বুধবার, ২০ জুলাই, ২০১৬

চিরন্তন



শুরুর আগে

কাল সিঁড়ি দিয়ে শব্দ তুলে উঠছিলাম, দোতলার দরজা খুলে গেল। অন্তরা বলল, একটু দাঁড়ান। একটা লাল রঙয়ের ডায়েরি এনে বলল, আপনার ব্লগে দিবেন। আমি ডায়েরিটা নিয়ে উপরে চলে এলাম। এক বসায় ওর এই দেড় মাসের স্মৃতিকথা পড়লাম। আমরা এই বাড়িতে ওঠার পর থেকে ওর সাথে প্রেম হওয়া পর্যন্ত। কোথাও কোথাও অনেক কাটাকাটি করা হয়েছে, কোন পৃষ্ঠা একদম নতুন করে লেখা হয়েছে। লেখার ধাঁচটা অনেকটা আমার মত। সন্ধ্যায় ক্লাশ করে এসে ডায়েরিটা পেয়েছি। রাতে পড়া ছিল, তাই আজ দুপুরে সবটা টাইপ করলাম। চিরন্তন শব্দটার ফরাসি অর্থ হল 'ন হন্যতে'। ডায়েরির প্রথম পাতার ওপরে ফরাসি শব্দ দুটো অন্তরাই লিখেছে
ওর বাবা-মা এই লেখা পড়বেন। আপনাদের মেয়ে অকালপক্ক হবার পেছনে আমার দায়টুকু স্বীকার করছি, এবং দেবতাসম মানুষ দুজনের কাছে ক্ষমা চাইছি। আজ থেকে দোতলা থেকে উঠবার সময় লজ্জায় হয়ত প্রার্থনা করতে করতে উঠব, আপনাদের সামনে যেন না পড়তে হয়। 
সপ্তাহখানেক বয়স হয়েছে যে প্রেমেরে, সে প্রেমে সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত কোনটা? অন্তরা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "আপনি এমন বিশ্রী করে শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠেন কেন?"
ওমর ফারুক
২০ জুলাই ২০১৬।

এক.
আমাদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। সাততলা দুমাস ধরে খালি ছিল, সেখানে। আসলে বাড়িটা আমাদের না। আমরাও এ বাড়িতে ভাড়াটিয়া। আমার নাম অন্তরা, ক্লাস সেভেনে পড়ি আজিমপুর ইশকুলে। নাজিমউদ্দিন রোড জায়গাটা পুরান ঢাকা হয়েও সেরকম ঘিঞ্জি না। যেন পুরান ঢাকার উপনিবেশ। তবে বাড়িগুলো খুব কাছাকাছি, ছোট ছোট। আমার বাবা ঢাকা কলেজে বাংলা পড়ান। মা যায়যায়দিন পত্রিকার ফিচার 'নন্দিনী'তে কাজ করেন। আমরা থাকি দোতলায়। বাড়িটা সাততলা। গত দুটি মাসেরই এক তারিখ আমি অপেক্ষা করেছি, নতুন কেউ আসছে কিনা এ বাড়িতে। আসেনি। কিন্তু আজ এল। যখন জিনিসপত্র নিয়ে বিস্তর টানাটানি চলছে, তখন বোঝার উপায় নেই কারা আসল ভাড়াটিয়া। তাই সব শান্ত হওয়ার অপেক্ষা করি। এ বাড়িতে আমার বয়সী কিংবা আমার বন্ধু কেউ নেই। তাই আমার এত আগ্রহ আগন্তুক পরিবারের প্রতি। যেহেতু আমি কোন প্রাইভেট পড়ি না, তাই আমার বাইরে যাওয়ার সুযোগ মেলে শুধু ইশকুলে যেতে। আর ফি শুক্রবার বিকেলে শিশু একাডেমিতে নাচ শিখতে যেতে পারি।

আমি যেমন চঞ্চল চোখে সিঁড়িতে চোখ রাখছিলাম এ বাড়ির নতুন বাসিন্দাদের প্রতি, তেমনি মাও চোখ রাখছিলেন। আমার বয়স তের
বলেই তার চঞ্চলতা। আমার বয়সের কারনে তার চোখ শকুনের চোখ, তার ওপর কাজ করেন নন্দিনীতে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যায় বের হল, যারা থাকতে এসেছে, তাঁদের পরিবার হল চারটি ছেলেকে নিয়ে। মেজাজ খারাপ হল, ওপরতলায় যাওয়ার সাধ আর মিটবেনা! শেফালি আন্টিরা যখন ছিলেন, প্রায় যেতাম তাঁদের ঘরে। বেলকনি দিয়ে শহরের বেশ অনেকটা জায়গা দেখা যায়। নগর ভবন, ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফ্ল্যাডলাইট, বিশাল বড় ইউনূস টাওয়ার, আর আরো বিশাল একটা আকাশ। এরচেয়ে সুন্দর জিনিসটা দেখা যেত রাতে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গ্লাস টাওয়ার থেকে ফেলা আলো মেঘে পড়ে। মেঘগুলোকে মনে হয় সাদা চাদর।

এখানে যারা দাদার আমল থেকে থাকছে, তাঁদের মাতৃভাষা ঊর্দূ। তাঁরা সচরাচর বাইরের মানুষের বন্ধু হয়না। আর আগন্তুকরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও কেউ কাউকে চেনে না। আমি এই বাড়িতে শুধু নীচতলার আর পাঁচতলার আন্টিদেরকে চিনি। আগে সাততলার শেফালি আন্টিদেরকে চিনতাম, এখনকার সাততলায় তো চোখ রাখাও নিষেধ হয়ে যাবে। মা ঠিক শান্ত হতে পারছিলেন না বলেই হয়তবা দুদিনের মাথায় ওঁদের ঘরে গেলেন। খোঁজ এল, বাসিন্দা চারজন না, তিনজন। তিনটি ভাই, কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে, আর খুব মিষ্টি করে কথা বলে। মার স্বস্তির কারন বোঝা গেল আরেকটু পর, ওদের ঘর ভরা নাকি বই! আসবাব অল্প কিছু। খাট-তোষক বাদ দিলে সব আসবাবের চেয়ে নাকি বইয়ের ভার দ্বিগুণ বেশি হবে। আমার মাকে চেনা আছে, কারো বাড়িতে গেলে বই ধার না করে ফেরেন না। ওদের কাছ থেকে এনেছেনও একটা। খুব পুরনো, ছেড়া, সুনীলের 'শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা'। বইটা উলটে মা খানিকটা চমকে গেলেন। বইটা ধ্রুব এষ কে উপহার দিয়েছে হিমেল বরকত! শুভেচ্ছার দুটো লাইন লেখা। বইটা নিয়ে মা ডুবে গেলেন, আর আমি ভাবতে বসলাম, শিশু একাডেমির লাইব্রেরি ছাড়া আরো একটা বইয়ের জগৎ কি হাতে আসছে?

আমাদের বাড়ির মানুষগুলোর একটা সমস্যা আছে। অবশ্য পেছনের দোষটুকু আমাদের। পানির মটরের সুইচটা দোতলায়, সিঁড়ির পাশে। পুরান ঢাকার প্রায় সব বাড়ির মত এ বাড়িতেও লিফট নেই। তাই পানি শেষ হলে সিঁড়ি বেয়ে কাউকে নামতে হয় দোতলায়, পানি ছাড়তে হয়, ছাদের জলাধার ভরে গেলে মটর বন্ধ করতে হয়। আমরা লেকচারারের পরিবার বলেই হয়তবা কেউ মটর ছাড়তে বলেনা, উপরন্তু ছেড়ে বন্ধ করতে বলেও চলে যায়না। সমস্যাটা তৈরী হয়েছে এখানেই। কেউ এসে মটর ছাড়ল, অল্পক্ষণ দাঁড়িয়েই একটু পানি উঠিয়ে চলে যাবে। তাই কিছুক্ষণ পরপর পানি চলে যায়। নানারকম বিপদে পড়তে হয় এই পানি আসা-যাওয়ার সমস্যায়। যখন আমরা দেখি পানি নেই, আমাদের জন্য সেটা সোজা, গিয়ে মটর ছাড়ো, আট মিনিট পরে বন্ধ করে দাও। কিন্তু অন্যদের জন্য বেশ ঝক্কির। এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আট মিনিট। এই আট মিনিটের ঝক্কি দিয়ে ওমরের সাথে আমার পরিচয়।

দরজায় ঠুকঠুক করে আওয়াজ শুনে অবাক হুলাম। কলিংবেল চোখে পড়ল না আবার কার? মা দরজা খুললেন। প্রায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, সাততলার ঝাকড়া চুলের বাসিন্দা দাঁড়িয়ে। পরনে লুঙ্গী, আর লাল একটা গেঞ্জি। আমি খুক করে হেসে ফেললাম মার পেছন থেকে। ছেলেটা বলল, "পানিটা একটু বন্ধ করে দিয়েন?" মা মাথা নাড়লেন আলতো করে। ছেলেটা ঘুরে উঠতে শুরু করতেই মা আবার ডাক দিলেন, "এই!" তারপরে পেছনে ঘুরে বললেন, ওদের বইটা নিয়ে আয় তো! আমার প্রচন্ড রাগ হল। এখনই কেন ওঁর পানি ছাড়ার সময় হল? কাল মা সারাদিন অফিসে থাকবেন, আমার ইশকুলও ছুটি! ভেবেছিলাম বইটা মার চোখ লুকিয়ে পড়ব, তা আর হল না। এবার হয়ত লুকিয়ে ওঁদের কাছে চাইতে হবে। প্রেমের কবিতা মার সামনে পড়তে গেলে কিচ্ছু বলবেন না, কিন্তু মনে মনে অস্থির হবেন। এখন সময়টা অস্থির হওয়ার। আমি বড় হচ্ছি।

এরপর দেখা হয় ছাদে। দুদিন বাদে মা আর আমি বিকেলে ছাদে গেলাম হাওয়া খেতে। দেখি পাটি বিছিয়ে আয়েশ করে কিছু একটা বই পড়ছে ওমর। পাশে আরেকটা ছেলে, তার ভাই। নাম আহমাদ, আরো যে একটা ভাই আছে, তাঁর নাম ইবরাহিম। তিনজনে একটা মিল কারো চোখ এড়াতে পারবেনা, তা হল অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝাকড়া চুল। আমরা ছাদে ঢুকেছি, আলতো চোখে একবার তাকিয়ে ভ্রুক্ষেপ না করেই পড়তে লাগল। অসভ্যের মত শুয়ে থাকাটা আমার চোখে বিরক্তিকর লাগল। আমরা ছাদের অন্যপাশটায় বসলাম। মাথার ওপরে অনেকগুলো কবুতর উড়ছিল। আমি ছড়া কাটলাম, 'নোটন নোটন পায়রাগুলি/ ঝোটন বেঁধেছে/ওপারেতে ছেলেমেয়ে/ নাইতে নেমেছে।' তখন ওখান থেকে আহমাদ বলে উঠল, 'দুই ধারে দুই/রুই-কাতলা/ভেসে উঠেছে '। মা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে পড়লেন। আমি লজ্জায় মুখ লুকোলাম। মা-ই প্রথম আলাপ জুড়লেন, "তোমাদের ঘরে ছড়ার বই-টই আছে? আমার খুকিটাকে একটা ছড়ার বই পড়তে দিও।" আমার সবচেয়ে অসহ্য সম্বোধন হল 'খুকি'। আমার বয়স তের পেরোল বলে। সে বলল, "আছে বৈকি! নার্সারি রাইমস!" ইচ্ছে হল ব্যাটার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ি। এরপর গল্প শুরু হল মা আর আহমাদের। আমি কিছুক্ষণ নীরব শ্রোতা। একটু পর আমিও জুড়লাম। এই প্রথম আমার কথা হল নতুন ওঁদের সাথে। এতক্ষণ ছোট জন, যার নাম ওমর, একবারও ঘুরে তাকায়নি। এবার উঠে বসল মার খোঁচা শুনে। হাতের বইটা আইজ্যাক আজিমভের। সমগ্রের তিন নম্বর খন্ড ওটা। ছাদে ঢোকার সময়েই দেখেছিলাম। সন্ধ্যা নামল বেশ শিঘ্রী। আর মা এর মধ্যে ওঁদেরকে তুই করে ডাকতে শুরু করলেন!

ঠুক! ঠুক!
শব্দ শুনেই বুঝলাম মানুষটা কে। দরজা খুললাম। সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে, সাদা লুঙ্গী আর কালো একটা গেঞ্জি পরা।
-"মটরটা বন্ধ করে দিও তো খুকি।"
মুখ ঝামটা দিয়ে বললাম, পারবনা! খুকি আবার একটা ডাক হল? তাঁর বয়স আর কতইবা হবে? আমার দেড়গুণ বড়জোর। মা শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে চেঁচালেন, "কে এসেছে রে?"
"চাবিওয়ালা। চাবি বানাতে হবে না তো আমাদের!" বলেই দরজাটা আস্তে করে ভিড়িয়ে দিলাম। ওপাশে নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে আছে মানুষটা। দু মিনিট পর দরজা খানিকটা খুলে বললাম, "আপনি যান। মিনিট পাঁচেক আমিই ডিউটি দিচ্ছি"। মিনমিন করে থ্যাংক ইউ বলে সিঁড়ি দাপিয়ে উঠতে শুরু করল। এটা কেমন বিশ্রী অভ্যাস! এত শব্দ করে এ বাড়িতে কেউ সিঁড়ি বেয়ে ওঠে না। একদিন খানিকটা অপমান করে দিতে হবে।

পরের সপ্তাহে। বিকেলে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হল। সন্ধ্যার পর আবহাওয়াটা ঠিক বসন্তের মত লাগছিল। বাবা বললেন, চল ছাদে ঢুঁ মেরে আসি। মা বললেন "রান্নাটা আজরাইলে করবে বুঝি?" বাবার স্বভাবসিদ্ধ বুলি, "আহা! উপোস দিলাম নাহয় একদিন।"
অগত্য আমি আর বাবা চললাম ছাদে। গিয়ে দেখি ছাদের বাতিটা বন্ধ, একটা ছোট্ট টর্চ জ্বালিয়ে সাততলার দুই বাসিন্দা একটা বই দেখছে আর খুটখুট করে কথা বলছে। একটু পর আকাশে একটা তারা খুঁজতে লাগল দুজনে। এরপর হড়বড় করে বকবক শুরু হল এদিক-ওদিককার তারা নিয়ে। বুঝলাম, দুজনে বেশ তারা চেনে। বাবার এককালে শখ ছিল, এখন তেমন চেনেন না। আমি একটা মন্ডলী চিনি, ওরিয়ন। দুজনে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে যেসব তারার নাম বলল, তার কথা কখনো শুনিইনি। এদের একজন তারাদের নাম বলে বাংলায়, অন্যজন ইংরেজীতে। অথচ দিব্যি একজন আরেকজনের নামগুলো বুঝতে পারছে। বাংলায় যেজন বলে, তার নিজের নামটা ওমর। সেদিন যে আমাকে খুকি বলেছিল। আর অন্যজন ইবরাহিম, যাকে প্রতিদিন ঠিক নয়টা বাজার পাঁচ-সাত মিনিট আগে দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা যায়। তবে তার দৌড়ে নামার সময় সিঁড়িতে অসভ্য আওয়াজ হয়না। কোন কথা হয়না ওঁদের সাথে। বাবার এখনো আলাপই যে হয়নি ওদের সাথে, তাই।

পরদিন বিকেলে আমি যে কাজটা করি, তা নিশ্চয়ই খুব বাড়াবাড়ি রকমের অপরাধ। সাততলা পেরোবার সময়ে দেখে এসেছি তালা বন্ধ। তারমানে তিনজনের কেউ বাসায় নেই। আর ছাদে এসে দেখি পাটি-বালিশ বিছানো, তাতে একটা চায়ের কাপ আর চকলেট রঙয়ের একটা ডায়েরি। ডায়েরি ধরতে নেই কারো, তবু ফেরত দিতেই হয়ত খুলে দেখলাম নামটা। ভূত চাপল তখনই। 'খুকি' ডাকের প্রতিশোধ নিতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, ডায়েরিটা আমি পড়ব। সাততলায় তালা লাগানো দেখে এসেছি, সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করলাম, আর চোখ রাখলাম কেউ আসছে কিনা। ক্লাস সেভেনের মেয়েরা ডায়েরি লিখেনা তেমন। আমার বান্ধবিদের মধ্যে আমিই শুধু লিখি। অন্যের ডায়েরি তাই আমাকে এত বেশি টানছে। প্রথম পৃষ্ঠাটায় আমার কেমন যেন লাগল। হাতের লেখা মানুষের এতটা বাজে হয়? লাল কালিতে কেউ ডায়েরি লিখে নাকি? কিছুক্ষণ পর মনে হতে শুরু করল, অতটুকু একটা মানুষ এত্ত সুন্দর লিখে কেমন করে!
কোকিল বড় অসময়ে ডাকিয়াছিল। কথাটা যতদূর ভাবিতে পারি বঙ্কিমবাবু কোথাও লিখিয়াছিলেন। তিনি যেথায়ই লিখেন না কেন, কোকিল বারংবারই  অসময়ে ডাকিয়া বসে। 
আমি ঠিক বুঝলাম না কোকিলের কথা বলে ঠিক কী বুঝানো হল। আমার কাছে তো লাগে বসন্তটা কোকিলের। কোকিল ডাকলেই বরং মনে হয়, সবকিছু সত্যি।

খুব দ্রুত পাতা উল্টে পড়ে যেতে লাগলাম, চোখ বুলাতে লাগলাম। খুব জানতে ইচ্ছে হল ওঁর প্রেমিকার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু লেখা নেই কোথাও। অনেক বান্ধবির ব্যাপারে খানিকটা লেখা আছে। কিন্তু প্রেমের কথা নেই। আমি কেন চোখের কোনা দিয়ে প্রেমের ব্যাপারে লেখা খুঁজছিলাম, কে জানে! তবে পড়তে খুব ভালো লাগছিল। ইচ্ছে হল ডায়েরিটা চুরি করে নিয়ে যাই। পড়ে আবার ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু তা কী করে হয়! আমাকে অভদ্র বলবে যে! মেঘ না চাইতেই জল পেলাম। সত্যিকারের জল। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এল। আমি ডায়েরি নিয়ে সোজা চলে এলাম নিচে। পরে ফিরিয়ে দিয়ে বলব, আপনি কেমন মানুষ হে! ডায়েরি কেউ জলে ভিজতে দেয়? এসে সোজা ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তে শুরু করলাম। পুরোটা পড়লাম। বারবার মনে হচ্ছিল গিয়ে দেখা উচিৎ ওরা এসেছে কিনা। কিন্তু যাওয়ার সুযোগ কই? রাত কাটল। পরদিন দুপুরে বাবা কলেজে, মা অফিসে যাবার পর আমি একলা ছিলাম বাসায়। ইশকুল থেকে এসেছি খানিক আগে। সিঁড়ির দুদ্দাড় আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম।
-শুনুন!
-কি গো খুকি?
রাগ হল না এবার আর তেমন। দৌড়ে ঘরে গেলাম, ডায়েরিটা নিয়ে এলাম।
-এই নিন! বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল! ভাগ্যিস আমি বাঁচিয়েছি।
আবার যোগ করলাম, আমি কিন্তু পড়িনি!
খুক করে হেসে ফেলল ও।
-তাইইতো ডায়েরিটা শুধু বেঁচেছে। বালিশ আর পাটিটা ভিজে একাকার!
উফ! এই ভুল কেমন করে হল! আমি ঝট করে মাথা নিচু করে ফেললাম লজ্জায়। কয়েক মূহুর্ত মাটির দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ কেমন করে যেন বলেই ফেললাম, "আপনি খুব সুন্দর লিখেন।" বলে ওঁর হাতে ডায়েরিটা কোনমতে ধরিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আমি কেন শেষ বাক্যটা বলেছি? লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হল।

আমি জানি আমি ওঁর প্রেমে পড়ে বসে আছি। মানুষটা অসভ্য। সিঁড়িতে হাটলে শব্দ হয়, একটা মেয়ে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখেও ভ্রূক্ষেপ না করে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। মাথার চুল যেন কাকের বাসা। মা যাকে ডাকেন তালপাতার সেপাই বলে। সেই মানুষটার ডায়েরি পড়ে আমি প্রেমে পড়লাম! ওখানে আহামরি কিছু লেখা ছিলনা। ছিলনা নিজেকে নিয়ে লেখা, ছিলনা সাহিত্য। এলোমেলো বুলিতে আমি কী খুঁজে পেয়েছি কে জানে! বারবার কথা বলতে ইচ্ছে হতে লাগল, কিন্তু সেই ঠুকঠুক আওয়াজ আর হয়না। কেউ মটর ছেড়ে চলে গেলেই আমি মটর বন্ধ করে দিতে লাগলাম, শিঘ্রী যেন পানি ফুরোয়। তাঁরই যেন আসতে হয় পানি তুলতে। কিন্তু সবাই আসে, ও আসেনা। সিঁড়িতে দুদ্দাড় আওয়াজ তুলে নিশ্চয়ই বাইরে যায়, নিশ্চয়ই ঘরে ফেরে। কিন্তু আমি সেসময়ে হয়ত ইশকুলে থাকি, ঘুমিয়ে থাকি।
ঠিক দুদিন বাদে ঠুকঠুক আওয়াজ হল দরজায়। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। সেই একই বাক্য, "মটরটা বন্ধ করে দিওতো খুকি।" আমি স্থাণুর মত জমে গেলাম। চুপ করে তাকিয়ে রইলাম খানিকটা সময়। পায়ে বিশ্রী আওয়াজ তুলে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল বুড়োটা।

তারও দুদিন পরে রাতে খেতে বসেছি। মা-বাবা দুজনেই আছেন। দুজনের মুখ থমথমে। এরকম কখনো দেখিনি। তাঁরা ঝগড়া করেন না কখনো। আমার পাতে এক টুকরো সুরমা মাছ তুলে দিতে দিতে মা বললেন, "তোমার অঙ্ক খাতায় অঙ্ক থাকবার কথা।"
আমি ভয়ে জমে গেলাম মূহুর্তেই। বাক্যটা শেষ করলেন খানিকটা থেমে। "কিন্তু সেখানে এক হাজার চারশ দুইবার লাল কালিতেওমর লেখা।" আমি দৌড়ে খাবার ছেড়ে উঠতে গেলাম। বাবা বললেন, "অন্তরা, চুপচাপ খেতে বসো।" আমি খেতে বসলাম। খাবার ঘরে আর একটা কথাও হল না। ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসলাম। বালিশে মুখ চেপে কান্না। কেন কাঁদছি আমি কিন্তু জানিনা। টের পেলাম মা কিংবা বাবা কয়েকবার ঊঁকি মেরে গেলেন। শেষমেষ বাবা এসে বললেন, চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি। চুপচাপ চোখমুখ ধুয়ে এলাম। চেহারা হয়তবা মলিন লাগছিল। সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় এসে থেমে গেলেন। কলিংবেল টিপলেন। আমার মনে হল দৌড়ে পালাই। অপেক্ষা করলাম, বড়জন দরজা খুলল। বাবা কেন এমনটা করছেন জানিনা। বললেন, "কেমন আছ বাবারা? গল্পের বই দাওতো ওর জন্য একটা।"

আমি পাথরের মত মুখ শক্ত করে ওঁদের ঘরে ঢুকলাম। বাসায় কোন বইয়ের শেলফ নেই। সবখানে বই রাখা আছে।  সানশেডে সারি সারি সাজানো, কোথাও মেঝে থেকে কোমর সমান উঁচু , খাটের নিচে স্তুপ করা। আমি চুপচাপ দেখলাম। ওমর শুয়ে শুয়ে ক্লাশের পড়া পড়ছিল। বাবার জন্যই লাফ দিয়ে উঠে বসল। "আঙ্কেল স্লামালিকুম।" আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমি স্থির চোখে তাকালাম, চোখ নামিয়ে নিলাম। ওঁর খাটের নিচ থেকে একটা বই খুঁজে বের করে নিলাম। হুমায়ূন আহমেদের 'অন্তরার বাবা''। বাবা বইটা দেখেই হেসে ফেললেন। ওমর হাসল, সেই হাসি আহমাদ এবং ইবরাহিমের মধ্যে ছড়াল। আমিও কেমন করে যেন হাসতে শুরু করলাম। আরো নিলাম আনা ফ্রাঙ্কের নীলক্ষেতের ছাপা পেপারব্যাক কপি। বাংলা অনুবাদ। বেরিয়ে বাবা বললেন, ছাদে যাবি? আমি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। যাব না। নিচে এলাম। বাবার সাথে তাঁদের ঘরে গেলাম। বাবা কথা বলতে শুরু করলেন।
-মন ভালো হয়েছে?
-হুম।
-এবার খাতাটা এনে আমার সামনে বসে বসে পৃষ্ঠাগুলো ছিড়তে হবে তোমাকে।
আমি চুপ থাকলাম।
-তোমার বয়স কত?
-তের।
-এই বয়সে আমেরিকার মেয়েরা কী করে?
চুপ থাকলাম।
-ডেটে যায়। 
একটু থেমে যোগ করলেন, "মনে রাখবে, তুমি আমেরিকান না। বাঙ্গালি।"

বাসায় খুব থমথমে পরিবেশ নেমে এল। আমি ইশকুলে যাই, বাসায় আসি। ছাদে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। নক নক আওয়াজ শুনলে মাই খোলেন দরজা। সপ্তাহান্তে জীবনে যেটা কখনো করিনি, তা করতে হল। নাচের ক্লাশ মিস দিলাম। শিশু একাডেমিতে একলাই যাই হেঁটে হেঁটে। কিন্তু এ সপ্তাহে কেন যেন গেলাম না। মা-বাবা কিছুই বললেন না। হয়ত ভাবছেন, সময় যাক, সব ঠিক হবে। উল্টোটা হচ্ছিল। আমার জগৎ জুড়ে তখন শুধু বুড়োটা। আমি ডায়েরিতে কল্পনার ঘোড়া ছোটালাম। তাঁকে নিয়ে কল্পনায় আকাশ-কুসুম ভাবতে লাগলাম, লিখতে লাগলাম। এই ডায়েরি অবশ্য মায়ের খুঁজে পাবার সম্ভাবনা নেই। খুব করে খুজলেও তাঁর চোখ এড়িয়ে যাবে। ডায়েরিটা কেনা হয়েছে রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে। যেহেতু একা ইশকুলে যাই, রিকশার বদলে বাসে চড়লে দিনে ষাট টাকা বাঁচে।

বাবার ঘরে কম্পিউটার। আমি দাবা খেলছিলাম বসে বসে। বাবাকে জীবনে একবার হলেও হারানোর শখ। তাই কম্পিউটারে বসে বসে অনেকক্ষণ করে খেলি। নীলক্ষেতের মোস্তফা মামার দোকান থেকে তিনটা দাবার পুরনো বইও কিনে এনেছি। সেগুলো নিয়েও পড়ে থাকি অনেক সময়। বাবা খুব ভালো খেলেন। মা আর বাবা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। এই অসাড় আয়েশি আলাপ। তখন আসল সাততলার ওদের কথা। মা বললেন,
-ইবরাহিমদেরকে দেখেছ? ওদের ঘরে ঢুকলে মনে হবে ওরা সাহিত্য ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা। অথচ জানো, ছেলেগুলো সারাদিন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকে! তিনজনই বিজ্ঞানের নানা সংগঠনে যায়। সাহিত্যের ধারেকাছেও নেই। 
-কী বলছ। ওমরের তো একটা ব্লগ আছে। সেদিন দেখাল। গল্প-টল্পই লেখে বেশি। আমি সব পড়লাম। 

নামটা আমার কানে ঠেকল। এবং দাবার চালে ভুল করে বসলাম। মন্ত্রিটা গেল!

মা বললেন,
-ব্লগ তো আমিও পড়েছি। সেদিন দেখি কী যেন ডিজাইন করে কম্পিউটারে। ভাবলাম ফটোশপ। পরে দেখালো, ওয়েবসাইটের কাভার করছে। বাচ্চা একটা মানুষ, অথচ লেখার সময় চরিত্রগুলো এমনভাবে নিতে চায় যেন মনে হয় বড়দের লেখা তাইনা? 
-আমি ওর একটা গল্প পড়ে হেসে খুন। বড় বড় বাক্য দিয়ে মার্কেজ সাঁজতে চায়।
-ভাষা কিন্তু সুন্দর। 
-বাকি দুজনেরও কিন্তু ব্লগ আছে। আহমাদের ব্লগ পুরো প্রেমিক মনোভাবে ভরপুর। আর ইবরাহিমেরটা স্মৃতি, ভাবনা এসব। 
এরপর তাঁরা কেমন করে যেন চিনির দাম বাড়ার গল্পে চলে গেলেন। আর আমি ভাবতে বসলাম ব্লগ পড়ব কী করে। হঠাৎ মনে হল, বাবা যদি এই কম্পিউটারে পড়ে থাকেন! মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এড্রেসবারে লিখলাম, om... অমনি চলে এল একটা ওয়েবসাইট। আমার ইচ্ছে হল আনন্দে চিৎকার দেই। বাবা গিয়েছেন সাইটটায়, তাই এত সহজে আমার সামনে চলে এল ওমরের সব লেখা। আমি পড়তে লাগলাম। বাবা মা ঘরেই আছেন। কিন্তু তারা কেউ উঠে দেখবেন না কী করছি। কারন জানেন, দাবা খেলছি। আমাকে ঝেটিয়ে না উঠিয়ে দিলে আমি দাবাই খেলতে থাকব। লেখাগুলো পড়ে আমার মনে হল না মানুষটা আমাদের মত ছোট। আমার এখন একটা দূর্বার আকর্ষণ তৈরী হতে লাগল মানুষটার প্রতি। ব্লগ থেকে একটা লেখা পেলাম, দেখে বোঝা যায় প্রথম আলোতে ছাপা। প্রথম আলো ই-পেপার থেকে ডাউনলোড করে সরাসরি দিয়ে দেয়া হয়েছে হয়তবা। অলংকরণ দেখে থমকে গেলাম। মাসুক হেলাল করেছেন! মাসুক হেলাল ওমরের গল্পে অলংকরণ করেছেন! ভিড়মি খাবার জোগাড় হল নিচের কয়েকটা লাইন লেখা পড়ে। এই গল্প লিখেছে যখন ও ক্লাশ সেভেনে পড়ে। মানে আমার মত তের-চৌদ্দ বছর বয়সের একটা ছেলে গল্পটা লিখেছে। আমি ভাবতে লাগলাম, আমার বাড়ির ওপরে থাকে মানুষটা। যদি পারতাম প্রতিদিন তাঁর সাথে গল্প করতে, কীভাবে লিখতে হয় তা নিয়ে। আমার খুব ইচ্ছে হল একটুখানি কথা বলতে। আমি বাবা-মাকে উপেক্ষা করে গুনগুন করে গাইলাম, 
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।


পরদিন বাসায় মা-বাবা কেউ নেই, তখন আবারো কম্পিউটারে গিয়ে বসলাম বাকি সব লেখা পড়তে। এবং সেখান থেকে আবিষ্কার করলাম, ওঁর সাথে আমি চাইলেই কথা বলতে পারি। ওয়েবসাইটে দেয়া আছে গুগল প্লাস এর ঠিকানা। সেখান থেকে টুইটার, এবং সেখান থেকে ই-মেইল। এবং ফোন নম্বরটাও। এখন আমি মানুষটার বাসা চিনি, মানুষটার সবরকম যোগাযোগের ঠিকানা জানি। আমার অদ্ভুত আনন্দ হল এসব পেয়ে। মনে হল আনন্দে পাগল হয়ে যাব। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে কয়েকটা লাইন খুব মনে ধরল। -জানিস অনেক যুগ ধরে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে।
-তোর যে জন্ম হয়নি অনেকবছর আগে!

-তবু তখন থেকে বলতে ইচ্ছে করে।
মেয়েরা খুব সহজে চোখে অনেককিছু দেখতে পায়। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকটা মূহুর্ত। তারপর কেমন ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, "জানিস, আমার একটা কথা বহু যুগ ধরে শুনতে ইচ্ছে করে।"
আচ্ছা, এমন যদি হয়, গল্পটা সত্যি। যদি এমন হয়, ওর একটা সত্যিকারেরে প্রেম আছে? আমি দুঃখে মরে যাব। আমি যদি ওকে লিখি, "জানেন, আমার না একটা কথা বহুযুগ ধরে বলতে ইচ্ছে করে।" ও কি উত্তরে বলবে, "আমারও একটা কথা বহু যুগ ধরে শুনতে ইচ্ছে করে"? কিন্তু, বয়স যে আমার মাত্র এক যুগ পেরুল।

পরের ঘটনাগুলো ঘটল খুব দ্রুত। বাবা আমাকে বললেন, আমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারব মানুষটার জন্য। আমার মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে হল, বাবা সাত বছর অপেক্ষা করেছিলেন, কিছুমাত্র লাভ হয়নি। আমার দিনদিন চুপ হয়ে যাওয়া দেখেই হয়তবা এমন প্রবোধ দিলেন। কিন্তু আমার যে অপেক্ষা করবার শক্তি নেই। বাবা আমাকে বড় হতে বলছেন, অথচ আমি বড় হয়েছি। আর কত বড় হব? সুনীলের মত করে ভাবলাম,
আমার মাথা এই ঘরের ছাদ/
ফুঁরে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে ?

বাবা ওকে পছন্দ করেন, মা ওকে পছন্দ করেন। তবু আমার বাঁধা সইতে হচ্ছে, কারন আমি নাকি খুব ছোট। আমি ছোট না, তাই হয়তবা তাঁকে মেইল করলাম অনেক ভেবে। দুটো লাইন।


জানেন, অনেক যুগ ধরে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে। যদিও এই খুকিটার জন্ম হল একটা যুগ আগে মাত্র!
-অন্তরা

উত্তর এল পরদিন, 
আমি যে বহু যুগ ধরে অন্য একটা নক্ষত্রের জন্য অপেক্ষা করছি!
-ওমর
 আমি থমকে গেলাম। আমার সময়গুলো ভয়াবহ কাটতে লাগল। ইশকুলের লাইব্রেরি থেকে গাদা গাদা দঃখের বই এনে পড়তে লাগলাম। আরেকটা কাজ করতে লাগলাম, অনবরত তাঁকে ইমেইল করতে লাগলাম। একটা বাড়িতে থেকেও ভালোবাসার কথা বলতে হচ্ছে ইমেইলে। ব্যাপারটা হতাশার। আমি সেই হতাশা কাটাতে মা-বাবা বাসায় না থাকা অবস্থায় একদিন মুখোমুখি হতে চাইলাম। সিঁড়ির দুদ্দাড় শব্দ শুনে দৌড়ে দরজা খুলে বললাম, শুনুন! 
ও শুনল না, আমাকে উপেক্ষা করে সোজা উপরে চলে গেল। আমি নানা কথা লিখে মেইল করতে লাগলাম। গল্প নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু ও মুখ দেখাতে নারাজ।

ব্যাপারটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটবে আমি কখনো আশা করিনি। আমার ইশকুল শেষ হওয়ার পর সাথে সাথে বাসায় ফিরলে যা, পাঁচটার আগে যে কোন সময় ফিরলেই তা। ইশকুল শেষে হেঁটে হেঁটে গেলাম নীলক্ষেত। ক্লাশ সেভেনে ওঠার পরে পালিয়ে নীলক্ষেত ঘোরার অভ্যাসটা হয়েছে। মোস্তফা মামার দোকানে গেলাম। তাঁকে সবাই মোস্তফা মামা ডাকে বলে নামটাই এখন দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ডাকি দাদু বলে, এবং উনি খুব আদর করেন। ছোট্ট একটা মেয়ে মাঝে মাঝে একলা পালিয়ে চলে আসি বই দেখতে, ওনার হয়ত ব্যাপারটা ভালো লাগে। গাউছুল আজম মার্কেটের সামনের দিকটায়, নীলক্ষেত হাইস্কুলের গেটে এক লোক ভ্যানে করে পুরি ভাজে। অসম্ভব স্বাদু। আমি এলেই দাদু তাঁর ভাগ্নেকে দিয়ে সেই পুরি আনেন। আজ তাই একটা কাজ করেছি। পুরি কিনেই তাঁর দোকানে এসেছি। দাদু তো হেসেই শেষ! বললেন, "বাপের টাকায় এত পোদ্দারি কিসে? নিজে যখন কামাবি, তখন খাওয়াস।" তারপর হঠাৎ মনে পড়ল এমন করে বললেন, "আজ তোর বাবা আসল। বাসায় গেলেই বুঝবি! তোর জন্য সাতটা বই নিছে। আমার কাছে মন ভালো করার বাচ্চাদের বই চাইল। তোর মন খারাপ নাকি? বকা খাইছিস?"
ঠিক তখন আমি চমকে উঠলাম, "মামা, আর্ট অব ওয়ার আছে?"-শুনে। ওমর আর্ট অফ ওয়ার খুঁজছে। আমাকে যখন দেখল, ওও খানিকটা যেন চমকেই গেল। "তুমি এখানে কী করছ?" আবার যোগ করল, "একলা...।"
-আপনিই বা কী করছেন? 
এমন উত্তর আশা করেনি। তবে আমাকে এখানে দেখেই একদম থমকে গেছে যেন। আর্ট অব ওয়ার নেই মোস্তফা দাদুর দোকানে। আমার হাতে মানিক বন্ধোপাধ্যায় এর সহরতলির দ্বিতীয় খন্ড ছিল। চলে আসার সময় ও দুটো খন্ডই কিনে নিল। একসাথে বের হলাম। তখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি ও আমাকে বইয়ের দোকানে একলা দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, পুরি খাবেন? মাথা দোলাল। নীলক্ষেত হাইস্কুলের সামনে একসাথে গেলাম। এই কয়টা দিন আমি যাকে অনবরত লিখে গেছি, কল্পনা করে গেছি, একবিন্দু সাড়া পাইনি, সেই মানুষটা আমার সামনে কাঁচুমাচু হয়ে আছে। বোকা লোকটা পুরি খেতে গিয়ে জিহ্বাটা পুড়িয়ে ফেলল। এরপর বলল, "চলো পাঠক সমাবেশে যাবে? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা তোমার আবশ্যি ভালো লাগবে।" আমি এবার সত্যি অবাক হলাম। 

আমরা পাঠক সমাবেশে না গিয়ে গেলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সোজা ছাদে উঠলাম। সেখানের ক্যাফেটা সুন্দর। খোলা আকাশের নিচে বসে ছোলা চিবুতে চিবুতে মানুষটা বলল, ভালোবাসি।


দুই.
বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেল। তবু তখনো বাবা মা কেউ ফেরেননি। আমাকে যে বই দুটো ভালোবাসার প্রথম উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে, সেটা ত্রিশ বছর আগের ছাপা, নানা জায়গায় ছেঁড়া। এবং আগে কোন এক মা তাঁর ছেলেকে উপহার দিয়েছেন। বাবা ঐ রাতেই বইটা দেখে ফেললেন। প্রথম পাতা উল্টে আগের শুভেচ্ছাকে কেটে দিয়ে নতুন শুভেচ্ছা লেখা দেখলেন, 
জগতের সুন্দরতম নক্ষত্র-
অন্তরা কে।
                      -ওমর
 মুচকি হেসে বইটা ফেরত দিয়ে চলে গেলেন। এ বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া আসার একচল্লিশ দিনের মাথায় মির্চা এলিয়াদ-মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে-র মত আমারো একটা গল্প তৈরী হল, বাবা-মা সেটা জানলেন, মেনেও নিলেন। আমার তখন মনে হল, বাবা হয়ত এটাই চাইছিলেন। আমি আমার ভালোলাগাকে আমার মত করে জয় করে নেই। নইলে তিনি কেন প্রথম দিনে ওদের ঘরে নিয়ে গেলেন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন