শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

অভিমান



স্মৃতিসৌধের শেষ মাথায়, কয়টা পলাশ গাছ আছে। পলাশের বসন্ত ভালো লাগে। তাই হয়ত বসন্ত এলে রাস্তাটাকে সে চাদরে ঢেকে দেয়। লেকটা যেখানে ঘুরে গেছে, সেখানটায়ই গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বসন্তে এই এলাকাটা একদম কমলা হয়ে থাকে। সেই কমলা চাদরটার টানেই হয়ত প্রতি বসন্তে নিয়মিত এসে বসে থাকি জায়গাটায়। এবছর শুরুটাই করলাম শীতে।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। এপাশটা ভোর, সকাল, সন্ধ্যা; সবসময়েই নির্জন। হয়ত শুধু পলাশ ফুল না, নির্জনতাটাও আমাকে টানে। এক দিকে ফিরলে জল দেখতে পাব, সেখানে শাপলা কিংবা পদ্ম ভাসবে, অন্যদিকটায় ফিরলে ডাঙ্গা দেখতে হবে, তবে সে ডাঙ্গা ছেয়ে আছে পলাশে। তাই আমি লেককে উপেক্ষা করে অন্যপাশে ফিরে থাকি। আজও তেমনটা আছি।
যাবেন?
কোমল স্বরের একটা নারীকণ্ঠ। এক শব্দের বাক্যে মায়াবি একটা টান আছে। টানটা এত বেশি, অন্যমনস্কতা টুপ করে বলিয়ে বসতে পারে, যাব। আমি তবু তাকালাম।
একজন নিশিকন্যার যতটা সৌন্দর্য থাকে, মেয়েটার তারচেয়েও বেশি। অতিরিক্ত লিপস্টিক হয়ত পরিচয় ধরে রাখতে প্রয়োজন। তবে সেটাকে অপ্রয়োজনীয়ই লাগছে। মনে হচ্ছে লিপস্টিকটুকু, হালকা পাউডারটুকু না থাকলেই খুশি হতাম আমি। চুপ করে চেয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে অনেকটা সময়। আবার তাকালাম একটা পলাশ গাছের দিকে। মেয়েটার কমলা শাড়ীটাকে মনে হতে শুরু করল রাস্তায় ঢাকা ফুলের চাদরের অংশ। যে অংশে প্রকৃতির না, কোন পোশাককর্মীর ছোঁয়াটা প্রবল। এবং সেটায় কৃত্রিমতা ভরপুর।
 
মেয়েটা পাশে বসল। তখনই হালকা একটু বাতাস বইল।
কী দ্যাখেন? মেয়েটার কণ্ঠে সত্যিকারের কৌতুহল। আমি একটা জানা সত্যকে মিথ্যা জানলাম। নিশিকন্যাদের নাকি কৌতুহল এবং অভিমান থাকেনা। ঠিক তাই আমার জানতে ইচ্ছে হল, মেয়েটার কি অভিমানও আছে? মেয়েটা যখন পাশে বসল, তখনও আমি অবাক হইনি। তারমানে কি আমার কৌতুহলটুকু আমি মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছি? কেমন করে দিলাম? আমিতো ছুঁইনি ওকে। আমার অভিমানের ব্যাপারটা জানতে খুব ইচ্ছে হল।
গাছ দেখি চোখ ফেরালাম ওর দিকে, এবং যোগ করলাম, পলাশ গাছ
আপনে তো দ্যাখেন ফুল। গাছ না।
সত্যিই আমাকে এখানে টেনে এনেছে ফুল। গাছগুলো না। এই রুপবতী মেয়েটা আমাকে বলার আগ পর্যন্ত আমার কখনো মনেই হয়নি, গাছ দেখা আর ফুল দেখা আলাদা। আমি যখন শালবনে যাই, সেটা গাছ দেখতে যাওয়া। কিন্তু এখানটায় অবশ্যই ফুল দেখতে এসেছি। আমি আবার তাকালাম মেয়েটার দিকে। শুকনো পাতলা একটা মেয়ে। অপুষ্টি-অনাহারে মেয়েরা যেমন শুকনো হয় তেমন। আচ্ছা, মেয়েটার নাম কী? ওর বয়স কি ষোল? যে অসম্ভব সুন্দর, সেটা কি জানে? ওর সাথে যেতে হলে কতগুলো টাকা লাগবে? অনেকগুলো ভাবনা যেমন একসাথে এলো, তেমনি সবগুলোর উত্তরই অপ্রয়োজনীয় মনে হতে শুরু করল। অকস্মাৎ বলে বসলাম, হাত দেখাবা? আমি জ্যোতিষী
আমি কেন একথা বলে বসলাম, জানা নেই আমার। মেয়েটা অবাক হল না। কাস্টমার পাবার আনন্দে চোখ চকচকও করে উঠল না ওর। দুটি হাতই বাড়িয়ে দিল ও। আমি হাসলাম, বাম হাত। আর দশ টাকা লাগবে। মেয়েটাকে এবারে খানিকটা বিমর্ষ লাগল। অনেকটা করুণ আকুতির মত করে মেয়েটা বলল, পাঁচ টাকা আমি মাথা নাড়লাম, এবং বাঁ হাতটা তুলে নিলাম।
তুমি বাঁচবে একশ বছর হালকা স্বরে বললাম আমি। বুধের প্রভাব, শুক্রের প্রভাব বেশ প্রবল। অসুখে পড়ো বুঝি মাঝে মাঝে?
আচ্ছা মেয়ে, তোমার নাম কী?
শিউলি
আশপাশে অনেক পলাশ বলেই হয়ত নামটা শিউলি। এদের প্রতিদিন নাম বদলায়, কিন্তু কখনো খোলসে ঢোকে না। সবসময়েই এরা একইরকম সত্য।
মঙ্গলরেখায় ছেদ আছে। তারমানে কী জানো?
জানতে ইচ্ছা করে না মেয়েটা বলল ক্লান্ত কণ্ঠে।
উর্ধ্বরেখা শেষ মাথায় গিয়ে বেঁকে আছে। স্বাস্থ্যরেখায় ছেদ অনেকগুলো। এগুলোর মানেও নিশ্চয়ই মেয়েটার জানতে ইচ্ছে হবেনা।
আমার কোনদিন টাকা হবে?
নাহ!
মেয়েটা বোধহয় কেঁদে ফেলবে। বিশ্বাস করছে একজন ভুয়া জ্যোতিষীর সব কথা।
তোমার সবরকম ভাগ্য খারাপ। অসুখে পড়বে তুমি। কাউকে কখনো নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে না।
ভালো কিছু নাই?
কখনো কাউকে কষ্ট দিতে পারবে না হাতের দিকে আরেকটু ঝুঁকে উত্তর দিলাম।
এইডা ভালো? মেয়েটার কণ্ঠে হতাশা।  আর কিছু?
এই প্রশ্নে হাত ছেড়ে দিলাম। তাকালাম মায়াবী চোখ দুটোর দিকে।খুব ভালো একটা স্বামী পাবে তুমি
হাত না দেইখা কইলেন? ক্লান্ত স্বরে আরো খানিকটা ক্লান্তি যোগ হল।
চোখ দেখে বললাম
আমার চোখে বুঝি এইডা লেখা আছে?
উহু! আমার চোখে। গাঢ় কণ্ঠে বললাম।
অভিমানের ব্যাপারটা জানতে হয়ত শত বছর সময় জোগাড় করে নিতে ইচ্ছে হল।
শিউলি হাসল। আলতো করে। কমলা রঙের শাড়ির আঁচল দিয়ে লিপস্টিকটুকু মুছে নিল।

সাভার।
ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬।

1 টি মন্তব্য:

  1. এই গল্প লিখতে সাহস লাগে বটে!বুর্জোয়া সমাজের মুখে চপেটাঘাত হয়েছে।

    উত্তরমুছুন