শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

অবলা


-"এই যে শুনেন!"
রহিমউদ্দিন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গ্রামের ছোট্ট বাজারটায় তার একটা চায়ের দোকান আছে। টিনের ঘর, সামনে দুইটা বেঞ্চি পাতা। মহাজনেরা আড়ৎ বন্ধ করে এসে বসে আয়েশ করে লাল চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট খায় তার দোকানে। সেই টং খুলতে যাবার জন্য সকালে পান্তা খেয়ে বের হবার সময় তার বিবি মোসাম্মাৎ আয়েশা বেগমের কোমল কণ্ঠ। রহিমউদ্দিন তাকায়, বিরক্তিভরে।
-কও।
-বাজারে নতুন কাকরোল উঠছে, আমার জন্যে আনবেন একটু?
-মনে থাকলে আনমুনে।
বলেই বেরিয়ে যায় রহিমউদ্দিন। বউ তার পোয়াতি, আট মাস চলে।
ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছে করতেই পারে। মাংস কেনার কোন উপায় নাই, মাঝে মাঝে মাছ কেনে। বাড়িতে মুরগি ডিম দেয়, এইই ভালো খাবার। ছেলেমেয়ে কিছু নেই রহিমউদ্দিনের। একটা ছেলের খুব শখ, মেয়ে হলে নানান ঝামেলা। ছেলে গতর খাটিয়ে টাকা আয় করতে পারে, আর মেয়ে হলে ঘরে বসে খেয়ে খেয়ে বড় হবে, তারপর একদিন পরের বাড়ির বান্দি। তাতেও ঝামেলা, পণের টাকা জোগাড় করতে দেখা যাবে জমি বিক্রি করা লাগে। নামাজ রহিমউদ্দিন কোনকালেই পড়ে না। কিন্তু বিবির মুখে সুসংবাদ শুনেছিল যেদিন, সেদিন দৌড়ে গিয়েছিল মসজিদে। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তার আরজি জানিয়েছিল, কপালে যেন ছেলে জোটে।

দোকান খুলে সামনের জায়গাটা ঝাট দিয়ে চায়ের কেতলিতে পানি বসায় সে। গ্রামের মাতব্বর আবুল মিয়ার খাস লোক জালাল। লুঙ্গীর কোচা হাতে ধরে এসে বসে বলে, "দেও দিহি এক কাপ চা"! তারপর গল্প জুড়ে দেয়।
-যা গরম পরছে! চান্দি পাইক্কা যাইব।
-আর কইও না। চত্তির মাসের গরম! এট্টু বিষ্টি অইলেও কতা ছিল। গজব নামছে।
বলেই আবার চা বানানোতে মনযোগ দেয়। জালাল একটা কেকের পিস নিয়ে খেতে খেতে আবার বলে।
-ভাবিসাবের কী অবস্থা?
রহিমউদ্দিনের এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে। না বিবির ব্যাপার না, তার সন্তানের ব্যাপার। তার ধারনা আল্লাহ তার কথা রেখেছ। ছেলে হবে তার। মুখ হাসি হাসি করে বলে,
-আল্লায় রাখছে। এহন লাগে ভালো ভালো খাওন, কই পামু কও? আমরা গরীব মানুষ।
-চা তো ভালোই বেচো...
-এই গরমে মাইনষে চা খায় নাহি?

চুপচাপ চায়ে চুমুক দেয় জালাল। চা শেষ করে পয়সা শোধ করে উঠতে উঠতে বলে,
-তোমার জন্যে মায়া লাগে রহিমুদ্দি...
-ক্যা গো?
-মেম্বর সাব এইহানে তোমার তোমার জমির উপরে পাকা মার্কেট তুলব।
বলেই ঝট করে বেরিয়ে যায়। আর হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে রহিমউদ্দিন। ভিটেবাড়ি আর বাজারে এই দুইকাঠা জমি ছাড়া কিছু নেই তার। খাবে কী, বিবিকে খাওয়াবে কী, আর বাচ্চাটা? এই সময়ে এমন দুঃসংবাদ! পরের সময়টা তার খুব খারাপ যায়। মেম্বরকে চেনা আছে তার। দিলে মায়া-দয়া নেই লোকটার এক রত্তিও। চা তিতা করে ফেলে, আরেকবার ঢালতে গিয়ে হাতও খানিকটা পোড়ায়। একসময় ওঠে, বাড়িতে বাজার দিয়ে আসতে হবে। এখনো ঘরে রান্না করে তার বউ, আগামি সপ্তাহে শাশুড়িকে আনিয়ে নিবে এমন কথা আছে। তরকারির বাজারে ঢুকে নানারকম তরকারি দেখে। কাকরোল চোখে পড়ে। ঐ গ্রামের আহাম্মদ নিয়ে বসেছে একটা ঝুড়িতে।
-আছো কেমন?
-আছি। তরকারি লইবা?
-কাকরোল কত?
-আইজকা প্রথম তুললাম। এক্কেরে কচি। নেও।
বলেই সে মাপবার উপক্রম করে। রহিমউদ্দিন আবার জিজ্ঞেস করে,
-কত?
-পায়ত্রিশের নিচে ছাড়ি না। তুমি তিরিশ দিও।
-কও কী! তরকারির দাম তিরিশ অয় নাহি? বাপের জন্মেও তো হুনি নাই।
-এইটা কি তোমার বাপের জন্ম? তোমার জন্ম। বাজার ভালা না।

চুপ করে চলে আসে রহিমউদ্দিন। দশ টাকায় এক কেজি মূলা, আর পাঁচ টাকায় দুই মুঠ লাল শাক। এখন মূলার সময় না, তবু এই তরকারিটার দাম বাড়ে না কোনকালেই। বউ মূলা খেতে পারে না, প্রায়ই অভিযোগ করে, গন্ধ লাগে। কিন্তু আজ তার মন ভালো নেই। বউয়ের আবদার রক্ষা করে কী হবে? দুইদিন পর তো আর ভাত জুটবেনা জমি দখলে গেলে। মুখ কালো করে বাড়ি এসে ঢুকে। তার মাথা ঘুরছে। বিবি দৌড়ে আসে। বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঁকি মেরে দেখে মূলা আর শাক। কাকরোল নেই, নেই অন্য কিছুও। মুখ কালো করে বেশ তেজ নিয়ে বলে, "আফনেরে না কইছি কাকরোল আনতে? মূলা আমি খাই না।" মেজাজ চড়ে বসে রহিমউদ্দিনের। দৌড়ে এসে চুলের ঝুটি চেপে ধরে আয়েশা বেগমের।
কিন্তু পরমূহুর্তে মনে পড়ে, বউ তার পোয়াতি। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা রহিমউদ্দিনের অভ্যাস। বউ পেটানো তার একরকমের শখ। কিছু হোক না হোক, মাসে এক দুইবার সে পেটাবেই। ছেলের কথা মনে পড়ে তার। ছেড়ে দেয়, দেরগোড়ায় একদলা থুথু ফেলে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।  গত কয় মাসে সে একবারও গায়ে হাত তোলেনি, উল্টো ছোটখাটো সব আবদার পূরণ করে এসেছে। আজ হাত তুলতে গিয়েও ছেড়ে এসেছে।

দুইমাস পরে, আবুল মিয়ার বাড়িতে ডাক পড়ে রহিমউদ্দিনের। জালাল এসে ডেকে নিয়ে যায়।
-স্লামালিকুম মেম্বর সাব।
-কী আছো কেমন?
-আফনাগোর দোয়ায়...
সরাসরি আসল কথায় আসে মেম্বর। শীতল কণ্ঠে বলে,
-ভালোইতো মাইনষের জমিতে দোকান খুইলা বইছো। ঐটা আমার শালার জমি, ঐখানে মার্কেট তুলুম। এক সপ্তার মইধ্যে তোমার টং ভাইঙ্গা জমি ছাড়বা। নইলে কিন্তুক জেলের ভাত খাইবা।
বলেই উঠে ভেতরে চলে যায় আবুল মিয়া। কান্না পায় রহিমউদ্দিনের। বেরিয়ে আসে মেম্বরবাড়ি থাকে। দোকানে এসে দেখে তার জন্য অপেক্ষা করছে পাশের বাড়ির বুবু। মাথা নিচু করে বলে,
-রহিমুদ্দি, বাড়িত চল। তোর বউয়ে ঘাটলাত্তন পড়ছে।
-ব্যাথা পাইছে?
-প্যাডের বাচ্চা মইর‍্যা গ্যাছে।
আকাশ রহিমুদ্দির মাথায় কিছুক্ষণ আগেই ভেঙ্গে পরেছিল। এবার কেউ যেন চেলাকাঠ দিয়ে মাথায় বাড়ি মারল। তার বহুদিনের শখ একটা ছেলের, সেই ছেলে মরে গেছে। দৌড়ে আসে বাড়ি। বাড়িতে শাশুড়ি আর পাশের বাড়ির খালা। উঠানে আয়েশা বেগমকে শোয়ানো। জ্ঞান আছে, তবে শরীর রক্তে মাখামাখি। পাশে শোয়ানো অকাল-প্রসূত মৃত কন্যা।

মেয়ে দেখেই কিনা কে জানে, চেঁচিয়ে ওঠে রহিমউদ্দিন। এতদিন বউকে এত আদরযত্ন করেছে, একবার গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেনি, একটা ছেলের শখে।
"মাগি তোরে না কইছি ঘাটলাত যাইবি না! তোলা পানি ছিল না?"
হতভম্ব হয়ে তাকায় শাশুড়ি আর সবুরা বুবুর মা। উঠে এসে তাকে ধরতে যায় শাশুড়ি। তখনই সে এসে একটা লাথি মেরে বসে বউয়ের গায়ে।
"এদ্দিন ধইরা এই প্যাডে ধরছস? তাও মরছে। তুই মরস নাই ক্যা?"

মেয়ে পেটে ধরার অপরাধে কাতরাতে থাকে আয়েশা বেগম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন