শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

স্বরলিপি আহমেদ

ছবি : আকাশ      মডেল : সামিয়া
স্বরলিপি আহমেদ নাম থেকে আশির দশকে যে চিঠিগুলো আসত আমার কাছে, সেগুলোর লেখার ভঙ্গি ছিল চমৎকার। আমি সবেমাত্র অনার্স শুরু করেছি। থাকি ঠাকুরদার আমলের পুরনো একটা বাড়িতে, মগবাজারে। আমার ছোট বোনটা তখনো ইশকুলে পড়ে। বোধকরি তখন ব্যাপারটা শুরু। আমাদের বাড়িতে সবার প্রচুর চিঠি আসত, তাই ছোট পরিবার হলেও কেউ কারো চিঠির দিকে তাকাতো না। তবে ছোট বোন চিত্রাকে পরের দিকটায় প্রায়ই এক কিংবা দুই টাকা করে দিতে হয়েছে চিঠি উদ্ধার করতে। যে সময়টায় ডাকপিওন আসত, তখন আমি বাড়িতে থাকতাম খুব কমই। চিঠিগুলো যেত চিত্রার কবলে, এবং সে থেকেই এই ঘুষ-প্রথা আমাদের বাড়িতে ঢোকে।

প্রথম যেদিন চিঠিটা আসে, সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম। চিঠিটা আনমনে খুলি এবং 'প্রিয় প্রত্যুষ' সম্বোধন দেখে কেমন চমকে যাই।
চিত্রাকে আড়াল করতে গিয়ে ব্যার্থ হই, এবং তখন থেকে চিত্রা সব জানত। মনে রাখার মত কথা তেমন ছিল না ওখানে, তাই মনে নেই। স্বরলিপি আহমেদ নামের মেয়েটা ক্লাস টেনে পড়ত তখন। এবং প্রথম চিঠিটায় লেখা ছিল, যে ঠিকানাটা লেখা আছে খামের ওপরে, সেটা কোন বাড়ির ঠিকানা না, মসজিদের ঠিকানা। তাই সরিষাবাড়ি ডাকঘরের ঐ ঠিকানায় চিঠির কোন উত্তর পাঠানোর সুযোগ আমার নেই।

এভাবে টানা সারে চার বছর চিঠি এসেছিল আমার কাছে। চিঠিগুলোর সবগুলোতে পছন্দের কথা লেখা ছিল, কিন্তু ভালবাসার কথা ছিল না। চিত্রা প্রায় সব চিঠিই পড়ত, এবং ওর জানা ছিল না, ওগুলোর প্রতিটার উত্তর আমি লিখতাম, এবং লুকিয়ে রাখতাম। আশির দশকে অজপাড়াগাঁয়ে বসে কেমন করে মেয়েটা আমাকে জানছে, আমি জানতাম না। জানার খুব একটা চেষ্টাও করিনি। পরের দিকে ঢাকা থেকেই আসত চিঠিগুলো। লালবাগ থেকে। তখন স্বরলিপি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে। আমি তখন স্নাতকোত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কে জানে! সেও হয়তবা এই ক্যাম্পাসটায়ই ঘুরে বেড়ায়, আমি জানিনা। লিখেনি কখনো।

শেষ চিঠিটা আসে ঊননব্বই সালে। সেখানে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, "আমার জীবনে বড় পরিবর্তন আসছে। প্রত্যুষদা, আপনার জন্য হয়তবা জীবন এমন বদলাচ্ছে। এই স্মৃতিটুকু না থাকলে আমার যে জীবনে ঢুকবার কথা ছিল আজ, সে জীবনটাকে সাদরে ডেকে নিতাম। কিন্তু আমি তা পারছিনা।"

প্রথম চিঠিটা আপনি সম্বোধনে আসে, শেষটাও। সেখানে লেখা ছিল, আমাকে আর লিখবেনা সে। এই দিনগুলোর সব চিঠি আমার কাছে জমা ছিল, এবং উত্তরও। কিন্তু উত্তরগুলো পাঠাবার আমি চেষ্টা করিনি কখনো, কখনো ঠিকানাটা খুঁজিনি। কারনটা হয়তবা ধর্ম। ব্রাহ্মণ হয়ে কেমন করে মুসলমান মেয়েকে খুঁজতে বেরোই?

আমি আমার জাত রক্ষা করে তার দুবছর পর বিয়ে করি। ব্রাহ্মণ মেয়েই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন লেকচারারের জন্য রুপে গুনে অনন্যা পাত্রি প্রয়োজন ছিল। তা আমার কপালে ঠিকই জুটিয়েছিলেন আমার জ্যাঠা। বিয়ের আগে আমি আর চিত্রা সবগুলো চিঠি পুড়িয়েছিলাম। শুধু স্বরলিপি আহমেদের চিঠিগুলোই। আমার লেখা উত্তরগুলো আমার কাছেই ছিল। সেগুলোর কথা চিত্রার জানা ছিল না। আমি বেশ স্মৃতিকাতর ছিলাম, কিন্তু আমার ইডেনপড়ুয়া বোনের মায়াদয়া ছিল না রুলটানা খাতার কাগজগুলোর প্রতি।

গল্পটা সেখানে শেষ হয়নি। আমার মেয়ে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এর বয়স যখন তের, তখন আমার স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যান। ফাল্গুনী বড় হয় আমার কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থেকে। অনেকেই তাকে ভেবেছে ছেলেবেলায়ই লেখায় খ্যাতি জুড়ানো মানুষ। কিন্তু আমাদের পরিবারের উপাধি 'মুখোপাধ্যায়', এবং আমার প্রিয় লেখক ফাল্গুনী। আকাশে সিংহ রাশিতে ফাল্গুনী নামে আছে দুটো তারা। মেয়েটাও সিংহ রাশি। তাই দেরী হয়নি মেয়েটার জন্মের পর নাম রাখতে। যদিও ফাল্গুনী বড় হয়ে বলত, আমার নাম তোমরা তারাদাস রাখলেও পারতে। তোমার প্রিয় লেখকের আসল নামটা পেতাম।

মেয়েটা ছিল বড় চটপটে, এবং ভ্রমণবিলাসী। টাকাপয়সা যা পেতাম লেখালেখি করে, আর সরকারের আধাপয়সা বেতন থেকে, তা দিয়ে ওষুধ কেনার জন্য তার মা বেঁচে ছিল না। যদিও একসময় প্রায়ই রমনা মন্দিরে যেতাম শুধু এটুকু প্রার্থনা করতে, পথ্য কিনেই যেন বাঁচতে পারি। কিন্তু ইশ্বর মুখ তুলে তাকাননি। চিতার কাঠ কিনে আমাকে একদিন ক্ষান্ত দিতে হয়। তাই বাপ মেয়ে উড়াতে পারতাম বেশ। পাহাড় ঘুরেছি সবচেয়ে বেশি। মেয়েটা ট্রেন চড়তে ভালবাসত, আমাকে নিয়ে দেশময় ঘুরেছিল। দুই হাজার চার সালে একটা কম্পিউটার কিনে নেয়। সেই সুবাদে নয় সালে একটা ফেসবুক আর ইমেইল একাউন্ট জোটে এই বুড়ো কিংবা মধ্যবয়সী অধ্যাপকের। একদিন বাবার ছেলেবেলার সেই চিঠির গপ্পও শোনে চিত্রা পিসির কাছে।

পাহাড়চড়া মেয়েটা আমার এভারেস্টে যায় দুই হাজার ষোল সালে। অতবড় সাধ আমার কোনদিনই জাগেনি। লেখার সময় বড় বড় কথা লিখলেও আমি ভীতু একটা মানুষ। প্রতি জন্মদিনে উপহারের গাট্টি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একগাদা বইয়ে লেখা থাকত, "মা, তোমাকে সব স্বপ্ন পূরণ করতে হবে"। কিন্তু অন্নপূর্ণা জয় করা মেয়েটা যখন এভারেস্টের কথা বলে, কেঁপে উঠি। আমি বলেছিলাম, টাকা কি হবেরে বেটি অত? ত্রিশ-চল্লিশ লাখ টাকা লাগে, তা জানতাম। দেশে যে কয়টা ছেলেপেলে এভারেস্ট জয় করেছে, সবার সাথেই একটু সখ্যতা ছিল। আর সজল নামের যে ছেলেটা এভারেস্টে মারা গেল সেবার, ও আমার বাসায় এসেছিল বেশ কয়বার। কিন্তু টাকার কথা বলে যদি এভারেস্ট যাত্রা থামানো যেত, তবে কি আর কেউ এভারেস্টে যেত? মুসা-ওয়াসফিয়ারা যেমন করে টাকা জোগাড় করেছে, তেমন করে একদিন আমার সবেধন নীলমণিটা টাকা জোগাড় করে ফেলে। বুড়ো অধ্যাপক কেমন করে জানবে, আজকাল তরুনগুলো এত সহজে কঠিন কাজগুলো করতে পারে? টাকা জোগাড় হয়েছে শুনে হাসির আড়ালে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, তা ছিল বেশ দীর্ঘ।

চিত্রা তার স্বামীর সাথে আমেরিকায় থাকে। ভিডিও চ্যাটে অভিনন্দন জানায় একদিন ফাল্গুনীকে। আর আমাকে দেখেই বলে, "দাদা! তুই ভয় পাচ্ছিস!" আমি বলি, "তুই গেলে বাবা আমার মত ভয় পেতেন। এবং ভয় পাওয়া দোষের কিছু না বুঝলি?"
মেয়েটা তার মায়ের কাছে যায় এভারেস্টের প্রায় চূড়ার কাছে গিয়ে। হিলারি স্টেপ এ পা রাখার ভাগ্যটুকুও মেলেনি। তবে তার একটু দূরে দাঁড়িয়ে শেষ নিঃশ্বাস ঠিক ফেলেছিল। হঠাৎ করে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়, মেয়েটার সাহস আছে বটে! আমি সেই ঝড় দেখি, ঝাপসা চোখে। আমাকে সফল পিতা আখ্যা দিয়ে আরো কত কথা শোনা যায়! বেজক্যাম্প থেকে সেদিন বিকেলে আরো একটা খবর আসে। বাংলাদেশি একজন মধ্যবয়স্কা স্কুলশিক্ষিকাও ছিলেন ঐ দলটায়। আমাকে ফাল্গুনী তাঁর কথা বলেনি। মেয়েটা আমাকে একলা রেখে চলে গেল।

পরদিন পত্রিকায় আমি সেই স্কুলশিক্ষিকার ছবি দেখতে পাই। ঐ পাতায় আমার মেয়েটার ছবিও যে ছিল! কিন্তু আমার চোখে আটকায় স্কুলশিক্ষিকার নামটা। স্বরলিপি আহমেদ। মেয়েটা আমার আর নেই, কিন্তু স্বরলিপি আহমেদ আছেন। এভারেস্টজয়ী স্বরলিপি আহমেদ।

যখন ছবি দেখতে পাই পরে পত্রিকায়, দুটো পতাকা হাতে নিয়ে আছেন স্বরলিপি আহমেদ, আমি অবাক হই। পত্রিকা থেকে আমি এও জানি, একটা পতাকা ছিল আমার মেয়ের। পতাকাটা বয়ে নিয়েছিলেন মেয়েটার কাছ থেকে। আমি স্বরলিপি আহমেদকে দেখতে চাইনা। ছেলেবেলার স্বরলিপি আহমেদকে দেখতে চাইনি, শেষ সময়ের স্বরলিপি আহমেদকে দেখতেই হবে?

আমি একা একা এখনো অধ্যাপনা করে যাচ্ছি, এবং শুধু অধ্যাপনাই করে যাচ্ছি। লিখিনা, বই পড়িনা। শুধু অধ্যাপনা করি। মেয়েটা তার মায়ের কাছে উড়ে যাবার দুদিন পরই ক্লাস নেই। একদম একা হওয়া যাকে বলে। এর কদিন পর চিত্রা দেশে আসে। এসে প্রথমেই বলে,
-দাদা, তোর কি ধারনা সব হারিয়েছিস?
-নাহ! এইতো দেখছিস বেশ!
-সত্য জানবি একটা?
-অনেক জেনেছি।
-এই মানুষটা কিন্তু সেই স্বরলিপি আহমেদ!
-কেমন করে জানিস?
-কারন ছেলেবেলায় সে আমার বন্ধু ছিল।
আমি চেয়ে থাকি। আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারি, এই তথ্যটা আমি জানতে পারতাম সেই আশির দশকে, যদি চিত্রার দাদা ব্রাহ্মণ না হত, কিংবা স্বরলিপি নামের মেয়েটা মুসলমান না হত।


২৫ চৈত্র ১৪২২
ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন