সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

গাউন





এক.
মধুর ক্যান্টিনে চা ফুঁকছি। একলা বসে, অসময়ে। ব্যাপারটা সিগারেটের মত, ক্যাফেইন নেবার পদ্ধতি, তবে এতে ফুসফুসের জোরে কিছু বাতাস বের করে দেয়া হয়, চা কে ঠাণ্ডা করতে। বসেছি কাউন্টারের সামনের টেবিলটায়, ভিড়ভাট্টা নেই একদম। আমার চোখ বারবার যাচ্ছে ঐ ওপাশের টেবিলটাতে, যেখানটায় একটা মেয়ে বসে আছে। কিছু খাচ্ছিল হয়তবা, কিংবা কারো জন্য অপক্ষা করছে। হয়তবা বেকার সময়ই কাটাচ্ছে। আমার শেষটা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে। কারন ফুটফুটে চেহারার মেয়েটাও বেশ কবার চেয়েছে এদিকটায়। আমি চা শেষ করলাম, এবং আর এক কাপ চা নিলাম। ফ্রয়েড ভক্তরা এর একরকম ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু আমার চায়ের নেশা, তাই তৃতীয় কাপ।

চা শেষ করে আমি বিল মিটিয়ে সোজা হেঁটে গেলাম সেই টেবিলটায়। বললাম, তুমি কি জানো, বিল ক্লিনটন ঠিক এ পরিস্থিতিতে কী বলেছিলেন?
মিষ্টি করে মেয়েটা হাসল, আলতো করে মাথা নাড়ল। বলল, লিভিং হিস্ট্রি-র গপ্পো।
আবারো বলল, আমি অরুণা।
আমি কশ্যপ।
এবারে শব্দ করে হাসল অরুণা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সত্যিকারের নামটা জানতে। বললাম, আমি রাহি।
-ফাইন আর্টস, ফার্স্ট ইয়ার।
-ফিজিক্স, ফার্স্ট ইয়ার।
আমি ফিজিক্সের ছাত্র হয়ে কক্ষনো অধিকার রাখি না মায়াবতি এক ফাইন আর্টসের ছাত্রীর দিকে তাকাতে। পুরো ক্যাম্পাসের বহু সিনিয়রের চোখ সবসময় চোরা দৃষ্টি ফেলে এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি। তবু আমি হেসে বলি, আমরা বের হতে পারি। কল্পনার মত সুন্দর করে মাথা নাড়ে অরুণা। আমরা বের হই মধু থেকে।

-একলা চুপচাপ বসে ছিলে যে? অপেক্ষা?

বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

চোখ যখন নিরুপায়

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেই। হাতে নিয়ে হাঁটি। নইলে দূরে বসে থাকা কোন সুন্দরীর পানে চোখ আটকে যায়। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেও যখন চোখ ফেরাতে পারি না, ঠিক তখনই চশমাটা খুলে নেই। নিজেকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি  মুক্তি নেই।
ব্যপারটা প্রায়ই ঘটছে আজকাল। কোন বান্ধবীকে পছন্দ, চোখ আটকে যাবে। দূরে কাউকে দেখেও চোখ আটকে যাবে। নৈতিকতার অবক্ষয়, নাকি হৃদয়ের কল্পলোকের পরিস্ফুটন? হয়তবা বিস্ফোরণ।

আমি সবসময়ে আমি হতে চেয়েছি। এলো চুল আমার পছন্দের। কাঁধে শাল ঝুলিয়ে হাঁটতে আমার বেশ লাগে। চশমার কাচ ঘোলা হয়ে আসে প্রায়ই, অযত্নে। সেসবে ঢের আপত্তি সবের। প্রেমের জন্য চিঠি লিখতে জানা আমার কাছে আধুনিকতা, সবের কাছে মধ্যযুগীয় ভাবনা। আমার আমি হওয়ায় মানুষের যত আপত্তি আছে, সেগুলোকে আমি প্রায়ই থোড়াই কেয়ার করি। কিন্তু সবসময়ে পারি না।

আহমাদ বলে, মেয়েমানুষ দুরকমের। মায়ের জাত, আর প্রেমিকার জাত। চেনার সরল উপায় হল, প্রেমিকার জাতে বড় চুল ভালোবাসে। আর মায়ের জাতের কাছে বড় চুল অসহ্য, চক্ষুশূল।  আমি ক্লাসের শুরুর দিনগুলোতেই ভাগ দুটো ঠিক ঠিক করে ফেলেছিলাম। কারণ তখন আমার চুলগুলো ছিল ঝাঁকড়া এবং দীর্ঘ। কাঁধে শাল চড়িয়ে ক্লাসে যাই, বসি সবার সামনে। একদিন একজন শিক্ষিকা, যিনি একজন মাও বটে, বললেন ওসব চলবে না। আমার বান্ধবীদের মাতৃত্ববোধ বেরিয়ে এল। ওরা বলল, তোমাকে শাল ছাড়তে হবে, চুল কাটতে হবে। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে চলল, তুমি কেন এমন থাকো? আমি তখন আশেপাশে তাকিয়ে অসহায়ের মত করে মাথা নাড়লাম। আমার নিষ্ঠুর ছেলে বন্ধুগুলো আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। কান্না কান্না চোখে ভাবছি, এরা সবে কি মায়ের জাত? যেমন ছিল ঈশিতা আর রূপা। তখন দেহে প্রাণ ফিরে আসে। মীম বলে, ছেড়ে দে না ওকে। ও যেমন থাকতে চায় তেমনই থাকুক। আমি মীমের প্রতি প্রাণ ভরা কৃতজ্ঞতা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।

এবং বিকেলে আমাদের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুরপাড়ের সেলুনে গিয়ে বলি, চুলগুলো একদম ছোট করে ফেলুন। বেরিয়ে আসতে সোহাগ, শান্ত, আসাদুজ্জামান বলে, এবার একদম ঠিক আছে। আমার ইচ্ছে করে ওদের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলি। পরদিন ক্লাসে যাই গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে।

রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আনন্দভ্রমণে

 দূর-দূরান্তে ঘুরবার আগ্রহ আমার বহুকালের। কখনো একলা ঘুরতে ভালো লাগে, কখনোবা অনেকের সাথে। শুধু দূরে নয়, দিনভর আশেপাশে কাজে-অকাজে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটাও আমার খুব বেশি। কম খাওয়া, না খাওয়া আমার প্রায় শূন্য ওজনের একটা কারন হতে পারে, তবে অন্য কারণটা হল দিনভর ছুটে বেড়ানো। যা খাই, তার অনেকটা দখল করে নেয় আমার ভ্রমণপিয়াসু কর্মকান্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যায়ন এর শুরু ২০১৭ সালের শুরুতে। আর জানুয়ারিতেই একটা পিকনিক পেয়ে যাওয়া রীতিমত অভাবনীয়। অল্প কয়জনের দেখলাম আগ্রহ নেই এটা নিয়ে তেমন। বাকিরা সবাই মুখিয়ে থাকলাম পিকনিকের তারিখের জন্য। উপরি পাওনা দুদিনের ছুটির ব্যপারটাও মাথায় ছিল সবার। এবং এজন্য যে অতি অপ্রিয় দুটি ক্লাস মিস হবে, সে আনন্দও সচেতনভাবে পাচ্ছিলাম।

আমরা প্রায়ই টিএসসিতে বসি আড্ডা দিতে। সে আড্ডা কখনো বারান্দায় পা বিছিয়ে, কখনো ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে গোল হয়ে, কখনো বাইরের পার্কিং লটে, কিংবা ভেতরের লনে বসে। সে আড্ডায় সব বিষয়কে ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আসে বন্ধুকে রসাত্মক আক্রমণ। সে আক্রমণের বিষয়বস্তুগুলো সবসময়েই হয় নির্মম, এবং কখনোবা ছাপার অযোগ্য। এছাড়া পড়াশুনার কথা, বইয়ের কথাও কখনো ঘুরেফিরে উঁকি দেয় আমাদের আড্ডায়। সে আড্ডার প্রতিটা মূহুর্ত সবার জন্য আনন্দ উদ্দীপক। আমরা পিকনিকের জন্য মুখিয়ে ছিলাম, হয়তবা পিকনিকে এই আড্ডার আনন্দের বিস্ফোরিত রূপ কপালে জুটবে বলে।

দিনটি ছিল ২৩ জানুয়ারি, প্রথম বর্ষের ছেলেপুলেকে আসতে বলা হয়েছে ভোরবেলাতেই। আমাদের সেসবের বুঝি তেমন তোয়াক্কা ছিল না। হেলেদুলে দুজন, চারজন করে এসে জড়ো হতে লাগল অনেকটা সময়। এসেছেন শিক্ষকেরা, বড়রাও। সবাই মিলে বাসে ওঠার আগে বাধ্যতামূলক ফটোসেশন। অবশ্য সেটাকে সেলফি সেশন বললে তেমন অপরাধ হবে না। এর ফাঁকে পিলো পাসিং খেলার জন্য আনা বালিশটা ধার করে আমি আমাদের ভবনের নিচতলার ওয়েটিং বেঞ্চিতে ঘুমাবার আয়োজন খুঁজি। কিন্তু শোয়ার একটু পরেই এক বেরসিক ছেলে এসে জানায়, বালিশটা এক বড় আপুর বাসা থেকে আনা। কোথায় কী! আমি বালিশ নিয়ে ভো দৌঁড়। রিংকিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলি, আমি ভেবেছি বালিশটা তোর। এরপরে সবাই মিলে সেলফি তুলতে শুরু। মেয়েদের কেউ শাড়ি না পরায় আমিও পাঞ্জাবি পরিনি। তবে আয়াত সেসবের তোয়াক্কা না করে ঝলমলে পাঞ্জাবি গায়ে হাজির। তখন মনে হল, আমি কী দোষ করেছিলামরে বাবা!

সেলফিতে মেয়েরা দেখা দেয় শহরের সকল আটা-ময়দার সংগ্রহ নিয়ে। আর আমরা প্রায় সবাইই এলোমেলো সেই ভঙ্গিতে। মিলনের ব্যাগ থেকে বেরোয় সেলফি-স্টিক নামের অতি অদ্ভুত এক উদ্ভাবন।