রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬

যেভাবে কখনো ঢাকা ঘুরিনি

ছবিঃ BANGLADESH: discover today, think tomorrow

নানা জায়গায় বেড়াতে যাই প্রচুর। আর ঢাকার ধুলাবালির মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই ঘুরতে হয়। কখনো কাজে, কখনো বাধ্য হয়ে, আর কখনোবা সাধে। যখন সাধে ঘুরি, তখনকার সময়গুলোকে এককথায় 'অসাধারন' বলতে আমি পারিনা কখনোই। হয়তবা কিছু সময়কে অনেক সময় ভালো বলি, কখনো সুন্দর বলি। কিন্তু সত্যি ঘুরে বেড়াবার আনন্দটুকু সেখানে অতটা থাকেনা।

আজকের দিনটা ছিল নিছক ঘুরে বেড়ানোর। আমরা হেঁটে বেড়িয়েছি যেমন ইচ্ছে তেমন করে।
সমাপ্তি, পূণ্য, নদী ছিল সাথে। আরো ছিল আহমাদ এবং মীম। এদের মধ্যে প্রত্যেকের আলাদা একটা পরিচয় আছে। কিন্তু আজকে সবাইকে এড়িয়ে যাব, কারন দিনটা নিজের জন্য সুন্দর ছিল, আর আমি তা উপভোগ করেছি। তাই আমি শুধু আমার কথা বলব। বিকেলে ঘুরতে বেড়োই। হয়তবা তিনটের দিকে। ছয়জন দলবেধে ফার্মগেট থেকে একটা দ্বিতল বাসে করে শাহবাগ যাই। সেখানটায়ও ছিল বেশ খানিকটা আনন্দ। দোতলায় উঠে সিটে বসে পূণ্য আবার উঠে গিয়ে বলে, জীবনে বাসে দাঁড়িয়ে যাইনি। আজ যাব। উদয়নপড়ুয়া পিচ্চি নদীর বাসে ঝুলবার অভ্যাস আছে আমাদের মতই! কিন্তু সমাপ্তির বাস-গাড়ি কিচ্ছুতে হবেনা, প্রয়োজন ছিল একটা বিমানের। ঐ মূহুর্তে বিমানটা কপালে না জোটায় আমরা বাসের দোতলায় ঝুলতে থাকি। এখানেও ভাগ্যদেবতা মুখ তুলে চাইলেন। ব্যাস্ত দিনের ফাঁকা রাস্তায় টুপ করে এসে পরলাম শাহবাগ।

আচ্ছা, পরিচয়গুলো দিয়ে নেই। পূণ্য পড়ে ক্লাস নাইনে, নদীও তাই। মীম ক্লাস টেনে, আর সমাপ্তি এবার 'ও লেভেল' পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি আর আহমাদ উচ্চ্যমাধ্যমিক পরীক্ষা নামে এক ধরনের খেলায় মত্ত। সেটা সত্যিই সৈয়দ হকের 'খেলারাম খেলে যা'-এর খেলা। পূণ্য-মীম দিনাজপুরের। দিনাজপুরের ছেলেমেয়েরা আজকাল বিজ্ঞানে বড্ড ভালো করছে, তা আমরা ইশকুলপড়ুয়াদের বিজ্ঞানের সব প্লাটফর্মে দেখতে পাই। গত দুই বছর ধরে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ওদের সাথে আমাকে দেখলে সখ্যতা আর চেনাশোনার মাত্রা দেখে মনে হবে আমারও পৈতৃক বাড়ি দিনাজপুর।

শাহবাগে পৌছে আমরা দলবেধে এলোমেলো হাটাহাটি করি। বৈশাখের কাঠফাটা রোদে বরফ মেশানো রাস্তার অস্বাস্থ্যকর শরবতে 'সুধা' ভেবে চুমুক দেই। গনগ্রন্থাগারের সিঁড়িতে প্রায়ইতো বসি। কিন্তু আজ বসে খুব শান্তি লাগছিল। কোন ভাবনা নেই, গা এলিয়ে ঘোরাঘুরি। চারুকলার বকুলতলায় গিয়ে বসে মনে হয়, 'আহা! এই পিচ্চিগুলোর সাথে প্রতিদিন যদি আড্ডা দেওয়া যেত এমন করে'! সত্যি যদি এমন হত, তবে হয়তবা আমার 'খারাপ সময়'-'ডিপ্রেসন' এসব কঠিন শব্দের মুখোমুখি হতে হতনা কোনদিন।

বকুল গাছের ছায়ায় মনেই হচ্ছিল না তালগাছবিহীন শহরে তালপাকা গরম। স্বস্তির নিশ্বাস ছিল, আর ছিল ক্লান্তিহীন একটা ঝরঝরে শরীর। নদী হঠাৎ বলল,
-আমি একটা ছবি আঁকব।
-আমাকে আঁক না!
-সত্যি আঁকব?
-তাইইতো বলছি!
আমাকে পাথরের মূর্তির মত বসিয়ে আঁকতে শুরু করে। খানিকটা এঁকে বলে, আমি যে ক্লান্ত! বলি, থাকনা তবে। রেখে দেয়। পিচ্চিদের বকুলতলায় ক্লান্ত দুপুরে একটা সুন্দর সময় কাটবার কথা। সময়টাকে আরেকটু সুন্দর করতে প্রথমে নদী, পরে পূণ্য, আর সবশেষে সমাপ্তিও শুয়ে পরে ব্যাগটাকে বালিশ করে। গল্প করতে করতে আবার কখন উঠেও বসে। মীম-আহমাদ সেই ভূতুড়ে পুকুরটায় ঘুরে আসে, চারুকলা হেঁটে বেড়ায়। আমরা বসেই থাকি, এবং অনেকক্ষণ বসে থাকি।

মীম একদিন বলেছিলো, আমাকে চুড়ি কিনে দিবে। আমরা শাহবাগে চুড়ি খুঁজি। চুড়ি পাইনা। মীমের পছন্দ হয় পুঁতির মালা। সেটাও রেখে দেই। সাড়ে সাতটায় মীম পূণ্যদের ট্রেন। তাই ফিরতে হবে বিজয় স্মরণিতে। আমরা খামারবাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবন এভিনিউ ধরে যাই বিজয় স্মরণিতে। পূণ্যর ঘ্যানঘ্যান করা তাড়া শুনতে শুনতে, কিংবা হেঁটে হেঁটে আমি আর সমাপ্তি ক্লান্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনেকটা ছুটতে ছুটতে গিয়ে উঠি হোটেলে। এরপর পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা।

হোটেলের পাঁচতলার রুমে বাতাস আসছিল হুরহুর করে, আর আমরা আনন্দে সেই বাতাসে আড্ডা জমাই। হাসি তামাশায় বেশ সময় কাটে। সমাপ্তি বলে, ওর ইচ্ছে করেনা ঢাকা আসতে। চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুলে পড়ে, ঐ শহরটাই ওর পছন্দ। ও লেভেলের পর ঢাকা আসবার একদম ইচ্ছে নাকি নেই। আমি বলি, এখানে হয়তবা গরম আর জ্যামটা অসহ্য। কিন্তু তবু থাকবার জন্য সেরা শহর এটা। এখানে দম ফুরায়, তবু আমরা এ শহরেই বেশ আছি। চলে আয়, দেখবি ভালো লাগবে। সত্যি এ শহরে জীবনযাত্রা বেশ সোজা। দম ফেলবার ফুসরতটা ঠিক আছে, খুঁজে পেতে হয়। এই যেমন আজ পেলাম আমি।

আমরা বেশ আনন্দে সময় কাটাই। দিনাজপুরের বিজ্ঞানপিয়াসু অনেকগুলো ছেলে ছিল, একটা বাচ্চা মহা লাজুক। অন্যরা বেজায় দুষ্টু। একদম বিরক্ত করে ফেলবার ক্ষমতা রাখে। সার্কাজমের চূড়ান্ত প্রকাশ ছিল পুরো সময়টা জুড়ে।

বকুলতলায় নদীকে দেখে পূণ্যও বলল, ভাইয়া তোমাকে আঁকব। একটা পরে থাকা কাগজের ব্যাগের একপিঠে আঁকে আমাকে কলম দিয়ে দুই মিনিটে। কার্টুনই হবে সেটা। আমার গেঞ্জিতে লেখা- 'Digital Bangladesh, Skilled, Equiped, DigitalReady' সেটাকেও লিখে দেয় বুকে। এরপরে পিঠের লেখাটা তো লিখতে হবে? তাই কাগজটাকে উল্টে, উল্টোপিঠে এঁকে দেয় সেটা! আমি মুগ্ধ হই ওর খেয়ালি রসবোধ দেখে। পূণ্যর ছবি তুলবার শখের কথা শুনি। তারাদের ছবি তুলবার ইচ্ছের কথা শুনি।

নিজ শহরে সবচেয়ে আনন্দ নিয়ে ঘোরা দিনটায় সবার একটা করে অন্ধকারাচ্ছন্ন গোপন তথ্য ফাঁস হোক। আজ আহমাদ বিক্রি হয়ে গেছে সাত টাকায়। মীম কিনে নিয়েছে গুনে গুনে সাতটা টাকা দিয়ে। দাসপ্রথায় ফিরছি তবে আমরা আবার।
পূণ্য আর সমাপ্তির ব্যাপারে গোপন তথ্য কী? দুজনের কেউই নাকি রানের খাতা খোলেনি! অবিশ্বাস করছি, তাতে কী? এত্ত বড় হয়েও খাতাটা শূণ্য? তবে রইলটা কী?
নদী, সমাপ্তি, মীম- একজনও "দুপুর থেকে তুমি ওপরতলায় নিরুদ্দেশ!" কথাটা মাধূর্য নিয়ে বলতে পারেনা। সবাই ব্যার্থ!
লম্বা নখের ব্যাপারে সমাপ্তির দাবী, ওটা কাটা হয়ে ওঠেনা। অথচ আমার দাবী ওটা রাখা হয়েছে মেহেদী দিতে। হয় আমি ঠিক, কিংবা ও। কে জানে সেটা! 
বেজায় গরম ছিল। বাতাস করবার জন্য মীমের হাতে একটা পাখা ছিল। কিন্তু আমাদের কি ওসব আছে? সমাপ্তি ওর ইশকুলের রিপোর্ট কার্ড বের করে দিয়েছিল। খুলে আমার চোছানাবড়া! A* এর মানে হল ৯৫ কিংবা তার বেশি মার্কস। পষ্ঠাজুড়ে সব টার্মেই A* গ্রেড! অনেকগুলো! কিছু A+ ও আছে, যার অরথ নব্বই এর ওপরে। দু-চারটে এরচেয়ে খারাপ যে নেই, তা না। এবং সেজন্যই সমাপ্তি এই 'মহা খারাপ' রেজাল্ট নিয়ে লজ্জিত।
 
আমার ব্যাপারেও তো কিছু ফাঁস করতে হয়? হ্যাঁ করছি। সমাপ্তি আর পূণ্য, দুই পিচ্চির উপরই আমি ক্রাশ। অক্সফোর্ডের ইংরেজী অভিধান ক্রাশ শব্দের যে অর্থ বলে, তেমন  না। বাঙ্গালি ক্রাশ! একদম মুগ্ধ আমি ওদের সবকিছুতে।
বাকি দুটো পিচ্চিও অসাধারন। এদের একটা নদী, দেখতে প্রাইমারি ইশকুলের পিচ্চি লাগে। আর মীম এর দিকে তাকালে চোখটা যে যাবে একদম! তুলেই নিবে একজন!

সন্ধ্যের ঠিক পরে ফিরি বাসায়, হোটেল থেকে চেকআউট করে ওদেরকে কমলাপুর রেল ইষ্টিশনের পথ দেখিয়ে। ফিরতে ফিরতে মনে হয়, দিনটা বেজায় সুন্দর ছিল!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন