বাঁচাতে।

সে আসলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করছে না, সাশ্রয় করছে বিদ্যুৎ বিল। গ্যাসের মিটার থাকলে তার পদ্ধতিটা উল্টে যেত ঠিকই।

এই মানুষগুলোর নানারকম কর্মকান্ড দেখে অশ্রদ্ধা আর ঘৃণায় আমি কতটা নীচে নামছি তা আমি জানিনা। আমি এখন স্পষ্ট করে ঘৃণা অনুভব করতে পারি, এবং সমালোচনা করতে পারি। একটা সময় ছিল, যখন আমি প্রচন্ড অপছন্দ করতাম অন্যের উপস্থিতিতে সমালোচনা করাকে, যেটাকে আরবী ভাষায় বলে 'গীবত' এবং এর কোন সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। কেউ কাজটা আমার সামনে করলে আমি চুপ করে এড়িয়ে যেতাম, কিংবা বিষয় বদলে নিতাম। নিজে একটুখানি করে ফেললে ঘেন্না লাগত নিজের প্রতি। কিন্তু আমি এজাতিয় মানুষদের, যাদেরকে বলছি অশিক্ষিত কিংবা অপশিক্ষিত, তাদের ব্যাপারে কাজটা এখন ঠিকই করতে পারি। এবং এখন এটা হয়তবা অভ্যাসের দিকে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মানুষগুলোর মাঝখানে বেঁচে থাকা 'অসহ্য' একটা ব্যাপার। যেটাকে আমি যতই চাই, এড়াতে পারবনা। আমাকে এগুলো দেখে এবং সহ্য করে বাঁচতে হবে।
এই বাক্যটা হয়ত নাড়িয়ে দিয়েছে অনেককে। রে রে করে উঠতে ইচ্ছে করছে। কেন সয়ে যাব? প্রতিবাদ করতে হবে এবং বদলাতে হবে। কিন্তু করুণ ব্যাপারটা হল, তাদেরকে বুঝানো এবং শেখানো যায়না। "Tit for tat"-একটা বাক্য আছে, সেটা খানিকটা কাজ করে কখনোবা।

একজন মানুষকে 'ময়লা ঠিক জায়গায় ফেলতে হয়'- শেখানোর সবচেয়ে ভাল উপায়টা হচ্ছে তার ফেলা ময়লা উঠিয়ে আপনি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিন তাকে দেখিয়ে। এবং এটা করতে হবে এমন ময়লার ব্যাপারে, যেটা হাত দিয়ে তুলতে আপনারই ঘৃণা লাগবে। দেখুন সে শিখে গেছে ময়লা কোথায় ফেলতে হয়। অথচ আপনি যদি একজন অশিক্ষিতকে এভাবে শেখাতে যান, খুব মজার একটা ব্যাপার হবে। সে মনে মনে হাসবে, "আহা! আমার ময়লাটা ফেলে দিল! টোকাই জাত!"- ভেবে। সত্যি এমনই হয়। নইলে রাস্তায় কেউ সিগারেটের ফিল্টারটা যখন ফেলে, তখন আপনি সেটাকে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে তারপর তুলে নিয়ে ফেলে দিন ডাস্টবিনে। কিন্তু আপনি ডাস্টবিন পাবেন না বাংলাদেশের রাস্তায়। যে কাজটা আপনাকে করতে হবে, সেটা হল ফিল্টারটা তুলে কাগজ পেঁচিয়ে পকেটে পুরে রাখা, এবং বাসায় এসে ডাস্টবিনে ফেলা। আপনি করে দেখুন, এবং যে লোকটা ফেলেছে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তার চোখে দেখতে পাবেন, আপনি একটা 'ছোটলোক', রাস্তার ঘৃণ্য ময়লা হাত দিয়ে ধরেন।

যদি আপনি পরীক্ষাটা করে দেখেন, তাহলে অশিক্ষিত মানুষটাকে ক্ষমা করে দিয়েন। তার চোখ দুটো আপনার উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে হবে, এবং আপনি যদি সত্যিই কাজটা করেন, তবে আপনি সত্যিই ছোটলোক।

তবে কী, এই মানুষগুলোকে শেখানো যায় অসহায় পেয়ে। আপনার দল ভারী, এক লোক রাস্তায় ময়লা ফেলল, ডাক দিয়ে বললেন, ময়লাটা উঠিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলুন। দেখবেন সে শিখে গেছে। "Tit for tat"-বাক্যটাকে তারা খুবই সম্মান করে। এরপর সে যখনই ময়লা ফেলার কথা ভাববে, সাথে তার মনে পড়বে, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতে নেই।

এই অশিক্ষিত মানুষগুলো হয়তবা সমাজের ছোট পেশাগুলোয় বেশি, কিন্তু আপনি এদেরকে পাবেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রীদের মধ্যেও। সবখানে আছে এরা, এবং এদেরকে আমার অসহ্য লাগে।

এবার বলি, আমি কিন্তু ময়লা ফেলার মত অসচেতনতা নিয়ে লিখিনি। লিখেছি মানুষগুলোকে চেনার সহজ একটা উপায় নিয়ে। কিন্তু এই অশিক্ষিত মানুষগুলো করতে পারে সবরকম ঘৃণ্য কাজ। এ মূহুর্তে দেশটা যেমন উত্তাল রেইপ নিয়ে, চুরি নিয়ে, এবং মারামারি নিয়ে। তেমন সব কাজগুলো এই মানুষগুলো করতে পারে, এবং তাদেরকে আমার অসহ্য লাগে।

একসময় মনে হত, শুধুমাত্র শুদ্ধ মানুষকে পছন্দ করতে হবে, শুদ্ধ মানুষকে ভালবাসতে হবে, শুদ্ধ মানুষের সাথে মিশতে হবে। সেটা একটা ভুল ধারনা ছিল। শুদ্ধ মানুষের দেখা মেলেনা। মানুষ শুধু নিজের কাছে নিজে শুদ্ধ হতে পারে। যেমন আমি নিজেকে শুদ্ধ মানুষ ভাবি।

অল্প শুদ্ধ মানুষের কাছে ভেড়া যাবে, এবং এড়িয়ে যেতে হবে অশিক্ষিত মানুষগুলোকে। এখন আমি এভাবে ভাবি। এই অসহ্য মানুষগুলোর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর আমার খুব ইচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীটা কমলালেবুর মত গোল। আমাকে তাই বারবার তাদের সামনে পড়তে হবে, কখনোবা তাদের মুখাপেক্ষি হতে হবে। তবু আমি তাদেরকে এড়িয়ে যেতে চাই, তাদেরকে দূরে ঠেলতে চাই। কারন আমি ঘৃণা করি।
কিন্তু আমি আমার শুদ্ধ ভাললাগার জন্য হাতজোড়ও করতে পারি তাদের কাছে। তবু, মানবতা মুক্ত হোক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন