মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

তেজষ্ক্রিয়তা এবং মেরি কুরি

মেরি কুরি
অনেকের ঘড়ির কাটা দেখা যায় অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। ঘড়ির ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়, নষ্টও হয়ে যায়। পরে থাকে কোথাও। কিন্তু ঘড়ির কাটার লাইট আর বন্ধ হয় না। ব্যাটারি ছাড়া এতদিন কিভাবে চলে? ওখানে থাকে রেডিয়াম। যা বছরের পর বছর এমন বিকিরণ করেই চলে। এটার নাম তেজষ্ক্রিয়তা। তেজষ্ক্রিয়তা শব্দটা শুনলেই জাপান দেশটার কথা মনে পরে যায়। ওই দেশটায় তেজষ্ক্রিয়তার ভয়াবহতা আমরা দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধে দেখেছি। এরপর দুয়েক বছর আগেও দেখেছি।
ইউরেনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন হেনরি বেকরেল, ১৮৯৬ সালে। কিন্তু তিনি জানতেন না এটার কারন। আর এর পরের বছর এটা নিয়ে কাজ শুরু করেন মেরি কুরি।


তার জন্ম হয়েছিল ১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডে। তখন পোল্যান্ড স্বাধিন ছিল না। রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, এবং প্রুশিয়ার অধিনে ছিল। তিনি যেখানে জন্মেছিলেন (ওয়ারস) ছিল রাশিয়ার একটি প্রদেশ। তবে স্বাধিনতার জন্য সংগ্রাম চলছিল জোরেশোরেই। তাই তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে অনেক প্রতিকুল পরিবেশে। 

 
বিয়ে করেছিলেন পিয়েরি কুরি কে। তখন পিয়েরি বিজ্ঞানী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত।
যখন কাজ শুরু করেন মেরি, তখন তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। ইপিসিআই ল্যাবরেটরিতে একটি ছোট্ট রুমে কাজ শুরু করতে হয় তাকে।
রুমটা ছিল খুবই ঠান্ডা। তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এই ঘরটায়ই কাজ করেন, কারন এজন্য তাকে কোন পেমেন্ট করতে হত না। আর ওই ল্যাবের প্রধান ছিল তার স্বামী পিয়েরি। তাই গবেষণায় সুপারভাইজার হিসেবে কাছে পেতেন স্বামীকে। এবং খরচটাও বেঁচে যেত।
প্রথম দিকে তিনি কাজ করেছেন ইউরেনিয়ামের কার্যকারিতা নিখুতভাবে মাপজোখ করা নিয়ে। যে যন্ত্রগুলো দিয়ে কাজ করতেন, তার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন তার স্বামীই।
গবেষণা শুরুর কিছু দিনের মাঝেই তিনি বুঝতে পারলেন, তেজষ্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম পরমানুর একটি বিশেষ গুন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পদার্থের গঠন কোন বিবেচ্য নয়। এটা ছিল তখনকার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য।
তখন তিনি ভাবলেন, ইউরেনিয়াম যেমন তেজষ্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে, অন্যান্য পরমাণুও কি একইভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে? তিনি তার মত করে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন সব পদার্থ নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন প্রত্যেকটা পদার্থের উপরই পরীক্ষা চালাবেন। কিন্তু সাফল্য চলে আসে বেশ দ্রুত। ১৮৯৮ সালে তিনি দেখতে পান, ইউরেনিয়ামের আকরিক (যে খনিজ পদার্থ থেকে ইউরেনিয়াম বের করা হয়) পিচব্লেন্ডের প্রতিক্রিয়া ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি দেখা যায়। কিন্তু কেন?
তিনি বুঝতে পারেন, পিচব্লেন্ডে আরও এমন কোন পদার্থ আছে, যা তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি করে। এবং কাজ করতে করতে তিনি আবিষ্কার করে বসেন থোরিয়াম (Th)। কিন্তু তিনি জানতেন না, তার কয়েক সপ্তাহ আগেই থোরিয়াম আবিষ্কৃত হয়ে গেছে জার্মানীতে। তবে পিচব্লেন্ডের তেজষ্ক্রিয়তা যে অত্যন্ত বেশি, তা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। এবং খুঁজতে থাকেন আর কি তেজষ্ক্রিয় মৌল আছে পিচব্লেন্ডে। তারা মৌলটাকে আলাদা করতে চান, এবং মৌলটার ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্ম আবিষ্কার করতে চেষ্টা করতে থাকেন। এরমধ্যে তার স্বামীও যোগ দিয়েছেন তার গবেষণায়।
১৮৯৬ এর ১২ এপ্রিল তার পেপার বিজ্ঞান একাডেমীতে পড়া হয়। সেই পেপারে প্রমান করা হয়, পদার্থের
তেজষ্ক্রিয়তা একটি পারমাণবিক ব্যাপার। এবং পিচব্লেন্ডে ইউরেনিয়াম ছাড়াও একটি তেজষ্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ আছে।
এসব আবিষ্কার করেন কিন্তু ইপিসিআই ল্যাবের সেই ছোট্ট, অস্বাস্থকর, স্যাতস্যাতে, স্টোর রুমটায়ই। সেখানেই চলতে থাকে তাদের গবেষণা। এবং খুব শিগগিরিই তারা নতুন দুইটি মৌলের অস্তিত্ব খুঁজে পান পিচব্লেন্ডে। এবং এ দুটোই তেজষ্ক্রিয়তার দিক থেকে ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি সক্রিয়।
নতুন যে মৌলদুটো খুঁজে পেয়েছিলেন তারা, তার একটির সাথে আবার বিসমাথের ধর্মের বেশ মিল আছে। তাই বিসমাথ তখন যে পদ্ধতিতে পিচব্লেন্ড থেকে আলাদা করা হত, ঠিক একই পদ্ধতিতে চেষ্টা করতে লাগলেন নতুন মৌলটাকে।
বিজ্ঞান একাডেমীতে ১৮৯৮ এর জুলাইয়ের ১৮ তারিখ তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে তাদের যৌথ পেপার পাঠ করা হয়। এবং তা পাঠ করেন তেজষ্ক্রিয়তার আবিষ্কারক বেকরেল। এ পেপারে তারা তেজষ্ক্রিয়তাকে রেডিও এক্টিভিটি বা রশ্মি বিকিরণ বলেন। আর তারা ৮৪ পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট নতুন মৌল পোলিনিয়াম এর আবিষ্কারের কথাও রেখেছিলেন এই পেপারে। পোলিনিয়াম শব্দটা এসেছে পোল্যান্ড থেকে। তিনি প্রবল দেশপ্রেম থেকেই নামকরণটি করেছিলেন।

কিন্তু কয়েকদিন পর দেখা গেল, পোলিনিয়াম একটি স্বল্পায়ু ধাতু। এর অর্ধায়ু(half-life) মাত্র ১৩৮ দিন। অর্থাৎ প্রতি ১৩৮ দিনে এর সক্রিয়তা নেমে আসে অর্ধেকে। তাই এই ধাতুকে তেমন একটা কাজে লাগানোর উপায় নেই।
একই বছরের শেষে এসে কুরি দম্পতি পিচব্লেন্ড থেকে আলাদা করেন নতুন একটা মৌল। নাম রাখেন রেডিয়াম। এটি খুবই দীর্ঘায়ু পদার্থ। এর অর্ধায়ু প্রায় ১৬২০ বছর। এই আবিষ্কারে তার স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হয়। কাজে দেওয়ার মত একটা তেজষ্ক্রিয় পদার্থ খুঁজে পান।

এরপর দুজনের গবেষণার বিষয় আলাদা হয়ে যায়। পিয়েরি গবেষণা করতে থাকেন তেজষ্ক্রিয়তার কারণ নিয়ে। আর মেরি কুরি চালিয়ে গেলেন রসায়নের গবেষণা। নতুন আবিষ্কৃত মৌলগুলো পিচব্লেন্ড থেকে আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। চেয়েছিলেন মৌলদুটির ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মগুলো বের করতে।
মৌলদুটোকে আলাদা করতে তার প্রচুর পিচব্লেন্ড দরকার ছিল কাঁচামাল হিসেবে। তবে সমস্যা ছিল অন্যখানে। এক গ্রামের ভগ্নাংশ পরিমান রেডিয়াম বের করতে তার দরকার পরত কয়েক টন পিচব্লেন্ড। এ টাকা নিজেরই জোগাড় করতে হত। তবে ইউরেনিয়াম লবণ আলাদা করার পর যে পিচব্লেন্ড থাকত, তা দিয়েই কাজ চলত তার। তাই কলকারখানায় ইউরেনিয়াম লবণ আলাদা করার পর যে পিচব্লেন্ড থাকত, তা কম দাম দিয়ে কিনে নিতেন তারা। তারা কাজ করতেন প্যারিসে। কিন্তু অস্ট্রিয়া থেকে আনাতে হত পিচব্লেন্ড। এজন্যও কম ঝক্কি ঝামেলা সইতে হয়নি তাদের। তবে কাজটাকে ভালবেসেছিলেন বলেই এত কষ্ট সহ্য করতে পেরেছিলেন তারা।
টিন ফুটো, কাঠের আরও একটি ঘর পেয়েছিলেন মেরি ইপিসিআই ল্যাবে। সেখানে তিনি পিচব্লেন্ড থেকে বেরিয়াম নিষ্কাষণের কাজটি করতেন। ধোঁয়া, স্যাঁতস্যাঁতে, তেজষ্ক্রিয়তার বিকিরণে জর্জরিত ঘরটা ছিল খুবই অস্বাস্থকর।
ওই ঘরটার পরিবেশ ছিল স্বাস্থের জন্য মারত্মক হুমকিস্বরূপ। একটা উদাহরনেই বোঝা যাবে তিনি কতটা রিস্ক নিয়ে কাজ করতেন। তার নোটবইগুলো এখন রেডিয়েশনপ্রুফ কন্টেইনারে সংরক্ষিত আছে, বিপদজনক বলে। কিন্তু ওগুলোয় তিনি লিখেছেনও একসময়। তার স্বাস্থের প্রচন্ড ক্ষতি করছিল এগুলো। এমনকি তার গর্ভে একটা সন্তান ৫ মাস বেড়ে ওঠার পর গর্ভপাতও হয়ে গিয়েছিল তার। এজন্য অনেকদিন বিশ্রামও নিতে হয়েছিল তাকে। তবুও থামেননি। একটু সুস্থ হয়েই কাজে ফিরেছিলেন তিনি।


মেরি কুরি এবং পিয়েরে কুরি
মেরি কুরি এবং পিয়েরে কুরি
১৯০২ সালের মার্চে একগ্রামের দশ ভাগের এক ভাগ বিশুদ্ধ রেডিয়াম আলাদা করতে সক্ষম হন তিনি। এই ক্ষুদ্র পরিমানের রেডিয়ামের জন্য কাঁচামাল হিসেবে লেগেছিল তার বহু টন পিচব্লেন্ড। তবে এই ক্ষুদ্র পরিমাণ পদার্থই রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট ছিল। ভরও বের করা যাবে এ থেকে। এবং একে জায়গা দেওয়া যাবে পর্যায় সারনীতে। পরের বছর রেডিয়ামকে দুরে সরিয়ে থিসিসের কাজে মন দেন। এবং প্রথম নারী হিসেবে ইউরোপের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
পরের কয়েকটি বছর রেডিয়াম বেশ একটা জোয়ার সৃষ্টি করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে। রেডিয়ামের তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্য এর ব্যাবহারটাও বেশ ভালভাবেই শুরু হয়। তবে অনেক পরে জানা যায়, এই বিকিরণ সুস্থ কোষগুলোও ধ্বংস করে দেয়।
ঠিক ১৯০৩ সালেই আসে তার জন্য অসাধারণ একটি খবর। তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করায় পদার্থবিজ্ঞানে তিনজনকে যৌথ নোবেল দেওয়া হয়। তেজষ্ক্রিয়তার আবিষ্কারক হেনরি বেকরেল, মেরির স্বামী পিয়েরি কুরি, এবং স্বয়ং মেরি কুরি। প্রথম নোবেল প্রাপ্ত নারীও হয়ে যান তিনি।

পিয়েরি কুরি এর কিছুদিন পরে দেখতে পান বিস্ময়কর রকমের তাপ উৎপন্ন করার ক্ষমতা রয়েছে রেডিয়ামের।
আর রেডিয়ামের এই সক্রিয়তার কোন শেষ নেই। কিন্তু এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদেরকে বেশ ধাধায় ফেলে দেয়। এত শক্তি আসে কোত্থেকে? কনজার্ভেশন অব এনার্জি মতবাদ নিয়ে সন্দেহে পরে যান তারা। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্রটা বের হয় ১৯০৫ সালে। তখন সমস্যাটার সমাধান হয়। এখানে আসলে ভর শক্তিতে রুপান্তরিত হচ্ছে।
অসুস্থতা-ব্যাস্ততার কারনে, ১৯০৩ সালে তারা নোবেল বক্তৃতা দিতে সুইডিশ একাডেমিতে যেতে পারেননি। ১৯০৫ সালে গিয়ে সেই বক্তৃতা দিয়ে আসেন তারা। কিন্তু আস্তে আস্তে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন পিয়েরি কুরি। তার অসুস্থতার একটা বড় কারন ছিল তেজষ্ক্রিয়তা। তবে তিনি বেশ ভালভাবেই কাজ চালিয়ে যান।
কিন্ত পরের বছর ১৯০৬ সালে ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বৃষ্টির কারনে পিচ্ছিল হয়ে থাকা রাস্তা পারানোর সময় পা পিছলে ঘোড়ার গাড়ির নিচে চাপা পরে মারা যান পিয়েরি কুরি। প্রচন্ড মানসিক ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে পরেন মেরি।
কাটিয়ে উঠতে লাগে অনেক দিন। এরপর ১৯১১ সালে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন বয়সে পাঁচ বছরের ছোট, বিজ্ঞানী পল ল্যাভেনজিনের সঙ্গে। ল্যাভেনডিন ছিলেন বিবাহিত এবং তার সন্তানও ছিল। তবে পারিবারিক জীবনে সুখি ছিলেন না ল্যাভেনজিন।

খুব অপমানজনক এবং আপত্তিকর মন্তব্য করে খবরগুলো ছাপে ফ্রান্সের পত্রিকাগুলো। এতে মেরির প্রতি অনেকের শ্রদ্ধাবোধেই টান পরে। পত্রিকায় তার প্রেমের খবর প্রকাশিত হয় ১৯১১ এর ৪ নভেম্বর। এর ঠিক তিনদিন পর আসে চমৎকার আরো একটি খবর।
রসায়নে অবদানের জন্য এককভাবে নোবেল পেয়েছেন মেরি কুরি। দ্বিতিয়বারের মত। আগের নোবেলটা ছিল পদার্থবিজ্ঞানে। সেটা ছিল তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজের প্রেক্ষিতে। আর এবার রসায়নে পেলেন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য।

তার বহু কষ্টের ফল মিলল অবশেষে। দিনের পর দিন স্যাঁতস্যাঁতে এক রূমে কাজ করার, নিজের শরীরটার উপর এত ধকল সহ্য করার প্রতিদান তিনি পেলেন পুরোপুরিই। তবে প্রথমবার নোবেল পাওয়ার আগে করা কাজের জন্যই তিনি পান দ্বিতিয় নোবেল। কিন্তু কাজগুলো একই জায়গায় একই জিনিস নিয়ে করলেও দুটি কাজের মধ্যে আসলেই অনেক পার্থক্য। তবে, প্রথম নোবেলপ্রাপ্তির আগেই করেছেন বিজ্ঞানী হিসেবে তার বড় প্রায় সব কাজ। এরপর বিজ্ঞানে তেমন একটা অবদান না রাখলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি যা করেছেন তাতে যে কেউ দাবি করতেই পারে তৃতিয় আরেকটা নোবেল তাকে দেওয়া উচিত ছিল শান্তিতে। বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে ছিল প্রচন্ড চাপ। সাথে ছিল এক্স-রের সরঞ্জামের ঘাটতি। যুদ্ধাহত রোগিদের অধিকাংশেরই করতে হত এক্স রে। এজন্য তিনি নেমে পরেন তহবিল সংগ্রহে। এবং অসম্ভবকেই বাস্তবে রূপ দেন। ঐ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ২২০ টি রেডিওলোজি স্টেশন গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ২০০ টি ছিল বিভিন্ন জায়গায়, এবং ২০ টি ছিল ভ্রাম্যমান। এগুলো বিভিন্ন ধনী মহিলার কাছ থেকে গাড়ী ধার নিয়ে তাতে তৈরী করেছিলেন তিনি। যুদ্ধের সময় তার গড়া এই রেডিওলজি ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহতের এক্স রে করা হয়েছিল। এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনিও। তিনিও এক্স রে করতেন বিভিন্ন স্টেশনে। এমনকি অসুস্থ শরীর নিয়ে ভ্রাম্যমান রেডিওলজি স্টেশন এর গাড়িও চালিয়েছেন তিনি।
মেরিকে গড়ে দেওয়া হয়েছিলো একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট। আরেকটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট গড়েছিলেন মেরি। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসতে। আর তার জন্য যে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট করা হয়েছিল, সেখানে কাজ করে মেরির মেয়ে ইরিন, মেয়ের স্বামী ফ্রেডরিক জুলিয়েটের সাথে যৌথভাবে নোবেল পান। তাদের গবেষণার বিষয়ও ছিল রেডিয়াম!
মেরির পরিবারকে এজন্যই বলা হয় নোবেল ফ্যামিলি।
মেরি মারা যান ১৯৩২ সালের ৪ জুলাই। অনেকের মতে, তার সবচেয়ে বড় অবদান বিজ্ঞানেও না, মানবতায়ও না। তিনি নারী জাতিকে যে স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা অতুলনীয়। ঐ রকম কুৎসিত সামাজিক অবস্থায়ও তিনি যেভাবে এগিয়ে গেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ! তিনি কৈশোরের শেষ এবং যৌবনের শুরুটা কাটিয়েছেন অন্যের বাড়ি গৃহশিক্ষিকার কাজ করে। অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে তিনি পোল্যান্ড থেকে প্যারিসে পড়তে এসেছিলেন। তার বড় বোনের পড়ার খরচেরও একটা অংশ যুগিয়েছিলেন তিনি। রুশ শাষনের কারনে পোলিশ মেয়েরা পড়তে পারত না বেশি। কিন্তু পোলিশ গোপন সংগঠন ফ্লাইং ইউনিভার্সিটির ক্লাস করতেন তিনি নিয়মিত। এবং সেখান থেকেই শিখেছেন অনেক কিছু।
আর প্যারিসে এসে এক-দেড়বেলা খেয়ে কাটিয়েছেন তিনি বহুদিন। ঘুমিয়েছেন দিনে দু ঘন্টা। এখনকার কোন পুরুষের জন্যেও কাজটা প্রায় দুঃস্যাধ্য। এসব তিনি করেছেলিন তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে। এজন্যই তিনি অন্য সব নারীর থেকে আলাদা।
তার এই স্বপ্ন দেখানোর মত বড় কাজটার কাছে দু বারের নোবেল প্রাপ্তিও ম্রিয়মান।

* লেখাটা কেউ একজনকে ইনস্পায়ার করার জন্য।

৩ ডিসেম্বর ২০১৩

বিজ্ঞানবিশ ব্লগে প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন