শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮

প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধের নবীনবরণ

অবশেষে সেই অনুষ্ঠানটা শেষ হল। সেই অনুষ্ঠান, যার জন্য আমাদের সবার রাতের দৈর্ঘ্যটা কমে গিয়েছিল। কত হাসি-কান্না রাগ-অভিমানের জন্ম দিয়ে হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেল, ঠিক আন্দাজও করা গেলনা। মনে পড়ছে মিলনের রুমের আগ্রাসী ছারপোকাদের কথা। মহুয়ার সেই তাড়া, "ওমর কিউআর কোড এখনো দিলি না?" মিলির সেই আব্দার, ওয়েলকাম ডান্সের জন্য একটা জামা, অন্য নাচের জন্য আরেকটা। সবার চাওয়ার কমতি নেই। সবকিছুর শেষ চাওয়া, অনুষ্ঠানটা অসাধারণ হওয়া চাই।

সেই নবীন ব্যাচকে কিছুই ভাবতে হয়না সাজগোজের বাইরে, যাদের নিয়ে এত এত আয়োজন। ভাবতে হয় আমাদেরকে, ২০তম ব্যাচকে। শুরুটা ক'বে, কারও মনে থাকবার কথা না। দিন কাছে আসে, আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাতের ঘুম কমে যায়। একসময় আমার রাতে বাসায় ফেরাও থেমে যায়। রিহার্সালে মূল একটা চরিত্রকে পাওয়া যায়না, রাগে ফেটে পড়ে আর সকলে। প্রক্সি দিয়ে চলে রিহার্সাল। বাজেটের অভাবে কাজ করতে থাকা মানুষগুলোর জন্য যে লাঞ্চ আসে, সেটা দেখে কারও কণ্ঠে বাজে, "কইতরের খাবার মাইনষেরে দিছে"।

বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা চারপায়ে হাঁটবার পূর্বমূহুর্তে

কথিত আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যেভাবে  চা খেতে জানে, সেটা শিখতেও অন্যদের ম্যালা দিন লাগে। কথা চালু হবার পেছনে মনে হয় ঐতিহ্য ব্যাপারটা আছে। আমাদের ঐতিহ্য বেশ ভারী। অন্তত এ দেশে যদি ঐতিহ্যের দিক থেকে একটা গোষ্ঠীকে মাপতে যাওয়া হয়, ঢাবির নামটা ওপরেই আসবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যা ঘটছে দিনে দিনে, মুখ লুকবার জায়গা থাকবেনা। আমাদের ঐতিহ্যটা যে উগ্র পেশিশক্তির চেয়ে বেশি কিছু, সেটা প্রত্যেকের কানে কানে গিয়ে বলে দিয়ে আসতে হবে হয়তবা। হয়তবা লিখে দিতে হবে আমাদের প্রতিটা নোটিশে, পরীক্ষার প্রশ্নে, ভর্তির আবেদনপত্রে, ক্যাম্পাসের প্রতিটা ঘরের দরজায়। উল্টো রাস্তা আর প্রশ্ন ফাঁস নয়, আজকের ঘটনাটা শুনুন না!

সন্ধ্যেটা অতটা খারাপ ছিলনা। সন্ধ্যার আগে উত্তম কুমারের একটা সিনেমা দেখে নায়িকা তনুজার চোখ কল্পনায় খুব করে গেঁথে গিয়েছিল। সাড়ে ছটায় ক্লাস ছিল স্প্যানিশের, ছয়টা বিশে টিএসসিতে ঢুকতে অক্টাভিয়ানের সঙ্গে দেখা।

শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭

এ-লো-মে-লো

'চিল মুড' শব্দটার একটা অর্থ খুঁজছিলাম। কিন্তু ঠিক মিলছিল না কিছু। 'মাস্তি' হতে পারত, যদি সেটা বাংলা শব্দ হত। 'ফুর্তি' শব্দটা সবার মাথায় আসবে, কিন্তু সেটা ঠিক চিল মুড এর সঙ্গে যায়না। ফুর্তির মধ্যে একধরনের ছেলেমানুষি ভাব আছে। আমি যখন কোন পরীক্ষা দেই, আমার মস্তিষ্ক তখন চকলেট খাবার, কিংবা প্রেমে আপ্লুত হবার পরমূহুর্তের মত অবস্থায় থাকে। কোনরকম ক্লান্তি কাজ করেনা। তাই বারবার মনে হচ্ছিল, পরীক্ষা জিনিসটা সবসময় চিল মুডের আবেদন নিয়ে আসে আমার জীবনে। যদিও জিনিসটার প্রতি বিরক্তি আছে, মাসখানেকের পরীক্ষা আমাকে হাঁপিয়ে তোলে, তবু পরীক্ষার সময়টুকুতে আমি  ধ্বসে পড়িনা। পরীক্ষার হলে আমার কষ্ট হয়না কোন। ব্যাপারটা মাথায় এল দুদিন পর পরীক্ষা বলে।

পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমনব হচ্ছে সেটা আলাপ করবার মত কিছু না। তবে আজ দিনভর বৃষ্টি সবকিছু এলোমেলো করে দিল। 'ডিভাইস' জিনিসটা আমাদের জীবনে খুব ভালো কিছু এনেছে বলে আর মনে হচ্ছেনা। আজ দুপুরে বৃষ্টিতে যখন রাস্তাঘাট (একসময় লেখা হত নদী-নালা) ভেসে যাচ্ছে, তখন আমাদের ক্লান্তি এল। একটা ঘরে তিনটা মানুষ, আহমাদ, ইব্রাহিম, এবং আমি। হঠাৎ দেখা গেল একই ঘরে বসে আমরা তিনজনে আলাদা তিনটা সিনেমা দেখছি! কম্পিউটারের বড় স্ক্রিনে আহমাদ ফরেস্ট গাম, ইবরাহিম মোবাইলে কোন একটা যুদ্ধের ছবি, এবং আমি উত্তম কুমার-শর্মিলা ঠাকুরের অমানুষ দেখছি। বাংলা ছবিই আমার ভালো হজম হয়।

সন্ধ্যাটা ছিল বেশ ভেজা, ঘুমুনোর জন্য আদর্শ। যেহেতু পড়তে বসতে হবে, আমি তাই বললাম, "চা খাবি?"
চায়ের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে দেখা গেল চিনি নেই। বললাম তবে গুড়ের চা হোক, গুড় তো আছেই। এরপর মনে পড়ল, দিন দুয়েক আগে চায়ের প্যাকেটটা আমিই শেষ করেছি। তাহলে? কফি হোক, অবশ্যই গুড়ের কফি। এবং এখন যদি ফ্রিজ থেকে দুধ (ফ্রিজে গরুর খাঁটি দুধ থাকে প্রায়ই) বের করে ভেজাই, সেটা গলতে বেশ সময় নেবে। শেষ পর্যন্ত  যেটা তৈরী হল, সেটা গুড়ের ব্ল্যাক কফি। কৌতুক করে বললাম, এর মধ্যে দু টুকরো আদা দিয়ে দিলে কেমন হয়?

জিনিসটা খেতে বিচ্ছিরি ছিল যদিও, তবে সেই কফিতে টোস্ট ভিজিয়ে খেয়ে ক্ষুধাটা তো কমল! কিন্তু ও কি চুমুকে শেষ করা যায়? বেসিনে ঢালতে হল অর্ধেকটা। শেষে মনে মনে নিজেকে গালি দিতে হল, শালা বাঙাল!

দুদিন পর নিউট্রিশন পরীক্ষা। জিনিসটা যতই কিউট হোকনা কেন, একটা বাচ্চার কোন মাসে কোন অঙ্গ তৈরী হয়, সেসময়ে কোন খাবারটা মাকে খেতে হবে, সেটা মুখস্থ করানো অত্যাচার। জিংক কিংবা সেলেনিয়াম কয় মিলিগ্রাম দিনে খেতে হবে, নইলে কোন কোন রোগ হতে পারে, সেটার আবার কেমন লক্ষণ দেখা যাবে, সেটা কতটা ভয়ঙ্কর, তা শুধু ডাক্তার আর নিউট্রিশনের লোকজন জানে। আর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের কত পার্সেন্ট শিশু স্টান্টেড ছিল, ২০০৪ থেকে সেটা কতটা উন্নত, সেই পরিসংখ্যান গ্রাফসহ মুখস্থ করা নিজেকে অত্যাচার করার শামিল।

উত্তম কুমারকে দেখে মনে হচ্ছিল, একদিন যদি এমন হয়, আমি কোথাও ক্লাস নিচ্ছি, সেই ঘরটায় একটা মানুষ ঢুকল, এবং আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমি কলমটা টেবিলে রেখে খানিকক্ষণ চুপ থেকে কাউকে ফিসফিসিয়ে বলব, এক কাপ চা হবে? এরপর নিজের কপাল রগড়ে অনেকটা শব্দ করে বললাম, "উইল ইউ প্লিজ গেট আউট?"

এটুকু পড়ে উচ্ছ্বাস নিশ্চয়ই বলবে, শালা আজকাল মালটাল বেশি খাচ্ছিস নাকি?

বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাকরি যাওয়ার পর


ছবিঃ pinterest থেকে সংগৃহীত মুক্ত ছবি

এক.
লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ এর মতন। ঠিকঠাক বোঝার উপায় নেই। মুখভর্তি ছেটে রাখা দাঁড়ি, পোড়া তামাটে রংয়ের চামড়ায় ঠিক থুতনির কাছে একটা গভীর দাগ। শুকনো মুখের সাথে ছোট ছোট চুলগুলো মলিনতা প্রকাশ করছে। তার নাম আবুল কালাম।

আজ তার পরনে আছে একটা কালো ফুলপ্যান্ট, লাল-কালো একটা শার্ট। বহু পুরনো শার্টটায় কিছু দাগ আছে, আর দুয়েক জায়গায় ছেঁড়াও আছে। তবে ছেড়া জায়গাগুলো তার স্ত্রী এমনভাবে কায়দা করে সেলাই করে দিয়েছে যে বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে শার্টটা শেষ কবে ইস্ত্রি করা হয়েছে, আদৌ কখনো করা হয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছেনা।

আজ তার চাকরি গেছে। সে ছিল 'দি নিউ বাইন্ডিং এজেন্সি' এর সেলস ম্যানেজার। এই প্রতিষ্ঠানে দুটিমাত্র পদ। ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সেলস ম্যানেজার। এর সঙ্গে একজন কুলি হল এখানকার সর্বমোট মানবসম্পদ। অফিসটা আরামবাগের একটা ঘুপচি গলির শেষমাথায়, ছোট্ট এক রুমের। দুই কোনে দুটি টেবিল, আর স্তুপ করে রাখা প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, ওষুধের বাক্স, মেমো। এই অফিসটাই একইসাথে এজেন্সির স্টোররুম। এজেন্সির ম্যানেজিং ডিরেক্টর শামসুদ্দিন মোল্লা একজন ভুঁড়িওয়ালা বেঁটে লোক। মাথায় টাক থাকলে তাকে ঠিক মানিয়ে যেত সিনেমার এমন চরিত্রের সঙ্গে। কিন্তু

শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

গল্প নামের অনেকগুলো গল্প

ঝাপসা হয়ে আসা দুঃখী বকুলেরা

এটা একটা গল্প। মহাজগতের দুধারে বাস করা দুটো মানুষের গল্প। বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর গল্পের মত হতে পারে। আবারো হতে পারে সফল অভ্যুত্থানে হটিয়ে দেয়া হয়েছে যে প্রেসিডেন্ডকে, তার নির্বাসিত জীবনের গল্পের মত, যেমনটা মার্কেজ লেখে। গল্পটার গল্পগুলো যেহেতু অকল্পনীয় রকমের অবাস্তব, তাই শুরু নেই, এবং শেষ নেই। আছে অনেকরকম মধ্যিখানের কথা। এই যেমন এক বিকেলে ময়লার ঝুড়িটার টুকরো কাগজে ভারী হবার মত একটা গল্প আছে। আবার আরেকটা গল্প আছে রেলের জানালার পাশে। ঝক-ঝক ঝক-ঝক শব্দসুরের ফাঁকে কেমন করে যেন সেসব তৈরী হয়ে গেছে। দুরুত্বটা যেহেতু বহু আলোকবর্ষ দূরের, তাই ভালোবাসা কখনো এধার থেকে ওধারে পৌঁছয় না। কে জানে, কোনপাশে ভালোবাসা তৈরী হয়না বলেই, কিংবা দুরুত্বটা বহু আলোকবর্ষ দূরের বলেই। দুধারের গল্পটাই শহুরে গল্প। তার মধ্যেও আধটুকরো গ্রামের সরলতা। অল্পখানি কল্পনার মিষ্টতা। বিন্দুখানি লেখনীর প্রাঞ্জলতাও যে নেই তেমন না। 

গল্পটায় ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারের নারিকেল গাছের কিছু স্মৃতি আছে। কপোত-কপোতির দুপুরের সূর্যস্নান নিয়েও অনেক কথা আছে। কে জানে! সবকিছু কেন যে কাগজে মুচড়ে ময়লার ঝুড়িতে করে শহরের প্রান্তে বিশাল কোন কাকের ভোজালয়ে বিরক্তির উদ্রেক করতে গিয়ে জোটে! গল্পটায় অনেক নিষ্ঠুরতা আছে। দুপাশের ভালোবাসা মাঝপথে গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলেও নিষ্ঠুরতাগুলো, দুঃখগুলো গিয়ে ঠিকই ছুঁয়ে আসে। কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিলো, তাঁর বহু বছর আগেকার এই গল্পগুলোও মনে পড়ে। সেবারের গল্প, যেবার জিপসিরা শীতের অনেক আগেই চলে এসেছিলো। বুড়ির ঝোলায় যে শামুকের মালাটা থাকে, সেখান থেকে টুপ করে পড়ে যাওয়া একটা গল্প সুড়সুড় করে এসে পড়েছিলো জগতের দু মাথার মানুষ দুটোর কাছে। দুজন দুজনকে ঘেন্না করতে করতে ভালোবেসেছিলো। সমুদ্রের এপার থেকে ওপারে সাতরে পার হয়ে যাওয়া একটা নারকেলের খোলসে আবছা কালিতে লেখা ছিল, বিপ্লব। 

পেন্সিল ব্যাগে জমে জমে থাকা বকুল ফুলগুলো যখন শুকিয়ে মলিন হয়েও সুগন্ধি ছড়াতে থাকে, তখন একটা মানুষের প্রয়োজন হয় বেদের তাগা। হাতে বাঁধবার পর সেটা আর বকুল ফুলের গল্প থাকেনা। একতোড়া কাগজের মধ্যে চাপা পড়া একটা বকুলের মালা হয়ে যায়। গেঁথে থাকা প্রত্যেকটা ফুল হয় বহু আলোকবর্ষ দূরের। তারচে পেন্সিল ব্যাগের প্রতিটা বকুলই হয় খুব আপন। দিন দিন নতুন বকুল আসে, যারা খুব শীঘ্রই মলিন হয়। 

গল্পটা এক কেরানির। দিনভর কাগজে কয়লার হিসেব লিখে যক্ষ্মার বসে যাওয়া কাশি নিয়ে সন্ধ্যেয় কুড়ের মেঝেতে গা এলিয়ে দিয়ে একটা প্রদীপ জ্বেলে বসে। সেই প্রদীপ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে এক ছনের ঘরের দরোজার ওপাশে আবছায়া প্রতিকৃতি তৈরী করতেই সে ঘরের মানুষটার দিনভর হরিণ ঘাস খাওয়াবার ক্লান্তি ছায়াটাকে আগুন করে ফেলে। সেই আগুন গ্রাস করে মাঠ, গাছ, মাকড়সার জাল, সেই জালের ভারটুকু বওয়া পাইন বৃক্ষ, আর জলের কূপ। হাওয়া হয়ে উড়ে যায় জল। সেই আগুন আরও সর্বগ্রাসী হয়। কিন্তু একটা বকুল গাছ, দেবদারু গাছকে চুমু খেতে খেতে ধীরে সুস্থে হেঁটে হেঁটে যায়। বহুদূরে যায়। এরপর হঠাৎ করে ছাই হয়ে যায়। বাতাসে ওড়ে। 

জার নামের বেড়ালটা মহান অক্টোবর বিপ্লবের একশটা বছর পরেও স্পষ্ট স্বরে বলে, ম্যাও!

মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

হঠাৎ একদিন নবাব বাড়িতে


ঢাকা কতটুকু? অদ্ভুত প্রশ্ন বটে। ঢাকা শহরটা অনেক বড়। এখন নদীর ওপারেও সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা কত বড় ছিল? বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা শহর। এবং তিন নেতার মাজারের সামনে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। বলায় ভুল হয়ে গেল। যেখানে ঢাকা শেষ হয়েছিল মোঘল আমলে, সেখানটায় গড়ে উঠেছে তিন নেতার মাজার। হু, সেই অযত্নে পড়ে থাকা ঢাকা গেট। যেটা থেকে বেরুলেই আমাদের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।

আজ আহসান মঞ্জিল যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সবার। একটা পরীক্ষাও ছিল। আমরা যখন দুষ্টরা আগে, ভদ্ররা পরে অডিটোরিয়ামে গিয়ে নিজেদের পছন্দমত জায়গা বেছে নিয়েছি, গম্ভীর মুখে উইকিপিডিয়া থেকে বন্ধন নিয়ে পড়াশুনা করছি, তখন মিলন এসে চেঁচাল, পরীক্ষাটা কাল লাঞ্চের পরে হবে। আমরা চিৎকার করলাম, কেউ হাতের নোট উপরে ছুঁড়ে দিলাম। হুরমুর করে বেরিয়ে উত্তেজিত স্বরে সবাই একসাথে কথা বলতে থাকল। সবাই একসাথে কথা বললে কিছু বোঝা যায়না। কিছুটা শান্ত হলে বোঝা গেল, সবাই আসলে আহসান মঞ্জিল যাবার কথা ভাবছে। শুধু ভাবছেই না, চেঁচিয়ে বলারও চেষ্টা করছে। ঠিক হল, সবাই যার যার মত প্রস্তুত হয়ে ঠিক বারোটায় চানখাঁরপুলে এসে দাঁড়াবে।

বাসার পথ ধরলাম। এসেই মাথায় হাত। ভুলে মেইন গেটের চাবিটা নেয়া হয়নি। সকালে যে ক্লাসে গিয়েই মীমকে বলেছিলাম, ছুটির সময় আমাকে যেন একটা চুলের ক্লিপ বা ওরকম কিছু দেয়, যেন সিসি ক্যামেরাকে আড়াল করে মেইন গেটের তালাটা সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুলে। সাততলায় চলে আসতে পারি। কিন্তু পরীক্ষার চাপে মীম ভালো করে বোঝেইনি আমি কী বলেছি। তো! দাঁড়িয়ে থাকতে হল অনেককাল। এরপর যখন একজন মহিলা বের হলেন বাড়ি থেকে, তখনই ঢোকা গেল। একটু বিশ্রাম করে ঝাল করে রাঁধা সাগরের মাছ দিয়ে পেটপুরে ভাত খেয়ে প্রবল ঘাম-বর্ষণ এর প্রস্ততিস্বরূপ সুগন্ধি স্প্রে কাপড়ে মেখে চললাম চানখাঁরপুলে। পথে অন্তরার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বারবার কল করেও যখন পাওয়া গেল না, বোঝা গেল সাজটা এখনো সে সেরে উঠতে পারেনি। মোড়ে গিয়ে দেখতে পেলাম, শ্রাবণ শ্রাবণের কড়া রোদে শরীরের সবটুকু জল পিঠের চামরার গ্রন্থি মারফত উগরে দিয়ে ভিজে চপচপে হয়ে রাগে মুখ লাল করে নিজের সাথেই গজরাচ্ছে। একটু আগে দোক্কা গাড়ী খুঁজতে গিয়ে সব ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখে গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এসেছে। ঘোড়ারা যে শুধু ঘাস খাচ্ছিল তা না, সহিস আর গাড়িগুলোও উধাও। এর মধ্যিখানে সবাইকে ফোন করতে করতে সে ক্লান্ত, এবং রাগে বিস্ফোরিত। আমি পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দিলাম,

বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭

জলমগ্ন

ছবিঃ সংগৃহীত

সরসর শব্দ তুলে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা। পেছন থেকে যে ছোকরাটা ভ্যানটাকে ঠেলছে, পানি তার কোমর ছুঁয়েছে। কোমরটা যে তার বেশ নিচুতে, তা মানতে অস্বস্তি নেই। হুঁ, আবদুল মিয়া যে খাটো, মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি, তা মানতে দোষ নেই। ভ্যান এক আজব বাহন এই শহরে। শীতের মরশুমে এরা লাগে বাড়ি পাল্টাতে, নতুন আসবাব ঘরে পৌঁছে দিতে। আর বর্ষার মরশুমে এরা জলের বাহন। জলের দু ধারে সারি সারি জেগে ওঠা ঘরবাড়িতে পৌঁছে দেয়া এই ভ্যানের কাজ। স্রোতহীন ঢেউ ওঠা শহরের রাস্তায় ছুটে বেড়ায় নানা কিসিমের বাহন। কোনটা যন্ত্রে চলে, কোনটা ঠেলে নিতে হয়। তবে সওয়ারির ভরসা যন্ত্রহীনগুলোতেই। সিএনজির গলুইয়ে পানি উঠে পরে, মাঝপথে সাপের মত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায়, তাতে কে বা উঠতে চায়? ভ্যান আর রিকশা, এই শহরের জলে-স্থলে ছুটে চলে অবিরাম। আর জল মাপার জন্য আজকাল কি আর সিন্দাবাদ আছে যে লগি ঠেলে চেঁচাবে, "এক বাও মেলেএএএ না, দেড় বাও মেলে না...!"

কেউ হোন্ডা, কেউ মাইক্রো নিয়ে নেমে পরে জলের একধার থেকে। কিন্তু এ সমুদ্রের ঠাই কোথায়, তার তো জানা নেই কারোই। একটু দূর যেতেই পানি উঠতে উঠতে যখন ইঞ্জিন ডোবে, তেলের ট্যাংক ছোঁয়, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে মেশিন নিশ্চুপ হয়, তখন চালকের দুঃসাহসী মন প্রথমবারের মত দমে যায়। মনে মনে ভাবে, মিসটেক হয়া গ্যালো। দূর স্বর্গলোক থেকে কবিগুরু ফিসফিস করে চালকের কানে কানে বলেন, জপো, এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা। কিন্তু চালকের মন বোঝে না। পরদিন সে অন্য রাস্তায় অন্য কোন খাদে পতিত হয়ে কবিগুরুর ফিসফিসানি শোনে। বছর ঘুরে আবার বর্ষা আসে, আবারও কবিগুরুর মন্ত্রধ্বনি কানে বাজে।

এ শহরের সবচেয়ে বিচক্ষণ সেই সব লোকজন, যারা বাসায় পৌঁছতে নেমে পড়েন গোড়ালিতক পানিতে, একটু পর সেটা বাড়ে। পথ এগিয়ে যায়, সেটা আরও বাড়ে। কারো বাড়ি পৌঁছতে সেটা হাঁটুজল হয়, কারো বাড়ির হদিস মেলে কোমরজলে। তাঁদেরকে যখন বাড়ির লোকজন উপহাস করে বলে, কয়টা টাকা বাঁচাতে এই এতখানি পানিতে নেমে পড়লি? মুখ গোমরা করে তারা উত্তর করে,

মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭

বৃষ্টি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। ঝিঁঝিঁ ডাকছে, ব্যাঙ ডাকছে, তবু সেটা নিস্তদ্ধতা ছিল। রাত্রির নিস্তদ্ধতা কোন নিশ্চুপ প্রকৃতিকে বোঝায় না। রাতের শব্দগুলো রাতের প্রাণ। এই নিস্তদ্ধতা কাটিয়ে দেয় বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি, কিংবা আলতো বৃষ্টি। বৃষ্টি আবার আলতো হয় কেমন করে, সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। বৃষ্টিও আলতো হয়। ঠিক ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নয়, কিন্তু জোরও নেই তেমন। আচ্ছা বৃষ্টি তবে কয় রকম? কঠিন প্রশ্ন। বৃষ্টির নানা রকমফের হয়। সেটা হয়তবা দর্শকের প্রাণের হাল হাকিকত দিয়ে ভাগ হতে পারে। যদিও বৃষ্টি শুধু দর্শন না, শ্রবণ, স্পর্শেও প্রবলভাবে সারা দেয়।

যখন বৃষ্টি শুরু হল, ব্যাঙদের আহ্লাদ বেড়ে গেল বহুগুন। স্বর প্রবল থেকে প্রবলতর হল। রাত্রির নিস্তদ্ধতা ঠিক তখনই ভেঙে পড়ল। তারমানে কি রাতের সাথে বৃষ্টির মিতালি নেই? আছে বৈকি! স্নিগ্ধতায় মিল আছে। প্রবল বৃষ্টি, আলতো বৃষ্টি সবই স্নিগ্ধ। আর রাত মানেই তো নিশ্চুপ স্নিগ্ধ একটা গল্প। ঝোড়ো বৃষ্টিও স্নিগ্ধ হয় বটে!

বৃষ্টি নিস্তদ্ধতা লুটে এত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তবে গ্লানির সাথে সখ্যতা গড়তে পারে না? বৃষ্টি, দুঃখ আর গ্লানিগুলোকে তুই নিবি?

শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

নরক যাত্রী



আমি একটা খুনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুনটা এ সপ্তাহে করার খুব ইচ্ছে। যে মানুষটাকে খুন করব, সে আমার বন্ধু, নাম সজল। আমরা ছোটবেলা থেকে এক পাড়ায় বড় হয়েছি। ওর বাবা এখন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। আমরা এক ব্যাটে ক্রিকেট খেলে, মারামারি করে, পালিয়ে ঘুরতে গিয়ে এতটা বড় হয়েছি। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হবার পর সব কেমন উল্টেপাল্টে গেল। আমি ইকোনমিক্স, সজল সোশায়োলজি। নির্বাচনের হৈচৈ শুরু হবার পর ওর পড়ায় মন উঠে গেল, আর বাবা রিটায়ার্ড করে ফেলায় পেনশনের টাকায় আমাদের চলছিল না, তাই আমাকে পরিশ্রম শুরু করতে হল। মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম, আর এখন আমি থার্ড ইয়ারে। এরমধ্যে দুবার ড্রপ দিয়ে সজল ফার্স্ট ইয়ারেই রয়ে গেছে। প্রথম ওকে বদলে যেতে দেখেছি নির্বাচনের আগের সপ্তাহে। এলাকার যেসব ছোকড়া এক প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়ালে দু ঘন্টা মিছিল কিংবা দু'শ পোস্টার মেরে আসত, তাদের সাথে ও দাঁড়িয়ে পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফুঁকছিল। আমরা যে আগে লুকিয়ে সিগারেট খাইনি, তা নয়। কিন্তু বড়রা হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, সবাই পাড়ার মুরুব্বি, তাঁদের সামনে! এবং একটু পর পাশের পাড়ার একটা মেয়ে যখন সাইকেল নিয়ে গেলো, তখন ওর সাথের পাঁচ-ছয়জন ছোকরা চেঁচিয়ে বাজে কথার ফুলঝুরি ছোটাতেই ও হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, এবং আমাকে দেখেই সজল হাঁক ছেড়েছিল, 'কিরে সাধুবাবা! হবে নাকি দুই টান?'

সেই থেকে ওকে ঐ দলেই দেখা যায়। অথচ একটা সময় আমাদের খুব কম্পিটিশন ছিল পড়াশুনায়। ওর সাথে বহু সিনেমা দেখতে গেছি, ওর পয়সায়। কিন্তু ওর বাবা মেয়র হবার পরে ওর সাথে তেমন কথাই হয়নি আর কখনো আমার। প্রথম দিকটায় দেখা হলে কুশল বিনিময়টা হত, পরে সেটাও বন্ধ হয়। আমি সরে আসি, তেমন না। ওরও আগ্রহ ছিল না আমার মত 'সাধুবাবা'র সাথে মেশার।

হঠাৎ করে খুন করবার প্রয়োজনটা হয়ে পড়েছে। বাবা রিটায়ার করার পর আমাকে টিউশনি করাতে হয়। আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে, নাম পড়শি। শুকনো পাতলা দেহ, লম্বাটে মুখের কোনে একটা বাঁকা হাসি, কাজলটানা চোখ, লম্বা চুল- এই হল পড়শি, যাকে দেখলেই আমার বুকের কোনে চিনচিনে ব্যাথা হয় কয়েক বছর ধরে। কিন্তু কিছু বলবার সাহস আমার নেই। এবার ইন্টারমিডিয়েট-এ ভর্তি হল ও। ওকেই পড়াচ্ছি। বাসার বাজার থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল, কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া, সবকিছু আমারই করতে হয়। বোনটাকে পড়ানোও একটা কাজ। এর মধ্যে নিজের পড়াশুনার চাপ তো আছেই। পড়শিকে পড়ানো আমার দিনের একমাত্র ভালো সময়। সপ্তাহে তিনদিন ওকে পড়াতে হয়। সন্ধ্যার পর যখন যাই, প্রতিবারই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পড়াতে গিয়ে আমি চুপ হয়ে যাই, একমনে চেয়ে থাকি। প্রতিবারই পড়শি হেসে বলে, চোখ গেলে দেব কিন্তু! পরের দিকে কোত্থেকে যেন একটা খেজুর কাঁটা এনে রেখে দিয়েছিল পড়ার টেবিলে।

দুই.
ছয়টায় আমি পড়াতে যাই, পড়শির কলেজ থেকে আসবার কথা এর অনেক আগেই। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম ও আসেনি। উদ্বিগ্ন হয়ে ওর মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর বাবা তখনো ফেরেননি অফিস থেকে। ব্যাংকের ছোট চাকরি তাঁর। আমি ভেতরে বসলাম। আমারও কিছুটা দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কাজের মেয়েটা বিস্কুট আর রং চা দিয়ে গেল। আমি একটু চুমুক দিয়ে রাখতেই পড়শির মায়ের হুংকার শুনতে পেলাম। প্রচণ্ড এক চড় কষিয়েছেন তিনি এক ঘন্টা দেরি করে আসা মেয়েকে। আমি ছুটে গেলাম সামনের ঘরে চাচিকে থামাতে। কিন্তু তিনিই তখন আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। পড়শির মুখ পাথরের মত শক্ত, ঠাণ্ডা চাহনি, ঠোটের কোনে হাসির বদলে জমাট রক্ত, চুল অবিন্যাস্ত, এবং একটু খুড়িয়ে ও দরজার দিকেই আসছিল। আমার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসল, পড়শি! একবার আমার চোখের দিকে তাকাল, শ্লেষমাখা সেই চাহনিতে আমার বুক কেঁপে উঠল। ঠিক আমার পাশে পৌঁছবার পর খুব আস্তে করে বলল, 'সজল'। এবং আমাকে পাশ কাটাবার পর আবার পেছনে তাকাল, 'আপনার বন্ধু'। এবারে স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখতে পেলাম সেই চোখে। এবং সেই মূহুর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুন করতে হবে আমাকে একটা। 

ওর বাবা যখন বাসায় এলেন, ততক্ষণে ওর মায়ের কান্না বন্ধ হয়েছে। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে। পড়শি বাড়ির পেছন দিকটায় একটা চেয়ার পেতে বসে আছে একলা। আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম চুপ করে। চাচা এলেন, জানলেন, এবং আমার হাত চেপে ধরে বললেন, 'বাবা! কাউকে বোলো না।' ফেরার আগে প্রচণ্ড আশঙ্কা নিয়ে গেলাম পড়শির কাছে। মাথায় হাত রাখতে গিয়েও পারলাম না। পেছন থেকে বললাম, 'কথা দাও, বেঁচে থাকবে।' আলতো করে মাথা নাড়ল ও। আমি অবাক হলাম, এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলাম।

কিন্তু পরদিন জানলাম, পাড়ার ছোকরারা সবাই জানে এই গল্প। তিনজন ছিল ওরা। মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে অনেকগুলো দোকান। এরপর একটা বাড়ির পেছন দিককার দেয়াল, এবং সেটার ওপাশে একটা স্টুডিও। এটার মালিক মেয়রের পরিবার। সজলের আড্ডা দেবার একটা জায়গা এই স্টুডিও। তার সামনে দিয়ে আসতে হয় পড়শিকে। 

পুলিশ কোন মামলা নিল না। অদ্ভুত অশ্লীল সব প্রশ্ন ছুড়ছিল ওসি আমার এবং ওর বাবার সামনেই পড়শিকে। মুখ শক্ত করে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল পড়শি। একটা সময়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওসি শব্দ করে হেসে ফেলল। লম্বা সে হাসি থামিয়ে সে বলল, এসব কিছুই হয়নি। শুধু শুধু তোমরা গল্প ফাঁদতেছ ক্যান

বোরকা পরা পড়শিকে নিয়ে আমরা যখন থানা থেকে বের হয়েছি, তখন ওর বাবা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। একটা কুকুর শুয়ে ছিল সামনে, আমি শরীরের সব শক্তি জুগিয়ে একটা লাথি কষালাম। আৎকে উঠে কুকুরটা লাফিয়ে সরে গেল। একটু দূরে যেয়েই ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কাছে আসবার সাহস নেই যেন। লাথি মারার সাথে সাথে পড়শি শুধু বলল, 'আকাশ ভাই!

আমার খুনের ইচ্ছা আরও প্রবল হল।

তিন.
আমি ঠিক করেছি খুনটা ওই স্টুডিওতে করব। স্টুডিওর লোক চলে যায় সন্ধ্যার সাথে সাথে। প্রায় দিনই ওখানে সজল বসে, আটটা বাজতে অন্য বন্ধুরা আসে। আমার সময় ছয়টা থেকে আটটা। আমাকে আসতে হবে উল্টো দিক দিয়ে। ওখানকার রাস্তায় আলো নেই। এসে সোজা স্টুডিওতে ঢুকতে হবে। খুনটা করে বেরিয়ে আসব। আমার কাছে বাজারের ব্যাগ থাকবে। সেটাতে না, ছুরিটা থাকবে আমার কোমরে। কাগজ পেঁচিয়ে। কোরবানির সময়ে এই ছুরিটা ব্যবহার হয়। বাসায় কেউ না থাকা অবস্থায় আমি শীল ঘষে ছুরিটা ধার দিয়েছি। ওটা আছে আমার বিছানার নিচে। 

বাজারের ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যায় বের হলাম। প্রায়ই আমি বাজারটা বিকেলে করি। পটল, ঝিঙে, পাঙ্গাশ মাছ কিনে ফেরার পথে আমি দেখেশুনে ঢুকে পড়লাম দি নিউ সুচিত্রা স্টুডিওতে। কেউ আমাকে দেখেনি, এবং সজল একলা ছিল এখানে। আমি বললাম, চার কপি পাসপোর্ট, এক্ষুনি দিতে পারবি?
ওর আধখাওয়া সিগারেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'ইকোনমিক্স ছেড়ে কেরানিগিরি ধরবি?'
'না। একটা সোশ্যাল সোসাইটিতে এপ্লাই করব' উত্তেজনা চেপে বললাম। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে যোগ করলাম, 'ভেতরে আয় তো!'
আমি ভেতরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে কোমর থেকে ছুরিটা বের করে পেঁচানো কাগজ ছাড়ালাম। সজল সামনে থেকে বলল, 'তোর সাজ হল?'
'হয়েছে'। গলার স্বর কেপে উঠল যেন একটু।

প্রথমে যখন ছুরিটা ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, মূহুর্তে ওর চোখ বিস্ফোরিত হল। সজল এর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওকে মারা হচ্ছে। এবং দ্বিতীয়বার ছুরি চালাবার আগেই আকুতি করে উঠল, 'জানে মারিস না ভাই'। ভাই ডাকটা যেন আমাকে থমকে দিল। ছেলেবেলায় ভাই পাতিয়েছিলাম আমরা। আমি হিংস্র স্বরে বললাম, 'পুলিশে সব স্বীকার করবি আজকেই?' হুমড়ি খেয়ে পরল ও কার্পেট বিছানো মেঝেতে। কার্পেট লাল হয়ে যাচ্ছিল রক্তে। আবারো কাতর স্বরে বলল, 'জানে মারিস না। তোর পায়ে পরি।' এরপর হড়বড় করে বলল, 'স্বীকার করব আমি। আজকেই স্বীকার করব সব!' একই কথা বারবার বলতে লাগল সজল। বাঁচবার প্রচণ্ড আকুতি শুনতে পেলাম আমি ওর কণ্ঠে। কিন্তু ও একজনের বাঁচবার সাধ নিয়ে খুব সহজে ফুর্তি করেছে, গত সপ্তাহে, এখানেই। 

হঠাৎ করে আমার সব উত্তেজনা পানি হয়ে গেল। কোমল স্বরে আমি বললাম, 'আমি যদি তোর একটা চোখ উপড়ে নেই?' ওর তখন তেমন হিতাহিত জ্ঞান নেই। কাতরে বলে উঠল, 'জানে মারিস না। দুইটা চোখ নে। জানে মারিস না। জানে...' আমার তেমন কানে ঢুকল না। আমি সত্যি ছুরিটা ওর একটা চোখে ঢুকিয়ে দিলাম।  শেষবারের মত 'জানে মারিস না' বলে ও জ্ঞান হারাল। দুটো ক্ষত করেছি আমি। একটা চোখ নষ্ট করেছি, আর পেট। তেমন কিছুই না, আমার মনে হল। এক্ষুনি ওকে হাসপাতালে নেয়া দরকার, মনে মনে ভাবলাম আমি। 

বের হবার আগে হাতের রগগুলো কেটে দিলাম। ওর দেহের শেষ ঝাঁকুনিটা দেখে আমি বুঝলাম, আমি একটা খুনি। 

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক


Copyright © 2015 Tony Fed


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। এটা শুধু যে সময় নষ্ট করে তা না। অভ্যাস, দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সক্রিয়তা অনেকটা কমিয়ে দেয়। সেজন্য আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই। সামাজিক যোগাযোগের অন্য অনেক সাইটেই একাউন্ট আছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের বাংলাদেশে তেমন কেউ চালায় না বলে তাতে এডিক্টেড হতে পারিনি। যখন সবাই সেগুলো (টুইটার, গুগল প্লাস এসব) চালাবে, তখন ছেড়ে দেব। 

একটা বন্ধু আমাকে বলত, তুই বড় নার্সিসিস্ট! সবসময় নিজের কথা শোনাতে চাস। সত্যি বটে। কিন্তু কেন এটা আমার কাছে কোন সমস্যা লাগে না, এবং নার্সিসিস্টই রয়ে গেছি, তার ব্যাখ্যা আমার আছে। তার আগে বলি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর কথা।

মানুষ নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে ভালোবাসে। সমাজবিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, মোটামুটি দিনের চল্লিশ শতাংশ কথা আমরা নিজেদের সম্বন্ধে বলি। এর কারণটাও মজার। ডোপামিন! আমরা জানি, সেক্স করবার সময়, চকলেট খাবার সময় এই হরমোনটা নিঃসরণ হয় বলে আমাদের তখন অত ভালো লাগে। নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলবার সময়ও মস্তিষ্কের ভালোলাগার কেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক সেক্সের মত! তাই এত আনন্দ!