সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

শহর আর শহরতলীতে বাস এবং বিকারগ্রস্থ আমরা যেমন

একটা গল্প দিয়ে শুরু।
মিরপুর দশের মোড় থেকে একটু ডান দিকে। রাস্তার মাঝখানে একটা জটলা, একটা হিউম্যান হলার (ম্যাক্সি) রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করানো। ভীড়টা তার সামনেই। এগিয়ে দেখি, একটা রিকশা উল্টে আছে তার মধ্যে ফেলে হিউম্যান হলারের চালককে পিটাচ্ছে অনেকগুলো মানুষ (?)। প্রায়ই এসব দেখি, তাই ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে যেতে গিয়েই ধাক্কাটা খেলাম। ভীড়ের পাশেই রাস্তায় পরে আছে রিকশাচালক, যাকে ধাক্কা দেয়ার অপরাধে গণপিটুনি জুটছে হিউম্যান হলার চালকের কপালে। প্রায় বদ্ধ উন্মাদের মত করে মারছে লোকটাকে 'গণমানুষ'। আর সেই রিকশাচালক রাস্তায় আহত হয়ে পরে আছে, শরীরের অনেক জায়গায় ছিলে গেছে।



কান্ড দেখে এগিয়ে আসা সবাই হয় পিটুনি দেখছে, নইলে হাতের ব্যায়ামটুকু সেরে নিচ্ছে ঐ চালকের ওপর। ঢাকায় আবার ব্যায়ামের জায়গার বড় অভাব।
বেশ অনেকক্ষণ পরে, ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে গেল রিকশাওয়ালার দিকে। হাত ধরে তুলল, কোথায় কোথায় ছিলেছে দেখল। পুলিশটার প্রতি আমি শ্রদ্ধায় মাথা নত করে নিজের পথ ধরলাম।

ঢাকা শহরটায় থাকায় একটা 'অসাধারণ' জিনিস প্রায়ই দেখার ভাগ্য হয়। গণপিটুনি। গণপিটুনির সংজ্ঞা হতে পারে, গণমানুষ অপরাধিকে ধরে অপরাধ না জেনে যে পিটুনি দেয়, তাইই গণপিটুনি। সত্যি কথা, যারা মারে, তাদের এক থেকে দুইজনের বেশি ঠিক করে জানে না ঠিক কী কারনে মারা হচ্ছে। তাদের মারতে ভাল লাগে।

জুনায়েদের গল্প জানেনা এমন কে আছে? সবাই প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে ভিডিওগুলো দেখে, যেগুলোতে মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে নানা ছেলেরা, মেয়েরা বলছে, "আমি জুনায়েদ!" হাত এবং কব্জি নব্বই ডিগ্রি বাঁকিয়ে, আঙ্গুল সোজা করে বলছে "গুটিবাজী করস?" জুনায়েদের একটা ভিডিও আছে, সেটাও সবাই অনেক আগেই দেখেছে। এখন শত শত আপলোড হওয়া ভিডিও, অর্থাৎ রম্য ভিডিওগুলো না দেখে থাকা যায়?

একটা সময় ছিল চৌদ্দ সালের দিকে, যখন আমরা ছোটদের সামনে, কিংবা মেয়ে বন্ধুদের সামনে জোক বলতে পারতাম না। কারন তখন ফেসবুকের সব পেইজ থেকে 'বল্টু' নাম দিয়ে কৌতুক বের হত, রম্য ফটো বের হত, যাতে থাকৎ বল্টুর অশ্লীল সব হিউমার। এবং ছোটবেলা থেকে পড়া শত শত কৌতুকের সব আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, এবং কোনমতেই একটা শ্লীল কৌতুক মাথায় আসত না। এক বন্ধু খুব দুঃখ নিয়ে বলল, তার প্রেমিকা তাকে বলেছে একটা কৌতুক বলো, সে বলতে পারেনি। কারন তার মাথা ভর্তি 'বল্টু জোক'। পরে আমরা ঘেটে ঘেটে কিছু শ্লীল কৌতুক বের করে দিলাম, যেগুলো সে পরদিন থেকে বলত।

এখন কাউকে হাসাতে হলেই চুলে হাত বুলিয়ে বলতে হবে "আমি জুনায়েদ!" আমরা যখনো ভাল করে ফেসবুক শিখিনি, ততদিন পর্যন্ত কৌতুক বলতে জানি নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, গোপাল ভাঁড়ের শিক্ষামূলক সব গল্প। দিন বদলাল, আমরা ইন্টারনেট পেলাম, ফেসবুক পেলাম, পর্নো আমাদের সহজলভ্য হল, এবং আমরা 'বল্টু জোক' শিখে গেলাম। যেহেতু সেসময়টায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল পুরো দেশে, তাই আমরা একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকেও বাগে নিয়ে এলাম। সেগুলো হল 'চাচা জোক'। বলা বাহুল্য, সেটারও মূল ভীত্তি অশ্লীলতা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। তাঁর অসাধারণ শক্তি হল, ভিন্ন ভিন্ন ভাব ফুটিয়ে তোলা চেহারায়। সবরকম 'এক্সপ্রেশন' এর ফটোই পাওয়া যাবে খুঁজলে। তাই এটাও একটা জোক। তাঁর ছবিগুলোয় নানা বাণী লাগিয়ে সবখানে কমেন্ট! ফেসবুক কর্তৃপক্ষ খুঁজলেই পাবে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আপলোড করা হয়েছে এই অভিনেতার ছবি! এবংফ তার প্রায় পুরোটা পোস্টের মন্তব্যে।

দেশের সবচেয়ে বড় জাতিয় দৈনিকের একজন সিনিয়র কলাম লেখক এসব কিছুকে আখ্যা দিয়েছেন 'তারুণ্যের বিকার'। সত্যি এটা তারুণ্যের বিকার। তিনি মারধোর, সেগুলো ফেসবুকে আপলোড করার পেছনের মনস্তত্ব বিশ্লেষণে বলেছেন এর একমাত্র কারন 'স্মার্ট' হওয়ার চেষ্টা। ফেসবুকে লাইক পাওয়ারও একটা বড় ইচ্ছে থাকুক। কিন্তু তারুণ্যের বিকারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এই সময়ের মনস্তত্ত্ব।
'আধিপত্য' বিস্তার এর চেষ্টা মানুষের আদিকাল থেকে। আমি এই যে লিখছি, এই যে প্রচুর পড়ার চেষ্টা করছি, বড় হতে চাচ্ছি, সেটাও একধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। আমার চেষ্টাটাও এক ধরনের 'স্মার্ট' হবার চেষ্টা। কিন্তু বিকারগ্রস্থদের চেষ্টাটা অন্যরকম।

এতক্ষণে মূল লেখায় আসছি। সত্যি কথা হল, কখনো বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি হয়। এখানে ভূমিকাটা অনেক বড়, লেখাটা অনেক ছোট।

এই ছেলেগুলো এমন হয় কেন? আমি জুনায়েদ এর ভিডিওটা একটু একটু করে কয়েক অংশ দেখেছি। আমার ফেসবুক না থাকায় কাল পর্যন্ত জানতাম না ব্যাপারটা এত 'ফেমাস' হয়ে গেছে। আমার কাছে ঐদিন কিন্তু মারটা দেখে কিচ্ছু মনে হয়নি। এর চেয়ে বিভৎস মারামারি দেশের প্রায় প্রত্যেকটা এলাকায় সপ্তাহে একবার হয়। অন্তত শহরতলী এবং শহরগুলোয়। সেগুলো কেমন হয়?
বিভিন্ন অপরাধে একজনকে কয়েকজন মিলে পিটানো। কখনো দলবেঁধে মারামারি। এই ছেলেগুলোকে এলাকার মানুষ বলতে পছন্দ করে 'বখাটে'। বিকারগ্রস্থ শব্দটা বেশি মানানসই। এদের অনেকেই স্কুলে-কলেজে পড়ে, অনেকে পড়ে না। কাউকে মারার প্রতিশব্দটা হল 'বানানো'। কেউ কোন ফল্ট করলে তাকে বানানো হয়। অপরাধগুলো অনেক সুন্দর। যেটাকে আমরা বলতে পারি 'কিউট'।
একজনকে রাস্তায় ঝাড়ি মারা, গালি দেয়া, নিজের এলাকায় পেয়ে একটু 'টিপে দেওয়া' (বাকের ভাইয়ের ভাষায়)। মোবাইল ছিনতাই (বিকারগ্রস্থদের পরিভাষা হল 'লইয়া লওয়া') একটা বড় কারন থাকে। এছাড়া দোকানদার, হোটেলের বয়রাও এই 'বানানো'র শিকার হয় কখনো।

হ্যাঁ এটা সব শহরে হরদম ঘটছেই!

মার দেয়ার পূর্বপ্রস্ততি আছে একটা। ঠিক করা হয় কোনখানে 'বানানো' হবে। তারপর নিজের দলের মানুষদের নিমন্ত্রন জানানো। এটা করা হয় এভাবে।
ফোন দিয়ে, বা দেখা করে বলা হয়, "মামা অমুক জায়গায় সন্ধ্যার পর আহিস তো! অমুক খা*** পোলায় বাড়ছে। অরে ধরমু।" ঠিক এই বাক্যটাই প্রতিদিন শতবার ব্যবহার হচ্ছে পুরো দেশে। ধরার জন্য দুটো পদ্ধতি। সে ঐ রাস্তা দিয়ে যাবে, কিংবা তাকে ডেকে আনা হবে। তারপর চলবে 'বানানো'। বানানোর বিস্তারিত পদ্ধতি বলার কিছু নেই। সবাই দেখেছে। জুনায়েদের মত প্রায় ঐ জাতিয় বাক্য ব্যাবহার করেই বানানোটা চলে। সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহার হয়, "আমারে চিনস?'

আমার যদি আজকে রাস্তায় কোন বখাটের সাথে ঝামেলা লাগে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে রাস্তায় ধরে বানানো হবে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ এবং কলকাতায় বানানোর সংস্কৃতিটা প্রায় একইরকম।

মজার ব্যাপার হল, কেউ যদি জানে, তাকে আজকে 'ধরা' হবে, সেটা নিয়ে সে খুব বেশি বিচলিত হয় না। কারন সেও 'স্মার্ট', এবং বিচলিত হওয়া তার পুরুষত্বে আঘাত হানে। সেও উদ্ধত ভঙ্গিতেই যাবে মার খেতে।

এখানে এখন আর কিছুর প্রতিবাদ করা যায়না, কোন সাহায্যও পাওয়া যায়না। সামাজিক নিরাপত্তা মানে পৃথিবীতে কিছু একটা ছিল, সেটা নেই এখন কোনরকম এই দেশটায়। সেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা অনুষ্ঠান শেষ হল সন্ধ্যার পরে। একটা বড় আপু (নাম বলছি না) আমাকে বললেন, "ওমর আমাকে একটু নীচে এগিয়ে দিয়ে আয়।" আমি বললাম, "একাই যাওনা! টাটা!"
বললেন, " না বাবা গাড়ী নিয়ে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে আছেন। বের হয়ে ঐ গলিটুকু সন্ধ্যার পরে পার হওয়া... ঠিক সেইফ না।"
নিজেকে অসহায় লাগল। কেন্দ্র থেকে মূল রাস্তা বড়জোড় ত্রিশ-চল্লিশ ফিট দূরে। রাস্তাটুকু হেঁটে যেতে লাগে ৩০ সেকেন্ড। অথচ সেটুকুও সেফ না। সেই রাস্তাটা এগিয়ে দিতে আমি নীচে এলাম।

এবং সত্যি কথা হল, সন্ধ্যার পরে বাংলাদেশের শহর এবং শহরতলীর সব রাস্তা মেয়েদের জন্য আর 'সেইফ' থাকেনা। বিকারগ্রস্থ স্মার্ট ছেলেদের দখলে চলে যায় সব গলি, এবং আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা।

ছেলেদের জন্যও রাস্তাগুলো সন্ধ্যার পরে বিভীষিকা। ছিনতাই এই হল বলে! দুইবার এভারেস্টজয়ী মুহিত একদিন বলেছিলেন, "নেপালে আমি তিনলাখ টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে পকেটে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি, ব্যাপারটাকে আমার একটুও বিপজ্জনক লাগেনি। অথচ বাংলাদেশে সম্ভব না সেটা" বাংলাদেশে আমি পুরনো একটা ২০ টাকার নোট এবং স্ক্রিন ফাটা নোকিয়া বারো শ' মডেলের ফোন নিয়েও সন্ধ্যার পরে হাঁটতে ভয় পাই অনেক রাস্তায়। একবার শ্যামলির একটা রাস্তা দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম সন্ধ্যার পর। হঠাৎ এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এল। এসে বলল, "আপনে নাকি ঐ যে অরে মারবেন?"
তাকিয়ে দেখি, দুইটা ছেলে, চৌদ্দ-পনের বছর বয়স হবে, মলিন পোশাক এবং বড় চুল। একটা দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমি দ্রুত হেঁটে রাস্তাটা পার হয়ে গেলাম। পিচ্চি ছেলেটাকে অনেকটা ধাক্কা দিয়েই চলে গেলাম। কারন আমি জিজ্ঞেস করি যদি মারার কথা কখন বলেছি। আমার মোবাইল এবং পকেটের বড় অংকের টাকাগুলো খোয়াতে হবে আমাকে।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন,
"এই রাত্রিরা বেথেলহামকে ব্রথেলে পরিণত করে"
এটা কোত্থেকে এল আমি জানিনা। কিন্তু এখন আর নাসিরুদ্দিন হোজ্জার 'জোকস' কেউ পড়ে না, এখন আর মেয়েদেরকে মুগ্ধ করতে ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কবি সাজে না। স্মার্টনেসের সংজ্ঞা বদলে গেছে।

মা, আমি স্মার্ট হব না!

1 টি মন্তব্য: