সোমবার, ২ মে, ২০১৬

কুলাঙ্গার

বুড়োর নাম  তোরাব আলি। হাড় জিরজিরে, মাথায় কদম ছাট সফেদ চুল, থুতনিটা যেন দুপাশ থেকে চেপে বসেছে চোয়াল ঢেকে। চোখে সে তেজ নেই আর। নিমতলির একটা পুরনো যন্ত্রের দোকানে একের পর ইলক্ট্রনিক্স যন্ত্র ভেঙ্গে যাচ্ছে। সকাল নয়টায় বসে, একটানা রাত নয়টা পর্যন্ত চলে ও কাজ। কাজটা খুব সোজা। ঘড়ি, কম্পুটার, ভিসিআর, টিভি আর নানারকম যন্ত্রপাতি  কেজি দরে কিনে আনে দোকানের মালিক আকবর মিঞার ছোট শালা এহতেশাম। সেগুলো থেকে প্রয়োজনিয় জিনিস ভেঙ্গে বের করা। এই মহল্লায় এই কাজটা চলে বহুত। ঠুক ঠুক আওয়াজ শোনা যায় সকাল-সন্ধ্যা। একটু বিরাম নেই।  ১৭ বছর হল আকবর মিঞার এই দোকানে কাজ জুটেছে। ঈদ-মহররম ছাড়া তেমন দিন যায়নি অলস।

দেশ স্বাধিন হবার সময় বুড়োর বয়স আঠারো। না ঐ মিলিটারির জুলুমের কথা না, তারো আগে দেশ স্বাধিন হয়। সাহেবরা হঠাৎ একদিন সব গুটিয়ে নিজ মহলে ফেরে। ভারত ভেঙ্গে দু-টুকরো। পাকিস্তান নাম নেয় দেশ।
শুধু ভারতই ভাঙ্গে না, বাংলাদেশও আস্ত থাকে না। অর্ধেক পরে পাকিস্তানে, নাম জোটে পূর্ব পাকিস্তান। আর অর্ধেক ইন্ডিয়ায়, সেখানকার নাম পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমায় সব হিন্দুরা। বিশাল বিশাল বাড়িগুলো জলের দরে বেচে যায় অনেকে, অনেকে আস্ত বাড়িটা ফেলে যায় এদেশে। সেই বাড়িগুলো জোটে সব প্রভাবশালী পঞ্চায়েত কমিটির লোকদের। তোরাব আলির বাপ তখন ছোট একটা মুদি দোকান দেয়। নিজেদের ছোট্ট একটা দ্বিতল বাড়ি। দাদার আমলের ভাঙ্গাচোরা সে বাড়িটা আজও টিকে আছে। সেই বাড়িতে একলা থাকে তোরাব আলি। সকালে হোটেলের পরোটা-ডাল, দুপুরে এক তরকারির সাথে ভাত, সেটাও হোটেলের। দুপুরের খাবার হোটেল থেকে দিয়ে যায় দোকানে। তিন কর্মচারি ভাঙ্গার কাজ করে, গামছা পেতে দোকানের ঝাপ অর্ধেক নামিয়ে পেটে কোনমতে নামায় ঠান্ডা সে ভাত। পানিটাও আজকাল সয়না। এ দেশের পানিটা যেন পানি না, কলকারখানার বর্জ্য। ফুটানোর পরেও গন্ধ বেরোয় ব্লিচিং পাউডারের। রাতের ভাতটা নিজে রেঁধে খায় বুড়ো। কখনো ডিম ভাজা, সাথে দোকান থেকে পলিথিনে করে আনা পাতলা ডাল। কখনো আবার এক পোয়া মাছও কিনে আনে। বিকালে যা মেলে আনন্দবাজারে। পরদিন সকালেও তখন সে মাছ আর ভাত খেয়ে কাজে যাওয়া যায়।

পাঠশালা আর ইশকুলের পাঠ তেমন মগজে ঢোকেনি বুড়োর। মার্বেল খেলে আর টো টো করে এপাড়া-ওপাড়া করে বেরিয়েছে ছেলেবেলায়। বাবার পিটুনি রোজ রোজ জুটত। একটা ভাই ছিল দুই বছরের বড়, সে মরে যায় একদিন রেলে কাটা পরে। বাপের অসুখে তের বছর বয়সে মুদি দোকানে বসতে শুরু করে তোরাব আলি। সতেরতে গিয়ে সব খুইয়ে দেনা মেটাতে দোকানটা বেচে দিতে হয়। তারপর কখনো কুলি, কখনো মজুর, কখনো ইষ্টিমারে টিকেট কাটার কাজ। এ জীবনে সফল না বুড়ো কোনকালেই। সেই যে বাপ অসুখে পড়ল, তারপরে আর টাকাপয়সার অভাব মেটেনি। দিন যায়, বছর যায় টাকার অভাব কি আর মেটে?

জীবনের সব দুঃখ টাকার না, আরো দুঃখ থাকে। তবে সেসব মনে হয় টেনে আনে ঐ টাকাই। বিয়ে করেছিল ত্রিশ বছর বয়সে। তখন মা-বাপ দুজনেই ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। ইষ্টিমারে টিকেট বাবুর চাকরি ছিল তখন। বেশ কেটে যেত দিনকাল। কাকার বাড়ির পাশের বাড়িটায় ছিল একটা মেয়ে। পাড়া জুড়ে ঘুরে বেড়ায়, এই সেইদিনও ফ্রক পরে ঘুরত, আজ শাড়ির ঘোমটা টেনে বউ হয়ে এল একলা তোরাব আলির সংসারে। পরি বেগমের বাপ বিয়ের সময় তেমন কিছু দেয় না, অথচ জামাইকে কিছু তোহফা না দিলে সংসার সুখের হয়না। সুখের হয়নি তোরাব আলির সংসারও। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বউয়ের ওপর চড়াও না হলে সারাদিন খেটে আনা টাকা, যা দিয়ে বউয়েরও ভরণ-পোষণ চলে, তা বোধহয় উসুল হত না। দুইটা ছেলে হয় বিয়ের পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে। সাকিব আর জহির নাম রাখা হয়। প্রাইমারি ইশকুলে মাষ্টারের বেতের বাড়ি পড়াশুনার সাধ মিটিয়ে দেয়।

বাপের সংসারে কুলাঙ্গার সাকিব আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করে একদিন ঘরে এসে ওঠে। ঝেটিয়ে বিদায় করা হয় বউসুদ্ধ। পরি বেগমের আপত্তি আর সুর করে কান্নাকাটি ধোপে টেকে না। পাশের পাড়ায় বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করে। মেসিয়ারের কাজ করে হোটেলে। ছোট ছেলেটাও বেশ কর্মঠ হয়ে পরে বাপের ভয়ে। জোগালি দেয় এক রাজমিস্ত্রির দলে। মাথায় করে সিমেন্ট গোলা টেনে কাটিয়ে দেয় ছয়টা বছর। তারপরে একদিন তোরাব আলিই তোলে বিয়ের কথা। বউও আসে ঘরে। পরি বেগমের কপাল খোলে, বান্দির জীবন থেকে এসে বসে শাশুরি নামের এক আসনে। বউকে কাজ হলেও গালি দেয়া যায়, কাজ না হলেও গালি দেয়া যায়। পরি বেগমের তেজে তোরাব আলিও চুপসে যেতে শুরু করে। কথায় কথায় চুল ধরে টেনে দেয়া দূরে থাক, ফট করে দুটা কথা বলার সাহসও থাকেনা আর।

সাকিব প্রায়ই সামনে পরে যেত বাপের, কিন্তু যমের ভয় পায় সে বাপকে। টুপ করে সরে পড়াটা তাই একমাত্র কাজ ছিল তার। জহির বিয়ে করার দুই বছর পর এই বাড়িতে আবারো জায়গা হয় বড় ছেলের। বাড়ির যে জিরজিরে অবস্থা, তাতে নীচতলায় কবুতর পালা ছাড়া কিছু করার নেই। ওপরতলার তিন ঘরের দুই ঘর দুই ছেলের। আর কোনার ঘরটা তোরাব আলি আর কর্ত্রী থাকে। খাচায় কবুতর পালা, বাচ্চা ফুটিয়ে বেচার কাজটা দেখাশুনার কাজ পরে দুই ছেলের বউয়ের। সারাদিন ঘর আর কইতর সামলাতেই তারা ব্যাস্ত। এর মাঝখানে সাকিবের এক ছেলে হয়, খরচ বাড়ে। ভাগ্যদেবতাও একটু রসিকতা করে। হোটেলের কাজটা চলে যায় ছেলের। বেকার ছেলে এ ধান্দা ও ধান্দা করে চেষ্টা করে কিছু জুটানোর। কিন্তু পেট জুটেনা কিছুতেই। এরপর হঠাৎ পেয়ে বসে দালালির কাজ। আশেপাশে প্রচুর নকল পণ্য তৈরী হয়। ঢাকা শহরের এদিক-ওদিক, এবং ঢাকার বাইরেও শহর-উপশহরে পার্টি খুঁজে বের করা। পার্টি বলতে মুদি দোকানদার, আড়তদার, আর হোলসেল ব্যাবসায়ী। সেই টাকা আসার শুরু এ পরিবারে।

সুখ টেকেনা তোরাব আলির। ছেলে জুদা হয়, চকের ঐপাশে ওয়াটার ওয়ার্কস রোডে বাসা ভাড়া নেয়। বাপের খোঁজ নেয়া আর হয়ে ওঠেনা। একদিন দুদিন করে দুরুত্ব বাড়ে। ছোট ছেলেটা কাজ পায় ইউনিলিভারের কারখানায়। গাজিপুরে বউ নিয়ে চলে যায়। ইষ্টিমারের টিকেট কাটার চাকরি গেছে বহু বছর আগে, মাঝে কয়দিন পাইকারি খেলনার দোকানে বসেছে। তারপরে এই পুরান ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে কাজ দেয় আকবর মিঞা। পরি বেগম অসুখে পরে। সাকিবের কাছে হাত পাততে হয়। সে ছেলে না যেন মহাজন। দালালি করতে পান চিবুতে হয়, এটা যেন নিয়ম। পান চিবুতে চিবুতে বাপকে বলে, দিন খারাপ, কী দিমু কও? দেয় সে, একমাসের ওষুধ কেনার টাকাটা শেষে দেয়। তবে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা, রোগি আর কদ্দিন টেকে? একমাসের ওষুধ শেষ হবার সাতদিন বাদে খোদার দরবারে হাজির হয় পরি বেগম। একমাস মাকে বাঁচিয়ে রাখার গর্ব নিয়ে সাকিব আসে, নিজ পয়সায় মার্কিন কাফনের কাপড়, আগরবাত্তি আর গোলাপজল কেনে। পুরনো ভাঙ্গা দালান ভুঁরভুঁর করে গোলাপজলের গন্ধে। দাফন হয়, গোলাপজলের গন্ধ শুকাবার সাথে সাথে  বুড়োর 'বুড়ো জীবন' শুরু হয়। সাকিবের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়না কখনো এ পাড়ায়। প্রতিদিন ঠুক ঠুক, ঠুক ঠুক করে ছোট এক হাতুড়ি আর স্ক্রু ড্রাইভারে যন্ত্র ভেঙ্গে যায় বুড়ো। আর ছোট ছেলে এ বাড়ি আসেনি অনেকদিন, মা মরার খবরটাও জানেনা। বুড়ো বেশ বোঝে, টাকাপয়সা তবে কিছু হয়েছে ছেলের। নইলে মাঝে মাঝে মা-বাপের খোঁজটা নিত ঠিক।

সুখ জিনিসটা কী, আজও জানেনা বুড়ো। এই হাজারটা বুড়ো যেমন করে ছেলে থেকে বুড়ো হয়েছে, সংসার টেনেছে, আর একদিন টুপ করে মরে গেছে, সেরকম জীবন কাটিয়েছে বুড়ো। উত্থান-পতন বুড়োর জীবনে নেই। বাপে একবার অসুখে পরল, সেই যে একটা পতন হল, সেই চালেই চলছে জীবন। একটানা প্রতিটা দিন খেটে যাওয়া, জগৎ সংসার সামলানো। এই একটা জীবন।

শরীর টেকেনা আজকাল। ভাঙ্গা বাড়িতে রোজ শুয়ে মনে হয়, একটা দেখার মানুষ যদি থাকত! বুড়িটা বেঁচে থাকলে হত। অথচ সে বুড়ি হবার আগেই জগৎ ছাড়ল। সাকিবের ঘরে তিনটা নাতি-নাতনি আছে। তবে তাদের দেখা পাওয়া সোজা না। দূর দূর করে তাড়াতে না পারলেও বড় ছেলের বাড়িতে সমাদর জোটে না। তাই বহুদিনে একটাবারও ওমুখো হতে ইচ্ছা হয়না তার। হোটেলের ডাল খেয়ে আরো থুত্থুরে হচ্ছে বৃদ্ধ তোরাব আলি। কিন্তু খাওয়ায় কে আর? প্রতিদিন কাজে যেতে হয় সকাল সকাল।

একদিন দুপুরে ছেলে সাকিবের চকের বিশাল দোকানটায় যায়। এবার আর পারা যায়না ঠুকঠুক করে যন্ত্র ভাঙ্গা। হাত অসাড় হয়ে আসে তাতে। ক্ষান্ত দিতে পারলে হত। দুবেলা আহারের ব্যাবস্থাটা যদি করে পোলায়, তবেই বেঁচে যায়। কাজ ফেলে তাই হেঁটে হেঁটে চকবাজার। লুঙ্গী আর সাদা ফতুয়া পরা সাকিবের ভুঁড়িটা স্পষ্ট। কোথায় কোন মাল আছে, দোকানে কাজ করে, আবদুল ছোকড়াকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর সেগুলো নামিয়ে নামিয়ে গুনে গুনে বাঁধছে আবদুল। পান চিবুতে চিবুতে বাপের দিকে তাকায় সাকিব। নাতি নাতনির খোঁজ ছেলের কাছে জানতে চাইলে ছেলের বিরক্তি বাড়ে, তাই আজকাল আর জিজ্ঞেস করেনা ওদের কথা। এসে বসে দোকানে। শরীরের কথা বলে একটু। তারপর বলে,
-আর পারিনারে বাপজান!  এইবার তুই আমার একটা ব্যাবস্থা কররে! হাত ভাইঙ্গা আহে ঐ কামে। তোরতো হইছে কিছু।
বাপের জন্য মনে হয় একটু মায়াই জাগে ছেলের। হাজার হোক, বাপইতো। কিন্তু বসে বসে তো খাওয়ানো যায়না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে তবে। একটু কী ভেবে বলে,
-আমার দোকানে কাম লইবা? এই কী মাল লাগব, কুনহানে কোন মাল আছে, তা দ্যাহা খালি কাম! বইয়া বইয়া পান চিবাইন্না। ঐ কাম করবার মানুষ লাগে না, তাও তোমার লাইগা...

বুড়ো কী যেন ভাবে। ঘোলা চোখে। তারপরে ক্ষীন স্বরে বলে,
-লমু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন